গত ১৬ই নবেম্বর ধর্মতলায় এন আর সি-র নামে কেন্দ্রের বাঙালী বিরোধী ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ‘আমরা বাঙালী’র প্রতিবাদ সভায় অসম, ত্রিপুরা, মণিপুর সহ বাঙালীস্তানের অর্থাৎ সমস্ত বাঙালী অধূ্যষিত অঞ্চলের প্রতিনিধিরা তাদের তীব্র বিক্ষোভ প্রকাশ করলেন৷ প্রতিটি বক্তাই যুক্তি ও তথ্য সহকারে তুলে ধরলেন, এই এন আর সি আসলে বাঙালী বিরোধী এক গভীর ও সুদীর্ঘ ষড়যন্ত্রের অঙ্গ৷ কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে চলেছেন, এন আর সি আসলে বিদেশী অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্ণিত করে তাদের বিতাড়নের প্রক্রিয়া৷ এই বলে তাঁরা এন আর সি-র পক্ষে জনমত তৈরী করতে চাইছেন৷ কিন্তু বাস্তবে অসমে এন আর সির নামে কি হচ্ছে একটু নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করা যাক৷ অসমের দলগাঁওয়ের একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও আইনজীবী নিরোদবরণ দাসের ১৯৫১ সালের অসমের বাসিন্দা হিসেবে নথিপত্র থাকা সত্ত্বেও এন আর সি তালিকা থেকে নাম বাদ পড়ে৷ নিরোদবাবু তার বৈধ নথিপত্র নিয়ে এন আর সি অফিস থেকে শুরু করে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন৷ দিনের পর দিন এইভাবে সরকারী অফিস ও আদালতে ঘোরাঘুরি করেও কোনও কাজ না হওয়ায় মানসিক চাপে তিনি গত বছর আত্মহত্যা করলেন৷
নিরোদবাবু একজন শিক্ষিত মানুষ, আইনজীবী, টাকা-পয়সাও কিছু ছিল৷ অসমের পুরোনো বাসিন্দা৷ ১৯৭১ সালের ভিত্তি বৎসরের আওতার বাইরে৷ তবু শত চেষ্টা সত্ত্বেও এন আর সি তালিকায় নিজের নাম তুলতে পারেননি৷ এমনিভাবে অনেকেই আত্মহত্যা করেছেন৷ একদিকে এন আর সি তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া, তারপর ডি-ভোটারের নোটিশ (ডাউটফুল ভোটার), আবার অন্যদিকে আলফার হুমকী---এই ত্রিফলা আক্রমণে অসমে লক্ষ লক্ষ বাঙালীর জীবনের সামনে আজ চরম অস্তিত্বের সঙ্কট দেখা দিয়েছে৷
স্বাধীনতার পর পঞ্চাশের দশক থেকেই অসম, ত্রিপুরা, উত্তর-পূর্বাঞ্চল সহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বাঙালীদের ওপর বার বার আক্রমণ ও আইনের আঘাত এসেছে৷ অসমে ‘বঙ্গাল খেদা’, ১৯৮৩ সালের নেলীর গণহত্যা, ত্রিপুরাতে ’৮০-র গণহত্যা ইত্যাদি এর কয়েকটি জ্বলন্ত উদাহরণ৷ সেই স্বাধীনতার পর থেকেই অসমের উগ্রপন্থী অসমিয়ারা দাবী করে আসছে, অসম থেকে বাঙালীদের তাড়াতে হবে৷ আর তার জন্যেই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অজুহাতে বাঙালীদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে৷
তাই অসমে আজ যে এন আর সি-কে অজুহাত করে বাঙালী বিরোধী চক্রান্ত এই সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে৷ এর পেছনে এক সুদূর প্রসারী ষড়যন্ত্র ও বাঙালীদের প্রতি বঞ্চণার দীর্ঘ ইতিহাস নিহিত রয়েছে৷
ব্রিটিশ রাজত্বে ব্রিটিশরা বাঙালীদের ভয় করত৷ ভয় করত বাঙালীদের সংগ্রামী চেতনার জন্যে৷ বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বাঙলার বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের ভয়াবহতা ব্রিটিশরা ভুলতে পারেনি৷ ক্ষুদিরাম প্রফুল্ল চাকীর মত বাঙলার দামাল ছেলেরা সেদিন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল৷ এই কারণে বাঙলাকে নানাভাবে দুর্বল করার জন্যে ব্রিটিশ একের পর এক চাল চালতে আরম্ভ করল৷ সম্প্রদায়ভিত্তিক‘ ডিভাইড এ্যাণ্ড রুল’ পলিসিতে বাঙলাকে সরাসরি ভাবে দু’ভাগ (বঙ্গভঙ্গ) করার প্রয়াস ব্যর্থ হওয়ার পর ব্রিটিশরা নূতন রাস্তা ধরল৷ ১৯১২ সালে বৃহত্তর বাঙলাকে কেটে ওরা অসম প্রদেশ তৈরী করল৷ আর তখন বাঙলার সিলেট, কাছাড়, উত্তরপূর্ব রঙপুর জেলা তিনটিকে নবসৃষ্ট অসম রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে দিল৷ এইভাবে নানান রাজনৈতিক ভাঙ্গাগড়ার মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠার ইতিহাস থেকে এটা সবারই জানা যে বর্তমান অসমের নওগাঁ, হোজাই, লঙ্কা, লামডিং, বরপেটা, ধুবড়ি, গোয়ালপাড়া, কাছাড়া, মিকিড় পাহাড়ের সমতল অংশ---এসবই প্রাচীন কাল থেকে মূল বাঙলার অংশ ও বাঙালী অধূ্যষিত৷ বর্তমানে এই এলাকাগুলি অসমের অন্তর্ভুক্ত হলে বাঙালীরাই এখানকার ভূমিপুত্র বা ভূমিকন্যা৷ তাহলে কোন্ যুক্তিতে এই অঞ্চলের বাঙালীরা অসমের বিদেশী বলে চিহ্ণিত হবে৷ কিন্তু স্বাধীনতার পরেই তো অসমের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ হুঙ্কার দিয়েছিলেন এই বলে যে ‘অসম রাজ্য শুধু অসমিয়াদের জন্যে৷’ এই ধারণারই পরিণতি আসমে ধারাবাহিকভাবে ‘বঙ্গাল খেদা আন্দোলন’, বাঙালী হত্যা তথা বাঙালী বিতাড়ন অভিযান৷ এন আর সিকেও বর্তমানে উগ্র অসমিয়ারা তাদের বাঙালী বিতাড়ন-ষড়যন্ত্রের একটি কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছে৷ তাই সমস্ত তথ্য যুক্তিকে বানচাল করে এরা বাঙালীদের ওপর পরপর আক্রমণ হানছে৷ বর্তমানে এন আর সি-র বলি হিসেবে ১৯ লক্ষ বাঙালীকে বিদেশী চিহ্ণিত করার চেষ্টা তাদের ষড়যন্ত্রেরই অঙ্গ৷
কেন্দ্রের বিজেপি সরকার বাঙালীদের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম বিভাজন সৃষ্টি করে বাঙালীদের ঐক্য ভাঙবার জন্যে হিন্দুত্ববাদের তাস খেলছে৷ কিন্তু অসমের বর্তমান এন আর সি-র বলি ১৯ লক্ষ বাঙালীর ১২ লক্ষ হিন্দু৷ এখন তাই এরা বাঙালী বিরোধিতার ষড়যন্ত্র ধরা পড়ার ভয়ে ভীত৷ সেই ভয়েই অসমের বিজেপি নেতারা সম্প্রতি মুখে এন আর সি-র বিরোধিতা করছে৷ এখন পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরাতেও কেন্দ্রীয় সরকার এন আর সি-র হুমকী দিয়ে এই রাজ্যগুলিতেও এন আর সি-র আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে৷ অসমের ঘটনা থেকে আতঙ্কিত পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার বাঙালীরাও৷ এখানকার পুরোনো বাসিন্দা হয়েও যদি ঠিকভাবে পুরোনো নথিপত্র না দেখাতে পারে হয়তো বা আমাদেরও বিদেশী বলে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেবে! আর সেখানেই পচে মরতে হবে! দীর্ঘ সংগ্রামের পর ব্রিটিশের কবল থেকে মুক্ত হয়ে আবার এ কোন সন্ত্রাসের পরিবেশের মধ্যে আমরা পড়লাম! এটাই এখন আমাদের আশঙ্কা! তার সঙ্গে আবার হিন্দু-মুসলিম বিভাজন৷ আর তার অনুসঙ্গ রূপে আরও নানান ধরণের বিভাজনের রাজনীতি শুরু হয়ে গেছে৷ কে স্বদেশী কে বিদেশী এই সন্দেহে আবার পারস্পরিক অবিশ্বাস হিংসা বিদ্বেষের পরিবেশ সৃষ্টি হতে চলেছে৷ এই বিভাজনের বিপজ্জনক পরিবেশ সৃষ্টি অবিলম্বে বন্ধ হওয়া প্রয়োজন৷
তাই নিঃসন্দেহে বাঙালী জাতির পক্ষে এন আর সি এক বিরাট ভয়ঙ্কর বিপদ৷ আজ সমস্ত বাঙালীদের দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই বিপদ রুখতে হবে৷ পলাশীর যুদ্ধের সময় বাঙালী ঐক্যের অভাবের জন্যে ব্রিটিশরা এদেশে রাজত্ব করার সুযোগ পেয়েছিল৷ পরবর্তীকালে বাঙালীদের এই অকাতরে বুকের রক্ত ঢেলে সেই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করে’ ব্রিটিশদের বিতাড়িত করতে হ’ল৷ বাঙালীদের আজ যে দুর্দশা এর জন্যে অনেকাংশে বাঙালীরাই দায়ী৷ অসমে বাঙালী নির্যাতনের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীরা বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীরা কোন প্রতিবাদ করেনি৷ আজ উত্তর-পূর্বাঞ্চল সহ সারা দেশ জুড়ে বাঙালীরা কোনঠাসা হয়ে পড়েছে৷ বর্তমানে বাঙালীদের অস্তিত্বই বিপদাপন্ন৷ এই অবস্থায় পুরোনো দিনের ভুলভ্রান্তি ভুলে সমস্ত বাঙালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই বিপদের মোকাবিলা করতে এগিয়ে আসতে হবে৷ কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীদের প্রতি আমাদের আবেদন, বাঙালী জাতির এত বড় বিপর্যয়ের দিনে আপনারা এগিয়ে আসুন৷ এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে প্রতিবাদে মুখর হোন৷ বাঙালী জাতির অতীত গৌরব ফিরিয়ে আনবার জন্যে আপনাদের অগ্রণী ভূমিকার প্রয়োজন আছে৷
- Log in to post comments