এন.আর,সি সর্বসাকুল্যে তিনটে মাত্র ইংরেজী শব্দের মিলিত রূপ---ন্যাশ্যানাল রেজিষ্টার অব সিটিজেনস্৷ (বাংলা ভাষার এর তর্জমা করলে দাঁড়ায়---নাগরিকপঞ্জীকরণ৷) অর্থাৎ কোন সার্বভৌম রাষ্ট্রে নাগরিকগণের সরকারী মতে বিধিবদ্ধ তালিকা৷ তাই, এর গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য দু’টো দিকই যথেষ্ট ওজনদার বলারও অপেক্ষা রাখে না৷ যে কোনো দেশ, রাজ্য বা রাষ্ট্রের পক্ষেই এর নিঁখুত হিসেব-রক্ষণের কাজটা অতি গুরুত্বপূর্ণ, অপরিহার্য তো বটেই৷ রাষ্ট্রের লোকসংখ্যা ও তার হ্রাস বৃদ্ধি, গড়-পড়তা, আয় নির্র্ধরণ, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ, রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়ের হিসেব-নিকেশ, উন্নতি-অবনতি ইত্যাদির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার বিশ্লেষণ করতে চাইলে রাষ্ট্রের নাগরিকগণের নির্ভুল তালিকা সরকারী দপ্তরে মজুত থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক৷ তাই, আমাদের ভারত-যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিটি অঙ্গরাজ্য কিংবা তদনুরূপ ভূ-ভাগ সমূহের জনসংখ্যা তথা নাগরিকগণের নির্ভুল হিসেব ও নিঁখুত তালিকা থাকবে, সেটাই তো বাঞ্ছনীয়, তা একান্ত কাম্য বলেই তো এ ব্যাপারে আপত্তি তোলার কোন ফুরসৎ থাকে না৷ তবে ভারতের ক্ষেত্রে ও ভারতেরই অঙ্গরাজ্য সমূহ যেমন অসম, ত্রিপুরা, মণিপুর, মেঘালয়, নাগাল্যাণ্ড, মিজোরাম , পঃবঙ্গ , বিহার, পঞ্জাব, কশ্মীর, গুজরাত, মহারাষ্ট্র,ইত্যাদির ক্ষেত্রে নাগরিকপঞ্জীকরণ কিংবা বৈধ নাগরিকদের স্বচ্ছ তালিকা অথবা বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে অস্বচ্ছ তালিকা আবার ইচ্ছাকৃত ভাবে ত্রুটিপূর্ণ তালিকা ইত্যাদি নিয়ে যদি নাগরিকদের মনে সন্দেহ জাগিয়ে তোলে, কৌতুহলের উদ্রেক হয়, প্রশাসনের ওপর থেকে শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস তলানিতে গিয়ে ভয় বা অশ্রদ্ধার সৃষ্টি হবার উপক্রম দেখা দেবার পরিস্থিতি জেগে ওঠে, সেই অবস্থায় দেশবাসীগণের বিশেষ করে বৈধ নাগরিকগণের মানসিক অবস্থাটা কী পরিমাণে আহত বোধ করতে পারে, সেটি আশা করছি, কোন বুদ্ধিমান, বিচারশীল, বিচক্ষণ নাগরিকই হোন বা প্রশাসনিক কর্তাব্যষ্টি বা হোম-চোমড়া যাই হোন না কেন, তাকে বিশদভাবে বুঝিয়ে বলবার প্রয়াসটাই নির্বুদ্ধিতার পরিচয়ক মাত্র হবে৷ অনেকের মতে বিদেশাগত আগন্তুক অথবা উদ্বাস্তুদের ‘‘অনুপ্রবেশকারী’’ বলা হয়ে থাকে৷ যারা এরূপ মন্তব্য করে থাকেন তারাও নিশ্চয়ই আগন্তুক উদ্বাস্তু, বিদেশী বা ফরেনার, অনুপ্রবেশকারী বহিরাগত ইত্যাদি শব্দগুলোর প্রতিটির মানে সম্যকরূপে জেনে বা না জেনেই বলে থাকেন৷ আর অজান্তে মুখরোচক একটা তক্মা অপরের গায়ে চাপাবার পূর্বে একটু যদি মানবতার দৃষ্টিতে অর্থাৎ উদার দৃষ্টি নিয়ে কাজটি করেন তাহলেই তো বোধ হয় সর্বাপেক্ষা মহৎ কাজটি তিনিও অনায়াসেই করে ফেলতে পারেন৷ একটা উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি এবারে তুলে ধরছি৷ অতীতে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের আশপাশ এলাকা থেকে অথবা খাগড়াছড়ি, বান্দরবন ইত্যাদি পাহাড়ী এলাকার বাস্তুভিটে ছেড়ে যখন চাকমারা দলে দলে, হাজারে হাজারে এপারে এসে ত্রিপুরায় আশ্রয় নিতেন, তাদের ক্ষেত্রে কোন্ তক্মাটা লাগানোর প্রয়োজন ছিল একটিবার অন্তত ভাবুন৷ মায়ানমার ছেড়ে রোহিঙ্গারা যে হাজারে হাজারে এসে বাংলাদেশে ভীড় জমিয়েছে তাদের বেলায় উপরের তক্মাটা মানানসই হয়ে উঠবে বলে ভাবতে পারছেন তো? শ্রীলঙ্কা ছেড়ে তামিলরা যখন ভারতে এসে পড়ে ও বসবাস করতে শুরু করে দেয়, তাদের বেলায় কোন তক্মাটি জুতসই হবে তাও জানার জন্যে মন আকু-পাকু করতে শুরু করে দিয়েছে৷ মিজোরামের প্রকৃত বাসিন্দা রিয়াংরা কয়েক হাজার গত ২০/২২ বছর ধরে উত্তর ত্রিপুরার ও উনকোটির বিভিন্ন ক্যাম্পগুলোতে খুঁটি গেড়ে বসে রয়েছেন৷ আমাদের বর্তমান রাজ্যসরকার কিংবা কেন্দ্রের সরকার বাহাদুর রিয়াংদেরে কী বলতে বলবেন? হ্যাঁ, আমার প্রশ্ণগুলোর অবতারণা করতে গিয়েই বেশ ভারী মাপের একটা ভুল হয়ে গেল বলে ক্ষমা মাগছি, কেননা মিজোরাম আর ত্রিপুরা দু’টোই ভারত-ভূখণ্ডের অন্তর্ভূক্ত৷ সুতারাং এক্ষেত্রে রিয়াংদের কোন মতেই ‘‘বিদেশী’’ বা ফরেনার বলা যাচ্ছে না৷ কিন্তু, যে রোহিঙ্গারা মায়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রিত তাদের কী বলা হবে? মিজোরামের রিয়াংরা ত্রিপুরায় ‘‘শরণার্থী’’ নামেই পরিচিত৷ পার্বত্য চট্টগ্রামের চাক্মারাও ত্রিপুরায়, অসমে, অরুণাচলকে ‘‘অনুপ্রবেশকারী’’ নামে চিহ্ণিত না হয়ে ‘‘শরণার্থী’’ বলেই পরিচিত৷ জানি না, শ্রীলঙ্কা থেকে আগত তামিলরা ভারতে শরণার্থী, না ‘‘অনুপ্রবেশকারী’’৷ নেপাল, সিকিম বা ভূটান থেকে আগত গোর্র্খরা ভারতে কি ভোটাধিকার পেয়ে গেছেন? তারা কী নামে ভারতে অভিহিত হচ্ছেন৷ তাদের জন্যে উত্তরবঙ্গ থেকে জমি দান করে গোর্র্খল্যাণ্ড বানাবার ফন্দি যারা এটেছিলেন, তারাই বা কী পরিচয়ে ভূ-ভারতে জনমানসে বিভূষিত হচ্ছেন? তা-ই যদি হবে, শুধুমাত্র বাঙালীদের কপালে কেনই বা ‘‘বিদেশী ’’ ‘‘বহিরাগত’’ ‘অনুপ্রবেশকারী’ ইত্যাদি অপমানজনক তক্মা লাগানো হবে? বাঙালীদের কী অপরাধ? ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে বাঙালীরা ছিলেন ব্রিটিশরাজ ও বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের দুষমন, এ্যানিমিক্যালে আর চোখের বালি৷ ঔপনিবেশিক, শোষক, লুটেরা, কায়েমী স্বার্থবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকরা তাদের কায়েমী স্বার্থরক্ষায় পথের কাঁটা বাঙালীকে জব্দ করতে তাদেরে হাতে ও ভাতে মারার চক্রান্ত করে গেছেন একের পর এক৷ ষড়যন্ত্র করেছেন দিবারাত্র অবিরাম গতিতে৷ আব, তারই পরিণামস্বরূপ বাংলাকে খণ্ডিত---বিখণ্ডিত হতে হয়েছে বার বার৷ বানরের পিঠে ভাগের মত করে ব্রিটিশ কু-চক্রীরা বাংলার খনিজ সমৃদ্ধ অঞ্চল বাংলা থেকে কেটে নিয়ে বিহারে ও উড়িষ্যায় জুড়ে দিয়েছিল৷ বিহারের সেই খনিজ সম্পদে ভরা অঞ্চল এখন ঝাড়খণ্ডকে শোভিত করে রেখেছে৷ বাংলার কৃষি সমৃদ্ধ অঞ্চল কেটে নিয়ে ব্রহ্মপুত্র উপতক্যা তথা আপার অসমকে বিলিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ বর্তমানের অসম ছিল মূলতঃ বাংলার মাটি৷ ব্রিটিশ-কুচক্রীরাই বাংলার পরিবর্তে ‘‘অসম’’ প্রদেশ গড়বার মুখ্য বাস্তবিকতায় হাত পাকিয়েছিল৷ অসম-রাজ্যের অহোম বা অসমিয়া আর বোড়োরা সবাইতো মঙ্গোলীয় গোষ্ঠীভুক্ত ও উঃ বার্র্ম থেকে আগত৷ তাই ভারতের মাটিতে ওরা বহিরাগত তো বটেই৷ ১৬৮৯ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বে একজন অসমিয়া ও ভারতে ছিল না৷ অসমের সাবেকি নাম ছিল প্রাগ জ্যোতিষপুর ও কামরূপ৷ আর, প্রথমে ব্রিটিশ শাসক অর্থাৎ শোষকদের কূটচক্রান্তে আজ হয়ে গেল ‘‘অসম’’ আর অহমিয়ারা মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত হওয়া সত্ত্বেও আর অসমিয়া ভাষাও তিববত-বর্মীয় গোষ্ঠীভূত হওয়া সত্ত্বেও আজ ওরাই হয়ে গেল ওই মাটির মূল বাসিন্দা৷ অসমের মাটি থেকে ওরাই তাড়াচ্ছে বাঙালীদের৷ বাঃ কী চমৎকার বলতে হচ্ছে, সত্যি সেলুকাস নয়, বললে ভাল হয় ভেড়ার পাল , কী বিচিত্র এই দেশ! তেমনতর বিচিত্র বলেই না, ভারতবর্ষ নাম পাল্টে গিয়েছিল ‘‘ইণ্ডিয়া’’, আবার হয়ে গিয়েছে ‘‘হিন্দুস্তাঁ হমারা’’৷
তো বলছিলুম এন.আর.সি জাতীয় নাগরিকপঞ্জীকরণের্ বিষয় নিয়ে৷ যতদূর জানি, এযাবৎ শুধু অসমেই এই জাতীয় নাগরিক পঞ্জীকরণ’ নামের আড়ালে ভারতের মাটিতে বাঙালী নির্যাতন ও ভারতের বুক থেকে বাঙালী বিতাড়ণের উদ্দেশ্যে ভারতেরই বাঙালী বিদ্বেষীরা তর্জন গর্জন করছেন, লাফালাফি ও দাপাদাপি বাড়াচ্ছেন৷ এতে যদি তারা ভেবেই থাকেন যে, বাঙালী নিরীহ জাতি বলেই হাজারো নৃশংস কামড় তারা মাথা পেতে নির্বিবাদে বসাতে পারেন৷ সেটি কিন্তু আগামী দিনে নাও ফলপ্রসূ হতে পারে৷ ভুল করেও কেউ ভুলে যাবেন না যে, বাঙালী বীরের জাত, ভীরুর নয়৷ ভুল করেও কারোর মনে বিন্দুমাত্র এ ধারণা পোষণ করবেন না যে, বাঙালীরা ব্যাঙেদের মতই৷ কখনও বাঙালীদের ব্যাঙের জাত বলে পরিচয় দিতে চাইবেন না৷ অনেকে নাক সিট্কে বলেই থাকেন, যে বাঙালীরা ব্যাঙেদের মতই কখনও এক পাল্লায় উঠবে না, তাই সুযোগটুকু পাওয়া মাত্রই যেমন সমস্যা মেটাতে বীরদর্পে সামনে না এসে অন্ধকার গলিতে কোন পোড়োবাড়ীতে কিন্তু জনমানবশূণ্য কোন প্রেতপুরীতে বসে আকন্ঠ সুরাপান করে লম্বা ঢেকুর তোলা ও সুযোগ পেলেই কিছু উপদেশ বর্ষিয়ে দিয়ে বিদায় নেওয়ার ব্যাপারে ওস্তাদির কার্পণ্য করে না৷ কিন্তু সেই উপেক্ষিত অবহেলিত বাঙালী একবার যদি জেগে ওঠে,তাহলে রক্তের শেষবিন্দু থাকা পর্যন্ত কিন্তু সে কিছুতেই থামবে না৷ অতীতে বার বার, কয়েকবার বাঙালীর এই আত্মত্যাগ, দুঃসহ কষ্ট স্বীকার, ত্যাগের মহিমা ও বীরত্বের প্রকাশ ঘটিয়ে বাঙালীরা সারা বিশ্বজুড়েই তোলপাড় সৃষ্টি করে দিয়েছে৷ ত্রিপুরায় একটি আঞ্চলিক উপজাতীয় সংস্থা দাবী তুলেছে ১৯৫১-কে ভিত্তিসাল ধরতে৷ বলাবাবহুল্য যে, বিগত ১৯৫১ সালেই ভারতে এন.আর.সি বা জাতীয় পঞ্জীকরণের কাজ শুরু করা যেত, যদি না, ভারত সরকারের প্রতিনিধিরা নেহেরুর আমল থেকে শুরু করে বর্তমানের অমিত-নরেন্দ্র-সোনয়ালের আমল পর্যন্ত নেতা-নেত্রী-কর্র্ত-কর্ত্রী থেকে শুরু করে, কয়েন ব্রান্ডেড ক্যাডাররাও জনসাধরণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতক না করে আস্থাভাজন হয়ে থাকতে পারতেন৷
হাতে ক্ষমতা পাবার পরই ভূতপর্ব প্রধানমন্ত্রী মায় অন্যান্যরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন---পূর্ব বাংলা থেকে সংখ্যালঘু অর্থাৎ বাঙালীরা ভারতে ‘‘যখনই’’ আসবেন তাদের গ্রহণ করা হবে৷ তারপরও ১৯৭১, ১৯৫১, ১৯৪৯ এইসব ভিত্তিসাল আসছে কোথা থেকে, কেনইবা? ভারতের সংবিধান মোতাবেক যে নাগরিকত্ব লাভের আইন রয়েছে সে সবকে এঁটো কলাপাতা বানানো হল কেন? দুস্কৃতিকারীদের নিয়ে ভোটপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যে প্রণীত চুক্তি দিয়ে আইনকে অমান্য করা হচ্ছে কেন? বিগত অসম-বিধানসভা নির্বাচনে যেসব প্রচার চালিয়ে ছিলেন রাজনাথ নরেন্দ্রবাবুরা তার মূল্য দিচ্ছেন না কেন আজ? তদুপরি বিদেশীর ভোটে জয়ীরা কোন অধিকারে মন্ত্রীত্ব করতে পারেন?
- Log in to post comments