গণতন্ত্রের বেনামীতে

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

আগামী ১১ই এপ্রিল থেকে ভারতের লোকসভার নির্বাচন শুরু হচ্ছে৷  সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছে নির্র্বচনে প্রার্থী হওয়ার তোড়জোড়৷ সঙ্গে সঙ্গে দল বদলের খেলাও৷ বিজেপি’র রাজ্য সভাপতি  দিলীপ  ঘোষ তো খোলাখুলি  সাংবাদিকদের কাছে বললেন, লোকসভায় জিতে  আসার মত যথেষ্ট অভিজ্ঞ  প্রার্থী তাঁর  দলে নেই, তাই দল বদল করে অভিজ্ঞ প্রার্থীদের  তিনি তাঁর  দলে আহ্বান  জানাচ্ছেন৷ সম্প্রতি ভাটপাড়ার  প্রাক্তন বিধায়ক অর্জুন সিং বিজেপিতে  যোগ দিলেন৷ আর বিজেপিও সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে তাঁদের  দলের সংসদের প্রার্থী ঘোষণা  করে দিয়েছে৷ ইতোপূর্বে তৃণমূলের ডাকসাইটে নেতা  যিনি নাকি  তৃণমূলকে নিজ হাতে গড়েছেন বলে দাবী করেন--- তিনি এখন বিজেপি’র এরাজ্যের অন্যতম কাণ্ডারী৷

শুধু বিজেপিতে নয় অধিকাংশ বড় বড় প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলির বড় রোগ হ’ল দল-বদল৷  দলের নামকে ভাঙ্গিয়ে ক্ষমতায় আসার  জন্যে কাড়াকাড়ি৷ আর চলচ্চিত্রে  বা খেলায়  বা এ ধরণের  বিভিন্ন  ক্ষেত্রে যারা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন, তাদের জনপ্রিয়তাটাকে কাজে লাগিয়ে  বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিজেদের  সাংসদ সংখ্যা বৃদ্ধিতেও অতিমাত্রায় অধীর হয়ে উঠেছেন৷ ব্যষ্টি অর্র্থৎ প্রার্থী ও বিভিন্ন  দল --- প্রায়  সবাই  চাইছে  যেন তেন প্রকারেণ  ক্ষমতা দখল৷ এখন গণতন্ত্রটা আসলে  ক্ষমতা দখলের একটা সহজ মাধ্যম৷ গণতন্ত্রের বিশাল ধবজ্জা উড়িয়ে যেমন করে হোক  ক্ষমতা দখল করতে হবে৷ আর ক্ষমতায় এসে যাওয়ার পর তুড়ি মারো গণতন্ত্রকে! স্বৈরতন্ত্রেই  পুরো আস্থা! আসলে সত্যিকারের গণতন্ত্র-প্রীতি --- বর্তমানে  একটি দলেরও বা স্বঘোষিত গণতন্ত্রের পূজারী একজনেরও আছে কি না সন্দেহ৷ সন্দেহ কেন? যথার্থ গণতন্ত্রপ্রীতিতো  কারুরই নেই! এটা কেবল লোকদেখানো বা লোককে শোণানোর জন্যে শ্লোগান মাত্র৷ ‘মুখে গণতন্ত্র আর বগলে ছুরি’! মুখে গণতন্ত্রের  বুলি, আসল প্রীতিটা স্বৈরতন্ত্রের  প্রতি বা রাজতন্ত্রের  প্রতি৷

মুখে জনগণের  সেবা আসলে আত্মসেবা৷ সহজে বিপুল পরিমাণ অর্থ, যশ ও পদ-লাভের  সোজা রাস্তা হল গণতন্ত্র৷ তাই এত গণতন্ত্র-প্রীতি৷ তা যদি  না হ’ত, তাহলে নির্বাচনী  প্রচারে  এত কাদা ছোঁড়াছুড়ি থেকে শুরু করে  সংঘর্ষ হয় কেন? নির্বাচনের সময় এত রক্তপাত হয় কেন? আসলে বর্তমানে প্রচলিত গণতন্ত্রটা হ’ল স্বৈরতন্ত্রের সোপান৷

তাই এখানে নীতির কোনো বালাই নেই৷ তাই দলবদলটা কোনো ব্যাপারই নয়৷ আসলে বর্তমান রাজনীতিতে দুর্নীতিটাই  নীতি৷ ‘চুরিবিদ্যা বড় বিদ্যা যদি না পড়ে  ধরা! ব্যাপারটা এইরকম৷ সুকৌশলে  চুরি বা ডাকাতি, যাতে সহজে পুলিশ না ধরতে পারে! নিজের দল ক্ষমতায় এলে তো --- চুরি আর চুরিই থাকবে না, ডাকাতিও আর ডাকাতি  থাকবে না৷ সততার নির্দশন হয়ে যাবে! তবে প্রতিপক্ষ দল ক্ষমতায় এলে কিছুটা ভেেয়র ব্যাপার আছে! কিন্তু তাতেও বাঁচবার যে রাস্তা নেই তাও নয়! তখনও রাস্তা আছে, তবে এসব জটিল অঙ্ক! কারণ, সব দলই তো একই রোগে কাবু!

প্রকৃতপক্ষে  জনপ্রতিনিধি  হওয়ার যোগ্যতা তাদেরই আছে যারা কঠোরভাবে ‘যম-নিয়মে’  অর্র্থৎ নৈতিকতায়  প্রতিষ্ঠিত, যারা নির্লোভ, সেবাব্রতী, যারা সমস্ত প্রকার অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামী৷ প্রাউট দর্শনে মহান্ দার্শনিক  শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁদের নাম দিয়েছেন ‘সদ্বিপ্র’৷ কঠোরভাবে ‘সদ্বিপ্র’ চরিত্রের মানুষ ছাড়া ‘জনপ্রতিনিধি’ হওয়ার যোগ্যতা আর কারুরই নেই৷

একটা প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতার দায়িত্ব পেতে   হলে তাকে একটা বিশেষ যোগ্যতা অর্জন করতে  হয়৷ তাহলে একজন বিধায়ক বা সাংসদ হতে হলে যোগ্যতা দেখা হবে না কেন?

দেশের কোটি কোটি  মানুষের সামাজিক  অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও উন্নয়নের দায়িত্ব  যাদের  হাতে থাকবে, তাঁরা স্বার্থপর ও আত্মসেবাতে  তৎপর হলে দেশের যথার্থ-কল্যাণ যে অসম্ভব তা  বুঝতে কোনও  কষ্ট হওয়ার কথা নয়৷ ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও ধোঁকা দিয়ে কেবল বত্তৃণতার ফুলঝুরি ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যায়, কিন্তু সত্যিকারের জনসেবা করা যায় না৷

যারা দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আইন প্রণয়ন করবেন, তাঁদের তো পর্যাপ্ত সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক জ্ঞান তথা আইন সংক্রান্ত জ্ঞানও থাকতে হবে! যাঁরা দুর্নীতিপরায়নের হাত থেকে  দেশের জনসাধারণকে বাঁচাবে তাদের তো কঠোরভাবে নীতিপরায়ণ হতেই হবে৷ এসব নাহলে তো পুরো গণতন্ত্রটাই প্রহসনে  পরিণত হবে!