একদিকে আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডাড়ের চেয়ারম্যান ক্রিষ্টলিনা জর্জিভা যেমন বলেছেন, আমেরিকা, চীন, জাপান, ব্রাজিল,ভারত সহ বিশ্বের উন্নত এবং উন্নয়ণশীল দেশগুলির অর্থনীতি ঝিমিয়ে পড়েছে, তেমনি রাষ্ট্রসংঘের বর্তমান মহাসচিবও বলেছেন, বিগত দশ বছরের তুলনায় ব্যাপক সংকটের মুখে পড়েছে রাষ্ট্রসংঘের অর্থব্যবস্থা৷ তা এমনই সংকটাপন্ন যে রাষ্ট্রসংঘকে প্রায় দশহাজার কর্মী ছেঁটে ফেলতে বাধ্য করছে৷ বিশ্বর্থনীতির এই চলচিত্রই বলে দিচ্ছে বর্তমান বিশ্ব চরম এক অর্থনৈতিক মন্দার দিকে ধাবিত! হচ্ছে কী হয়েইছে চরম এক অর্থনৈতিক মন্দা সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতিকে গ্রাস করেছে৷
একুশ শতকের নতুন অর্থনীতির জনক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বিগত অর্থনীতির গতি প্রকৃতি লক্ষ্য করে বলেছিলেন, স্বাভাবিকভাবে প্রতি ত্রিশ বছর পর পর বিশ্বে মহামন্দা বা গ্রেট ডিপ্রেসন দেখা দেয়৷ এই মহামন্দা বা গ্রেট ডিপ্রেসন সমগ্র বিশ্বকে প্রভাবিত করে৷ আর এর মাঝখানেও সাময়িকভাবে কখনো কখনো কোনো দেশে ছোটোখাটো মন্দা দেখা দেয়৷ সেই সব স্থানিক বা সাময়িক মন্দা সংশ্লিষ্ট দেশটির আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে৷ আবার তা কাটিয়েও ওঠে৷ এটা অনেকটা চাঁদে বা সূর্যে গ্রহণ লাগার মতো৷ ৷ গ্রহণ কেটে গেলে অন্ধকার যেমন দূর হয়ে যায়, তেমনি অর্থনৈতিক মন্দাও কেটে গেলে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ায় সমাজ রাষ্ট্র ৷ সমাজ অর্থনীতি আবারও প্রগতির পথ ধরে এগোতে থাকে৷ তবে মহামন্দা সমগ্র বিশ্বে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে ও মহামন্দার ফলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিশ্বের প্রতিটি দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷
ত্রিশ বছর পর পর যে মহামন্দা হয় সেই নিরিখে বিগত শতাব্দির ১৯০০খ্রিষ্টাব্দে, ১৯৩০খ্রিষ্টাব্দে , ১৯৮০খ্রিষ্টাব্দে, ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে ও খ্রিষ্টাব্দে সমগ্র পৃথিবীতে ব্যাপক অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছিল৷ আমেরিকার শেয়ারবাজারে ধস নামার পর ১৯৩০ এর যে মহামন্দা শুরু হয়েছিল, সেই মহামন্দা তো সমগ্র বিশ্ব অর্থনীতির ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল৷ অর্থনীতির ইতিহাসের নিরিখে ত্রিশ বছরেই এই হিসেবেই ২০১৯-২০ -এর মহামন্দা বা গ্রেট ডিপ্রেসন শুরু হয়েছে৷ এবারের এই মহামন্দা শুরু হয়েছে ভারতবর্ষ থেকে৷
স্থানিক মন্দার ফলে সংশ্লিষ্ট দেশে বা সেই দেশের সঙ্গে বানিজ্যিক সম্পর্কিত দেশগুলি প্রভাবিত হয়৷ মহামন্দা বা গ্রেট ডিপ্রেসনে সমগ্র বিশ্বের প্রতিটি দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ বিভিন্ন দেশের মধ্যে আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক পালা বদল ঘটে,
১৯১৪-১৯১৮ এর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অনেক কারণ অনেকে ব্যাখ্যা করেছেন৷ কিন্তু সে সেব কারণের নেপথ্যে মূলত ছিল এর অর্থনৈতিক মহামন্দার প্রভাব৷ সেই সময়ের সমাজ-অর্থনীতি বা রাজনীতি আজকের মতো দ্রুত গতিশীল ছিল না৷ ফলে উনিশের দশকের মহামন্দার ঢেউ সমগ্র বিশ্বকে প্রভাবিত করতে বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল৷ এর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ দশকের প্রথমে শুরু হওয়া মহামন্দার প্রভাব৷ যেমন অনেক অর্থনীতি বিদই বলেছেন, ১৯১৪-১৯১৮-এর অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব১৯৪১-১৯৪৪- এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ! এই দুটি অর্থনৈতিক মহামন্দার প্রভাব বিশ্ব রাজনীতির মানচিত্রে ব্যাপক বদল ঘটিয়ে দিয়েছিল৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবে প্রাচীন রাজতন্ত্র এবং সামন্ততন্ত্র ভেঙে শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে একদিকে যেমন পুঁজিবাদতন্ত্রের বিকাশ ঘটতে থাকে, অন্যদিকে সমাজতন্ত্রেরও উদ্ভব ঘটে যায়৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবে উপনিবেশ বাদ ভেঙ্গে নিজেদের স্বাধিকার, অধিকার ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে স্বাধীনতার পথে থাকে পরাধীন দেশগুলি৷ এ সবই অর্থনৈতিক মন্দা থেকে ঘুরে দাঁড়াবার উপায় বা উত্তরণ৷ সমাজ অর্থনীতি এভাবেই উহ অবহের পথ ধরে এগোতে থাকে৷
এর অর্থনৈতিক মহামন্দার প্রভাবের সময় সমগ্র বিশ্ব যান্ত্রিকভাবে ব্যাপক উন্নতির সোপান স্পর্শ করলেও মন্দার ঢেউ কাটাতে পারেনি৷ মন্দার প্রভাবও কাটাতে পারেননি৷ এর অর্থনৈতিক মহামন্দার প্রভাবেও বিশ্ব রাজনীতি, মানচিত্রের বদল ঘটে৷ একদিকে সাম্যবাদী ভাবনার সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়, অন্যদিকে পুঁজিবাদী শক্তি একচ্ছত্র অধিপত্ত বিস্তার করতে থাকে৷ সেই সঙ্গে যোগ হয় ধর্মের নামে ধর্মমতগুলির বাড়াবাড়ি৷
উনিশের শূন্য দশকের, ত্রিশের দশকের,ষাটের দশকের অর্থনৈতিক মহামন্দা নিয়ে অর্থনৈতিক ভাবে খুব বেশি হৈচৈ হয়নি৷ সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোর বদলটা ব্যাপকভাবে চোখে পড়েছে৷ নববই দশকের অর্থনৈতিক মহামন্দার প্রভাবে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো ভেঙে যাওয়ায় রাজনৈতিক তোলপাড় তো ছিলই অর্থনৈতিকভাবেও ব্যাপক আলোড়ন ফেলেছিল৷ অর্থনৈতিক প্রভাব এতটাই আলোড়ন ফেলেছিল যে, সেই সময় আমেরিকার ডালাস ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক ডক্টর রবি বাট্রার ‘‘দি গ্রেট ডিপ্রেসন অফ নাইনটিন’’ নামক গ্রন্থটি শুধু বিখ্যাতই হয়নি তাঁর লেখা সেই বইটি সেই সময় বিশ্ব অর্থনীতির বই বিক্রির তাকায় বেস্ট সেলার হয়েছিল৷ ওই গ্রন্থটির মূল প্রেরণা ছিল শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের নতুন অর্থনৈতিক দর্শন দিশার প্রভাব৷ উল্লেখ্য শ্রী সরকার ষাটের দশকে তাঁর নোতুন অর্থনৈতিক দর্শন ‘প্রগতিশীল’ উপযোগ তত্ত্ব’- এর আলোচনার সময় উক্ত বিষয়গুলি সম্পর্কে ইঙ্গিত করেছিলেন৷
১৯৯০-এর অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে বৃহৎ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে জন্ম নেয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের৷ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্টগুলির ওপরে প্রভাব বাড়তে থাকে পুঁজিবাদী শাসক শোষকদের ও ক্রমান্বয়ে পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন আজ বিশ্বের সকল রাষ্ট্রে নিয়ামক সংস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি পুঁজিবাদ কোনো একক রাষ্ট্রশক্তি নয় পুঁজিবাদ একটি ছায়া সংঘটন৷ যার প্রভাব সবদেশে, সব রাষ্ট্রে৷ বর্তমান বিশ্বে কবে, কখন, কাকে কোন্ দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসানো হবে তা স্থির করেন তাঁরাই৷ সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক ভোটাধিকার তাঁদের যান্ত্রিক প্রচারের কৌশলের কাছে প্রহসনে পরিণত হয়! রাষ্ট্র প্রধান নির্বাচিত হন তাঁদেরই মনোপুত ব্যষ্টি৷ তা সেই রাষ্ট্রপ্রধান রাজনৈতিক ব্যষ্টি হোন, চাই না হোন৷ তার প্রমান আমরা পেয়েছি বিগত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে৷ বিশ্ব রাজনীতির এক প্রভাবশালী নেত্রী হিলারি ক্লিনটনকে হারিয়ে দিয়ে কীভাবে রেসলিং জগতের একরোখা ডোনাল্ড ট্রামকে আমেরিকার ক্ষমতায় বসানো হলো৷ লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির জয়ও একই উদাহরণ৷ এর ইঙ্গিত আমরা পেয়েছিলাম খ্রিষ্টাব্দে গুজরাটের সানন্দায় অনুষ্ঠিত এক বণিক সভায় অনিল আম্বানির বক্তব্যে৷ অনেকেরই মনে আছে সেখানে অনিল আম্বানী বলেছিলেন, আগামী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবার যোগ্যতম ব্যষ্টি নরেন্দ্র মোদি৷ নরেন্দ্রমোদী তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী৷ জাতীয় রাজনৈতিক চরিত্রে তিনি গুজরাট দাঙ্গার খলনায়ক৷ আমেরিকায় ভিসা পাবার অযোগ্য৷ অথচ পুঁজিবাদী অনিল আম্বানির বলা ২০০৯ - এর কথারই প্রতিফলন ঘটল ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের লোকসভা নির্বাচনে৷ পুঁজিবাদীদের প্রচারযন্ত্রের আলোয় বাবা মসজিদ-রামজন্মভূমি সৌধ ধবংসের বিজেপির প্রধানমন্ত্রীর মুখ নরেন্দ্র মোদি , গুজরাট দাঙ্গার খলনায়ক নরেন্দ্র মোদি হয়ে গেলেন ডিজিটাল ভারতের নব প্রজন্মের ত্রাতা৷ প্রচার করা হলো বিবেকানন্দ সঙ্গে তুলনা৷ ডিজিটাল ভারতের ত্রাতা ক্ষমতায় এসে দেশের যুবকদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করুন আর নাই করুন, অনিল আম্বানির মতো পুঁজিপতিদের ডিজিটাল ব্যবসার সুবিধার পাশাপাশি সাধারণের হাতে এমন সব ডিজিটাল খেলনা তুলে দিয়েছে৷ সেই খেলার দর্পণে ভেসে নরেন্দ্র মোদি ২০১৯ এর নির্বাচনী বৈতরনী খুব সহজেই পাড় হতে পেরেছেন৷ এরকম উদাহরণ প্রচুর আছে৷ আর এ সবই ওই কর্পোরেট পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক শোষণের ছলাকলা৷ আজকের অর্থনৈতিক মন্দা সেই নিরিখেই বিচার্য হওয়া উচিত৷ নইলে আজকের অর্থনৈতিক মন্দার প্রকৃত কারণ বিশ্লেষণ করে তার থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে না৷
(ক্রমশঃ)
- Log in to post comments