গ্রেট ডিপ্রেসনের পথে ভারতসহ সমগ্র বিশ্ব

লেখক
সুকুমার সরকার

পূর্ব প্রকাশিতের পর

বর্তমান বিশ্বে এই যে এত সমস্যার  ঢেউ আছড়ে পড়ছে  তার প্রধান কারণ এই গ্রেট ডিপ্রেসনের প্রভাব৷ আমেরিকা, কানাডা, চীন, জাপান, জার্র্মন  অষ্ট্রেলিয়া , ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স, ব্রাজিল, ভারত প্রভৃতি দেশে বানিজ্যিক সূচক যেভাবে ওঠানামা করছে  ও  আলটিমেট গতি যেভাবে নিম্নমুখী হচ্ছে তার কারণ বিশ্লেষনে অর্থনৈতিক মহামন্দার দোরগোড়াতেই পৌঁছাতে হবে৷ আজ বিজ্ঞানের  উন্নতির  সঙ্গে যোগ  হয়েছে স্যাটেলাইট প্রযুক্তি৷ আজকের সমাজ-অর্থনীতির যে কোনো প্রভাব  দ্রুত সমগ্র বিশ্বে  যেমন ছড়িয়ে যায় তেমনি দ্রুত প্রভাবিতও করে৷  আজ সমগ্র বিশ্বজুড়ে যে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক  অস্থিরতা চলছে , তার মূলে আছে এই মহামন্দার  প্রভাব৷ বিভিন্ন দেশের  স্থানিক মন্দাকে  V, W, U যদি অক্ষর-পদ্ধতির  সঙ্গে তুলনা করি, তবে মহামন্দাকে তুলনা করতে হবে‘L’ অক্ষরের সঙ্গে৷ অর্থনীতির  ব্যাখ্যায় V,W, মন্দায় অর্থনৈতিক  গতি  (G.D.P) নিচের দিকে  নেমে আবার ওপরে উঠে যায়৷ মন্দার V.W ক্ষেত্রে তা যত দ্রুত ওপরে উঠে মহামন্দার ক্ষেত্রে তত দ্রুত ওঠে না৷ মন্দা কিছুটা সময় চলে তারপর ওপরের দিকে ওঠে৷ কিন্তু মহামন্দা বা গ্রেট ডিপ্রেসনের প্রভাব L-এর মতো নেমে গিয়ে নিচের দিকে চলতে থাকে৷

মন্দা কোনও স্থায়ী বিষয় নয়৷ প্রধানতঃ অর্থের সচলতা বাধাপ্রাপ্ত হওয়া , অর্থ কুক্ষিগত হওয়া, ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া, শিল্প উৎপাদন কমে যাওয়া শেয়ার বাজার নিম্নমুখী হওয়া প্রভৃতি বিষয়গুলির  সামবায়িক রূপই হ’ল মন্দা৷

সমাজ প্রগতির লক্ষ্মণ সংকোচ বিকাশী ধারায় হলেও অর্থনৈতিক মন্দা এক ধরণের পতন৷ পতন থেকে ঘুরে দাঁড়ানোটাই মন্দার হাত থেকে বাঁচা৷ আজকের বিশ্বে একদিকে যেমন মহামন্দা দেখা দিয়েছে, আবার সমগ্র বিশ্বে যোগ্য নেতৃত্বেরও অভাব দেখা দিয়েছে৷  বিভিন্ন দেশে আজ যে মহামন্দার রূপ নিয়েছে, তার পেছনে নেতৃত্বের অভাব একটা বড় কারণ৷ বলা যেতে পারে দু’টো একে অপরের পরিপূরক৷ সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ে যে ছিনিমিনি খেলা চলে সেটাও মন্দার একটি কারণ৷ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সামাজিক অবক্ষয়ে পুঁজিপতিরা পুঁজির বিনিয়োগে লাগাম পরায়, অর্থের গতি রুদ্ধ করে অর্থ কুক্ষিগত করে রাখে৷ এটাও মন্দার একটি কারণ৷

এর আগে মহামন্দায় ভারতের অর্থনীতি প্রভাবিত হলেও ধবসে যায়নি৷ ধবসে না যাওয়ার কারণ তখনও ভারতের অর্থনীতি দাঁড়িয়েছিল ক্ষুদ্র কুটির শিল্প ও মাঝারি শিল্পের ওপর৷ বিশেষ করে বস্ত্র শিল্পের ওপর৷ এবারের মহামন্দার উৎপত্তি এমন একটা সময় যখন ভারতের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রায় ধবংসের মুখে, বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পের উৎপাদন নিম্নমুখী৷ গাড়ী, বাড়ী ব্যাঙ্ক চাকরী প্রভৃতি ক্ষেত্রে জিডিপি তলানীতে এসে দাঁড়িয়েছে৷ এই নিম্নমুখী পূর্বাভাসই বলে দিচ্ছে ভারতে মহামন্দার কথা৷

জনসংখ্যার নিরিখে চীনের পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ ভারত৷ পণ্য উৎপাদনে চীন ও অন্যান্য বহু দেশ থেকে পিছিয়ে থাকায় ভারত অনেক রাষ্ট্রের রপ্তানি বাজার৷ ফলে ভারতে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা সংশ্লিষ্ট সব দেশকে প্রভাহিত করে মহামন্দার রূপ ধারণ করবে৷ অর্থনীতিবিদরা এমনটাই মনে করছেন৷

আজ ভারতবর্ষ চরম এক নেতৃত্বের সংকটে ভুগছে৷ শুধু ভারত নয়, গোটা বিশ্বেই আজ উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাব৷ ডোনাল্ড ট্রাম্প, বরিস জনসন, নরেন্দ্র মোদী, অমিত শা-র মত লোকেরা আমেরিকা, ইংলণ্ড ভারতবর্ষে রাষ্ট্রপ্রধানের আসনে বসছেন৷ যোগ্য নেতৃত্বের কতবড় অভাব হলে এই সব লোকেরা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে৷ শুধু নেতৃত্বের অভাবই নয়, জনগণের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চেতনার অভাবও এই ধরণের লোকেদের রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসতে সাহায্য করে৷

ভারতবর্ষ আজ নেতৃত্বের চরম সংকটে ভুগছে৷ কংগ্রেস নামক দলটির হাল ধরার মত উপযুক্ত নেতা নেই৷ জনগণের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক চেতনার অভাবকে মূলধন করে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ক্ষমতার শীর্ষে বসেছে৷ নেতা-মন্ত্রীরা এমন সব উদ্ভট কথাবার্তা বলে তাতেই তাদের জ্ঞানের বহর প্রকাশ হয়ে পড়ে৷ শিক্ষিত সচেতন মানুষ আজ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত৷ কাদের হাতে রাষ্ট্রের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হ’ল!

পুরাণ, ইতিহাস, জ্ঞান-বিজ্ঞানে যে দেশ একদিন বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে অনেক এগিয়েছিল সেই দেশের নেতা-মন্ত্রীরা আজ অহরহ অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক, আল-ফাল বকে চলেছে৷ যাতে একজন ভারতবাসী হিসেবে বিশ্বের কাছে মাথা নত হয়ে যায়৷ দেশের হাজারো আর্থ-সামাজিক সমস্যা আছে৷ সেসব সমস্যা সমাধানের কোনও বাস্তবোচিত পরিকল্পনা নেই৷ কৃষি-শিল্পের দ্বন্দ্বে কৃষি ও শিল্প শ্রমিকরা জর্জরিত৷ অথচ সরকারের হাতে কোনও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই এই সমস্যার সমাধান করার৷ কৃষিকে বাঁচিয়ে শিল্প করার কোন পরিকল্পনাই সরকারের নেই৷ হয়তো সরকারের জানাও নেই এই ধরণের পরিকল্পনা করা যায় কি না৷ লক্ষ লক্ষ বেকার ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে৷ সরকারী সংস্থাগুলোও এক এক করে বে-সরকারীকরণ করে দেওয়া হচ্ছে৷ তাতে  নেতামন্ত্রীদের বিলাস বহুল জীবনে কোন ছেদ পড়েনি৷ কলকারখানা না গড়ে হাজার হাজার কোটি টাকায় মূর্ত্তি গড়া হচ্ছে৷ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের দিকে নজর না দিয়ে অশ্লীল-অসংস্কৃতির বন্যায় দেশ তথা যুব সমাজকে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ লক্ষ কোটি টাকা খরচ করে নিজেদের নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করছেন৷ অথচ মানুষকে মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার নূন্যতম চাহিদারও যোগান দিতে পারছে না৷

সমগ্র বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা ধেয়ে আসছে৷ ভারতবর্ষও রেহাই পাবে না৷ মন্দা ঠেকাবার মতো অর্থনৈতিক ভিত্তি কতটা মজবুত এই মহূর্ত্তে সে নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করার সময় নেতা-মন্ত্রীদের নেই৷ তারা ৩৭০ ধারা, অযোধ্যা নিয়েই মশগুল৷

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আপদকালীন ফাণ্ড থেকে টাকা তুলে অর্থের নয়ছয় করা হচ্ছে৷ অথচ  এই অবস্থায় মন্দার থেকে বাঁচার কোন পদক্ষেপ সরকারের মগজে নেই৷ এ-হেন পরিস্থিতিতে মন্দা তো মহামন্দার রূপ নেবেই ও তা হবে ‘এল’ টাইপের মন্দা অর্থাৎ নিম্নগামী হয়ে দীর্ঘ পতনের দিকে এগিয়ে চলবে৷ উত্তরণ খুব সহজে ঘটবে না৷

পুঁজিবাদী ও সাম্যবাদী দুটো অর্থনীতিই দিশাহীন অর্থ ব্যবস্থা৷ কারণ দুটো ক্ষেত্রেই কাজ করছে শাসন ও শোষণের মানসিকতা৷ এখানে শাসক ও শোষক মিলেমিশে এক হয়ে আছে৷ শোষকের উদ্দেশ্য শোষণের যন্ত্রকে টিঁকিয়ে রাখা৷ শাসকের উদ্দেশ্য ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা৷ ফলে দুই অশুভ শক্তি এক হয়েছে৷ এরই প্রভাবে মন্দা মহামন্দার রূপ ধারণ করবে ও দীর্ঘস্থায়ী হবে৷    (ক্রমশ)