আজকের আলোচনায় যে দু’টো বিষয় নেওয়া হবে–‘‘গুহা ও সৎসঙ্গ’’–প্রথমে পৃথকভাবে ও পরবর্তী স্তরে একসঙ্গে এদের পর্যালোচনা করা হবে৷ গুহা শব্দটির দু’টি অর্থ৷ প্রথম ব্যাখ্যা সংস্কৃত থেকে ইংরেজী করলে দাঁড়ায় ‘‘cave wherein God resides’’৷ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের যোগীরা এই ব্যাখ্যাকে খুব বেশী আক্ষরিক অর্থে নিয়ে থাকে, ভাবে যে পরমচৈতন্যের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার একমাত্র উপায় সমাজ থেকে বিমুখ হয়ে গুহার মধ্যে দিন কাটানো৷ সবকিছুই যদি পরমপুরুষেরই অংশ হয় তাহলে এই সমাজও তো তাই তাঁর একাংশকে অস্বীকার করা মানে তাঁকেই পুরোপুরি অস্বীকার করা৷ এইভাবে যাঁকে অস্বীকার করছি, তাঁকেই লাভ করার প্রয়াস একটি অস্বাভাবিক ব্যাপার৷ তাই জগতকে বাদ দিয়ে তাঁকে পাওয়ার যে–কোনো প্রচেষ্টাই মূর্খামি ছাড়া কিছুই নয়৷
কেউ কেউ পুরনো যুগের যুক্তি দেখিয়ে বলতে পারেন যে, সমাজ এত বেশী বস্তুকেন্দ্রিক যে এখানে আমাদের মনকে বিক্ষিপ্ত করার জন্যে নানান বস্তু বা বিষয় রয়েছে৷ আর এইসব থেকে দূরে একান্তে থেকে বিরাটের মনন করা বেশী সহজসাধ্য৷ এটিও আর একটি ত্রুটিপূর্ণ ধারণা৷ এর কারণ হচ্ছে এই যে, মন সামাজিক অস্থিরতার মধ্যে থাকবেই কারণ তাঁকে মনন করার জন্যে যে গুহার নির্জনতাকে অপেক্ষাকৃত সূক্ষ্মতর প্রয়াস বলে মনে করেছিল, তার সেই মনই নিজে থেকে ছেড়ে–আসা জীবন ও জগতের প্রতি একটি প্রসূপ্ত আকর্ষণ কোনো সময় জেগে ওঠার একটা বিপজ্জনক সম্ভাবনাকে বজায় রেখে দিল৷ আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে যে, পরমপুরুষ যখন চাইবেন আমরা তাঁকে লাভ করি, তখনই কেবল আমরা তাঁকে পাব৷ আর তবে উপযুক্ত প্রস্তুতি আমাদের আছে কি না সেই জন্যে তিনি কী দেখেন তিনি দেখেন আমরা আমাদের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে সত্যিই তাঁকে ভালবাসি কিনা! জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তিনি আমাদের পরীক্ষা করেন আমরা ভক্তির সেই স্তরে পৌঁছেছি কিনা অথবা এখনও আমাদের মনে পার্থিব আসক্তি রয়ে গেছে, যা তাঁর কাছ থেকে মনকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে৷
‘গুহা’ শব্দের দ্বিতীয় অর্থ ‘‘I am’’. অর্থাৎ ‘আমি আছি’ ৰোধ৷ পরমাত্মা তোমার হূদয়ের গুহায় বসে আছেন, তোমার নিজের ‘আমিত্বে’ মধ্যে রয়েছেন৷ এই ভাবনাই তো সবকিছুকে অতি সহজ করে দেয়! গভীর সাধনার দ্বারা আমাদের নিজেদের জানতে হবে আর নিঃস্বার্থ সেবার দ্বারা তাঁর অভিপ্রকাশগুলির অন্তরের ব্যথাকে ৰুঝতে হবে৷ তখন তাঁর প্রতি আমাদের সত্যিকারের অগাধ ভালবাসা জেগে উঠবে৷ ভক্তির এই গভীরতা দেখে পরমপুরুষ তখন আমাদের অবশ্যই নিজের মধ্যে নিয়ে নেবেন–তখনই আমাদের সফলতা সুনিশ্চিত হবে৷
হ্যাঁ, ‘‘সৎসঙ্গ’’ বলে একটি কথা আছে, আমি এখন সেই প্রসঙ্গে আসছি৷ ‘সৎ’ মানে ‘‘সত্য’’–অর্থাৎ যা অপরিবর্তনীয়, পরম৷ তিনিই কেবল অপরিবর্তনীয়, তাই তিনিই কেবল সত্য৷ ‘‘সঙ্গ’’ মানে ‘‘company’’৷ তাই ‘‘সৎসঙ্গ’’ মানে ‘‘পরমপুরুষের সঙ্গ’’৷ কিন্তু এখানে একটা দ্বিতীয় অর্থও আছে৷ ‘সৎসঙ্গ’ শব্দটি অন্তর্নিহিত অর্থ ও দ্বিতীয়টি বাহ্যিক৷ আগে যা বললুম, আন্তরিক সৎসঙ্গ হ’ল পরমপুরুষের প্রতি আমাদের ভক্তি বাড়ানো, আর আন্তরিকতার সঙ্গে সাধনা করলেই এই অবস্থা আসে–এটি শাশ্বত সৎসঙ্গ৷ কিন্তু বাহ্যিক সৎসঙ্গ আমাদের খুঁজে বের করতে হবে, আমাদের যেমন উপযুক্ত সঙ্গ দরকার তা সযত্নে বেছে নিতে হবে৷ যারা সমাজের মধ্যে থেকে শাশ্বত সৎসঙ্গের খোঁজে যারা নিরত রয়েছে, তাদের সঙ্গ৷ তোমার নিজের সাধনাতে গতি এনে দেবে৷ অবশ্য এসম্পর্কে তোমার নিজের ধারণাটাই বেশী গুরুত্বপূর্ণ৷ ‘‘পকেটমার যখন একজন সাধুকে দেখে, সে কেবল সাধুর পকেটটাই দেখে৷’’ অবশ্য নিজের আন্তরিক এষণা আর বাহ্যিকভাবে (আধ্যত্মকে মানুষদের সঙ্গ) এর সঙ্গে পরমপুরুষের নিজের সৃষ্টির প্রতি যে এক স্বাভাবিক আকর্ষণ আছে, সাধকের এই ভাবনা, নিঃসন্দেহে সকলকে আত্মোপলব্ধির পথে নিয়ে যাবে৷ তখনই আমাদের বলা হবে ‘গুহান্’–অর্থাৎ যে অন্তরের গুহায় বাস করছে–ঈশ্বরের গুহায় বাস করছে৷ তাই সৎ মানুষ, যে সত্যিকারের সৎসঙ্গ পেয়েছে, সে তাঁকেও পেয়ে গেছে৷ এই কথাটি অন্যের কাছে প্রকাশ না করলেই ভাল৷