ইজম্ (মতবাদ) কথাটার অর্থ কী যখন জাগতিক ও মানসিক ক্ষেত্রে ঙ্মকোনো বিষয়কে নিয়েৰ দেশ–কাল–পাত্রের মধ্যে সমান্তরলতা স্থাপিত হয় তখনই ইজমের জন্ম হয়৷ এই সমান্তরলতা না থাকার কারণে কোনো দেশ বা কোনো জনগোষ্ঠীর কাছে একটি নির্দিষ্ট ইজম্ অনুকূল হলেও তা সর্বকালে সব মানুষের কাছে গ্রহণীয় হয় না৷
এই বিশ্বে কোন কিছুই স্থির নয়, সব কিছুই চলছে, এগিয়ে চলেছে৷ নির্দিষ্ট দেশ–কাল–পাত্রের পরিভূতে বিভিন্ন পরিবর্ত্তনশীল তত্ত্বসমূহের মধ্যে কোন একটি তত্ত্ব আমাদের কাছে সত্য বলে প্রতীয়মান হয়৷ আপেক্ষিকতার স্বভাবযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও আমরা এই ধরনের তত্ত্বকে সত্য বলে মনে করি৷ জড়–জাগতিক ক্ষেত্রে গতি ও অগতি দু’টিই ভূমা মনের সৃষ্টির এষণা–সঞ্জাত, যদিও পরিদৃশ্যমান বিশ্বে চরম অগতি বা স্থিরতা বলে কোনো কিছুই থাকতে পারে না৷ যদি স্থির বা গতিহীন বলে কিছু থাকে মনে করি তবে তার অর্থ হবে ভূমামনের কল্পনাধারার গতিরোধ হওয়া –– যা সৃষ্টির মূলতত্ত্বের বিরোধী৷ সেক্ষেত্রে সেটাই হবে চরম অগতির অবস্থা –– যা অসম্ভব৷ সব কিছুর মধ্যেই গতিশীলতা রয়েছে ও তা বহুধাপ্রবাহিত৷ গতি যে কোনো দিকেই প্রধাবিত হতে পারে, ভূমা মনের ইচ্ছায় এই বিশ্ব যে কোনো দিকে সম্প্রসারিত হতে পারে, কিন্তু কোনো অবস্থাতেই ভূমা মনের কল্পনাধারা স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে না, কেননা ভূমা মনে স্থির বলে কিছু নেই৷
গতি সর্বদাই দেশ–কাল–পাত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত৷ তাই কোন বিশেষ দেশ–কাল–পাত্রের পরিধিতে উদ্ভূত যে গতি তা অন্য দেশ–কাল–পাত্রের গতিশীলতার সঙ্গে সম্পূর্ণ এক হতে পারে না৷ কোন বিশেষ স্থানে ও কালে, বিশেষ আধারে সৃষ্ট গতি যখন নির্দিষ্ট জাগতিক–মানসিক তরঙ্গের সঙ্গে সমান্তরাল হয়ে যায় তখনই ইজমের জন্ম হয়৷ তাই যে বিশেষ দেশ–কাল–পাত্রের পরিধিতে একটি ইজম্ স্বীকৃত হয়েছিল তা যদি পরিবর্ত্তিত হয়ে যায় তবে সংশ্লিষ্ট জাগতিক অথবা মানসিক তরঙ্গ বা দুই–এরই পরিবর্ত্তনের দরুণ সেই ইজম্ তার যথার্থতা হারিয়ে ফেলে৷ যে বিশেষ মানসিক অবস্থায় একটা ইজম্ গ্রহণীয় হয়, তৎসংক্রান্ত জাগতিক অবস্থা পরিবর্ত্তিত হয়ে গেলে মানসিক তরঙ্গ আর তার সঙ্গে সমান্তরলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয় না৷ ফলস্বরূপ, সেই নির্দিষ্ট ইজম্ বাতিল বলে’ গণ্য হয়৷ দু’হাজার বছরের পুরোনো কোন রাজনৈতিক–র্থনৈতি তত্ত্ব বা ধর্মীয় সম্প্রদায়গত মতবাদ (বা অতীতের বিশেষ দেশ–কাল–পাত্রের ভিত্তিতে সৃষ্ট ইজম্ বা তত্ত্ব) যদি কেউ পুনঃ প্রতিষ্ঠা করতে চায় তাহলে তা নিয়ে যত রকমের সেণ্টিমেণ্ট, মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি বা প্রচারের যত সূক্ষ্ম কলা কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হোক না কেন, বর্ত্তমানের জাগতিক অবস্থার সঙ্গে সেটা আর কোনমতেই নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারবে না৷
পুরোনো কালের মানসিক পরিবেশ যদি কোনভাবে ফিরিয়ে আনা যায়ও তবুও ইজম্ তথা জাগতিক তরঙ্গের মধ্যে সমান্তরলতা আর পুনঃস্থাপিত হতে পারবে না৷ আবার শুধু জাগতিক তরঙ্গই বলি কেন, আমরা দেখি যে মানসিক তরঙ্গও পরিবর্ত্তিত হয়ে যায়৷ ফলে যত বিজ্ঞানসম্মত প্রয়াসই হোক না কেন, অতীতের মানসিক তরঙ্গকে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব৷ একটা সময় ছিল যখন রাজা ঈশ্বর হিসেবে পূজিত হতেন৷ কিন্তু আজকের দিনে সেই বস্তা–পচা তত্ত্ব কেউ যদি পুনঃ প্রবর্ত্তন করতে চায় তাহলে সে উন্নত মানসিক পদ্ধতির সাহায্যে তা নিয়ে হাজার প্রচার করলেও মানুষ তা কখনই মেনে নেবে না৷
যে কোন গতি বিকশিত হয় ঙ্মসংকোচ–বিকাশাত্ম তরঙ্গের মাধ্যমে৷ একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে কোন একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গকে যদি অত্যধিক বাড়িয়ে দেওয়া হয় যার ফলে তদ্পরবর্ত্তী আরোহণ স্তর ন্তুব্জন্দ্বব্দব্ধগ্গ আর প্রায় অনুভূত হয় না, তাহলে আমরা দ্রুত সঙ্কোচ–বিকাশমুখী গতিধারা ঙ্মযাতে বক্রতা বেশীৰ পাই৷ মানসিক বা জাগতিক তরঙ্গের গতিকে যদি সত্যিকারের বাড়াতে হয় তাহলে প্রয়োজন হচ্ছে তাকে সরলরেখাকার অবস্থায় নিয়ে আসা৷ কিন্তু যদি এই সরলরেখাভিমুখী গতি (straightness of movement) তার চরম সীমায় পৌঁছে যায় তাহলে সেটাও এক ধরনের অগতিরই নামান্তর৷ যাই হোক, সঙ্কোচ–বিকাশাত্মক গতিতে দ্রুতি (velocity or acceleration) কীভাবে কতখানি বাড়ানো যায় তা নির্ভর করে তরঙ্গের বক্রতার (curvature) ওপর যার ভিত্তিতে আমরা গতিধারার speed-pause তারতম্য বা সরলরৈখিক অবস্থানকে নির্ধারণ করতে পারি৷
দেখা যাবে তারঙ্গিক বক্রতার তারতম্য অনুযায়ী ঙ্মসঙ্কোচন–প্রসার সংখ্যাৰ গতিবেগ speed বিপরীতভাবে পরিবর্ত্তিত হয়৷ অর্থাৎ যখন গতিবেগ বাড়ে contraction বা সঙ্কোচন তথা বক্রতা বাড়েৰ, দ্রুতি অর্থাৎ velocity কমে যায়, কিন্তু বক্রতা হ্রাস প্রাপ্ত হয়ে গতিধারা যত সরলরৈখিক হয় তত তাতে দ্রুতি বেড়ে যায়৷ তাই মানসিক তরঙ্গের দ্রুতির অবস্থায় ইজম্ বা কুসংস্কার বাসা ৰাঁধতে পারে না৷ বরং মানস–সংবেগের সঙ্কোচনের অবস্থাতেই এই ইজম্ বা কুসংস্কার অনুপ্রবিষ্ট হয়৷ কোন স্থিতাবস্থাকে আঁকড়ে থাকা খুবই সহজ কিন্তু যেখানে গতির অস্তিত্ব আছে সেখানে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অন্য রকম৷ তাই কুসংস্কারের ৰন্ধন থেকে মুক্ত হতে গেলে মানুষকে অনবরত এগিয়ে চলতে হবে, না হলে প্রগতি সম্ভব হবে না৷ এই জন্যে উচিত হচ্ছে মনের গতিবেগ (দ্রুতি) নিরন্তর বাড়িয়ে চলা৷
সাধারণতঃ দেখা যায় যে শহরের মানুষদের তুলনামূলক ভাবে বেশী মানসিক সংঘর্ষের সম্মুখীন হতে হয় বলে তাদের মধ্যে হয় কুসংস্কার একেবারেই থাকে না বা অন্যদের থেকে কম থাকে৷ তাই তারা ৰৌদ্ধিক দিক থেকে অধিক সজাগ৷ যেখানে গতিহীনতা সেখানে কুসংস্কার মনের গভীরে ঢুকে যায়, কিন্তু যারা বিজ্ঞানমনস্ক তাদের মনে কুসংস্কারের সূচীকাভরণ করে’ দেওয়া খুবই কঠিন কাজ৷ এর কারণ হচ্ছে তারা জীবনে অধিকতর দ্রুতি নিয়ে এগিয়ে চলেছে৷
গতির সঙ্কোচাত্মক (contraction) আর বিকাশাত্মক (expansion) অবস্থার মধ্যে সত্ত্ব–রজ–তম এই ত্রিগুণাত্মিকা শক্তি সমভাবে ক্রিয়াশীল৷ তরঙ্গের উহাভিমুখী গতি (ascent) রজ প্রধান৷ আর অবোহ (descent) তম প্রধান৷ বিকাশাত্মক ও সঙ্কোচাত্মক অবস্থার সর্বোচ্চ স্তর যথাক্রমে সত্ত্ব ও তমগুণ প্রধান৷ উহ–বোহের এই দুই শীর্ষাবস্থায় ফলশ্রুতি কিন্তু একই৷ বস্তুতঃ সত্ত্বপ্রধান বিরামাবস্থা (sentient pause) কোন বিরতিই নয়৷ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার বাইরে থাকার জন্যে এখানে চরমগতি বিরতি বলে প্রতীয়মান হয়৷ বিকাশাত্মক গতি সাত্ত্বিকতার পথে অগ্রসর হওয়ার পক্ষে সবচেয়ে অনুকূল৷ তাই এটি বিদ্যাশক্তি (knowledge) দ্বারা প্রভাবিত৷ অনুরূপভাবে সঙ্কোচাত্মক গতি অবিদ্যা দ্বারা (ignorance) প্রভাবিত আর এর চরমাবস্থা তামসিকতার শেষ বিন্দু ছাড়া আর কিছুই নয়৷
এই সঙ্কোচাত্মক চরমাবস্থা বা আপাত বিরামাবস্থা (apparent pause) অভিব্যক্ত হয় অষ্টপাশ অর্থাৎ আটটি মানসিক ৰন্ধনের মাধ্যমে–এরা হ’ল ঘৃণা, শঙ্কা, ভয়, লজ্জা, জুগুপ্সা, কূল, মান, শীল৷ মনের তমভাবাত্মক অবস্থা থেকে এই অষ্টপাশের উৎপত্তি তাই মন ক্রমশঃ এদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে৷ এই আটটি ৰন্ধনই কুসংস্কার আর ইজম্কে প্রাণরস যুগিয়ে চলে৷ যত রকমের ইজম্ আছে যেমন জাতীয়তাবাদ, জাতিবাদ, প্রাদেশিকতাবাদ, সাম্প্রদায়িকতাবাদ, তারা সবই মানুষে মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টি করে আর মনুষ্যত্বের অবমূল্যায়ন ঘটাতে থাকে৷ এই আটটি ৰন্ধন মানুষের মনের সূক্ষ্ম স্তরে অনৈক্য আর অবিশ্বাসের ৰীজ বপন করে’ দেয় যদিও তা সব সময় বাহ্যিক আচার–ব্যবহারের মধ্য দিয়ে হয়তো প্রকাশিত হয় না৷ (ক্রমশ)