ইতিহাসে ঢাকা -  ঢাকাই মসলিন

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

বাঙলার অতীত গৌরবের অন্যতম সাক্ষী ঢাকাই মসলিন৷ সূক্ষ্ম সূত্রশিল্পের এক অপূর্ব নিদর্শন এই মসলিন৷ মোগল বাদশাহদের পাটরানী বেগম থেকে শুরু করে ইয়ূরোপের সম্রাজ্ঞীরা পর্য্যন্ত এই মসলিন শাড়ী পরবার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে থাকতেন৷

কৃষি প্রধান দেশ হলেও বাঙলার প্রাচীনকাল থেকেই বস্ত্রশিল্পের জন্য ছিল বিখ্যাত৷ বাঙলার বস্ত্রশিল্পের খ্যাতি খ্রীষ্টের জন্মের বহু আগে থেকেই দেশ-বিদেশে  ছড়িয়ে পড়েছিল৷ প্রাচীন বাঙলায় চার রকম বস্ত্রের খুব কদর ছিল৷ ক্ষৌম, দুকূল পত্রোর্ণ আর কার্পাসিক৷ ক্ষৌম হচ্ছে শণের সুতোয় তৈরি মোটা কাপড়৷ কাশী আর উত্তরবঙ্গে এই কাপড় প্রস্তুত হতো৷ এক ধরণের সূক্ষ্ম কাপড়কে বলা হতো দুকূল৷ এই দুকূল কাপড় হতো সাদা, নরম ও অত্যন্ত স্নিগ্দ৷ পত্রোর্ণ কাপড় তৈরি হতো রেশমের মতো এক জাতীয় লালা থেকে৷ উত্তরবঙ্গে এই কাপড় প্রস্তুত হতো৷ কার্পাসিক কাপড় তৈরি হতো কার্পাসের তূলো থেকে৷ খ্রীষ্টীয় প্রথম শতাব্দী থেকেই বাঙলায়  সূক্ষ্ম বস্ত্র বিদেশে রপ্তানি হতে শুরু করেছিল৷ অর্থাৎ বাঙলার সূক্ষ্ম বস্ত্রশিল্পের ঐতিহ্য বহু প্রাচীন৷ বাঙলার যে মসলিন ঊনবিংশ শতাব্দী পর্য্যন্ত সমগ্র বিশ্বে বিখ্যাত ছিল, অতি প্রাচীন যুগেই তার উদ্ভব হয়েছিল৷ সমুদ্রপথে ব্রহ্মদেশ, মালয় উপদ্বীপ, যবদ্বীপ, সুমাত্রা  প্রভৃতি দেশে মুক্তা আর নানারকম গাছ-গাছড়ার সাথে মসলিনও পাড়ি দিত৷

এই মসলিন তৈরি হতো ঢাকায়৷ ঢাকার প্রায় পঁচিশ মাইল উত্তর-পূর্বে ডুমরাতে মসলিনের দক্ষ শিল্পীরা বাস করতেন৷ কথিত আছে এখানকার কর্তনীরা একরতি তুলো থেকে একশ পঁচাত্তর হাত সুতো কাটতে পারতো৷

আরব দেশীয় সওদাগর সুলেমান বলে গেছেন, বাঙলায় এমন একরকম কার্পাসের  সূক্ষ্ম  ও নরম বস্ত্র তৈরি হতো যা একটা  আংটির ভেতর দিয়ে গলিয়ে দেওয়া যেত৷ ত্রয়োদশ শতকের শেষের দিকে, ১২৯০ সালে পরিব্রাজক মার্র্কেপোলো বলেছেন, বাংলাদেশের লোকেরা প্রচুর কার্পাস উৎপন্ন করে ও  কার্পাসের ব্যবসা ছিল খুব রমরমা৷ পঞ্চাশ শতকের আরেক চীনা পরিব্রাজক মা-হুয়ানের বর্ণনা অনুযায়ী বাঙলায় ছয় রকমের  সূক্ষ্ম কার্পাস বস্ত্র প্রস্তুত হতো৷ এগুলি প্রস্থে দুই আর দৈর্ঘ্যে ঊনিশ হাত৷

সূক্ষ্ম বস্ত্র হিসাবে ঢাকাই মসলিনের খ্যাতি ছিল সব  চেয়ে বেশি৷ মসলিন কাপড়ের দাম ছিল এত বেশি যে অনেক সময়  ইংরেজরা ও দিনেমার সওদাগররা আধা আধি করে এই কাপড় কিনতেন৷ কাপড়গুলো লম্বায় ২৮ হাত হতো৷ মহম্মদ আলিবেগ ভারত থেকে পারস্যে ফিরে যাওয়ার সময় ডিম্বাকার একক্ষুদ্র রত্নখচিত নারকেল খোলের মধ্যে একখণ্ড মসলিন নিয়ে গেছলেন৷ সেটি তিনি উপহার দিয়েছিলেন পারস্য সম্রাট দ্বিতীয়শাহ সুফীকে৷ রত্নখচিত ক্ষুদ্র নারকেল খোলের মুখটি খুলতেই সম্রাটের তো চক্ষুস্থির৷ খোল থেকে বেরিয়ে এলো ৬০ হাত লম্বা একটি মসলিনের পাগড়ী৷

পাগড়ীটি এতো সূক্ষ্ম সুতোয় তৈরি হয়েছিল যে তার অস্তিত্বই বোঝা যাচ্ছিল না৷ সূক্ষ্মতার জন্য মসলিনের কাপড় এতো হাল্কা হতো যে তার পরিমাপ হতো ভরি বা রতিতে৷ কথিত আছে, এক খণ্ড ঢাকাই মসলিন যদি সবুজ ঘাসের ওপর  রেখে সারারাত শিশিরে ভেজানো যায় তবে পরদিন সকালে সূর্য উঠলেও তার অস্তিত্ব বোঝা যেত না৷ মনে হতো যেন ঘাসের ওপর একখানা লম্বা  মাকড়সার জাল পাতা আছে৷