জাতিগত হিংসার অবসান ও বাঙালী সমস্যার সমাধান কোনপথে

লেখক
এইচ.এন মাহাত

ত্রিপুরা সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ অবগত আছেন যে, সুপ্রাচীনকাল থেকে ত্রিপুরা রাজ্যটি বাঙালীস্থান বা সুবেবাঙলার ব্রিটিশ আমলে যা প্রেসিডেন্সি বিভাগের অংশ ছিলো, যাকে শ্রীভূম বলা হত৷ বাঙালীরাই এখানকার  মূল অধিবাসী ভূমিপুত্র৷ নৃতাত্ত্বিকভাবে বাঙালীরাই মূলতঃ অষ্ট্রিক রক্তভুক্ত ভারতের মূল অধিবাসী৷ সুপ্রাচীন কাল ভারতের  সম্পদ ও ঐশ্বর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে আর্য, নিগ্যে ও মঙ্গোলিয়ান রক্তের  মানুষরা এখানে বসবাস শুরু করে ৷ কালক্রমে সকলে  মিলে মিশে একাকার  হয়ে যায়৷ ঐতিহাসিক তথ্য মতে ত্রিপুরার মঙ্গোলিয়ান জনজাতিরা পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি মায়ানমার ও পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে প্রবেশ করে৷ আরো অনেকেই আসেন ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে৷ স্থানীয় বাঙালীরা তাদের কখনোই পর বা বিদেশী ভাবেন নি৷ সেই থেকে বাঙালী ও জনজাতিরা সকলে মিলে জাতিপ্রথা, ভাষার  বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে বাঙালীস্তানের সদস্য হয়ে ওঠে৷ গড়ে তোলে মিলন ও মিশ্রণের চারণভূমি শান্তি ও সমৃদ্ধির ত্রিপুরা৷ দেশভাগের  পর ত্রিপুরা ভারতভুক্তি হওয়ার পরেও বাঙালী ও জনজাতির মধ্যে  ভাতৃত্বের বন্ধন দেখেছি৷ কোনো প্রকারের বিবাদ, বিরোধ বা অশান্ত পরিস্থিতি আমাদের চোখে পড়েনি৷ সেই সময় বাঙালীদের সংমিশ্রণে থাকা জনজাতিরা শিক্ষা স্বাস্থ্য আচার-আচরণ সকল দিকে উন্নত হতে থাকে৷ কারণ বাঙালী জাতিসত্বার মূল বৈশিষ্ট্য হলো সকলকে আপন করে নেওয়ার৷ এটাই বাঙালীর মহত্ত্বের প্রকাশ৷ বাঙালীকে এই উদারতা ও মহত্বের জন্য বার বার আঘাত খেতে হয়েছে৷

পরবর্তী অবস্থায় কংগ্রেস, সিপিএম আজকের বিজেপি (এরা আসলে কংগ্রেস ও সিপিএমের ঔরসজাত) সাধারণ জনজাতিদেরকে বাঙালী শোষক ও বহিরাগত এই বদনাম দিয়ে খেপিয়েছে৷ শুধুমাত্র ভোটব্যাংক তৈরী করার নামে জনজাতিদেরকে উগ্রপন্থী তৈরী করে বাঙালী বিদ্বেষী করে তুলেছে৷ শান্ত ত্রিপুরাকে অশান্ত করে তোলার পরিণতি ১৯৮০ সালের জুন মাসের একতরফা ভাবে একটার একটা বাঙালী গণহত্যা, বাঙালী বাড়ী ঘর, দোকান পাট লুটপাট অগ্ণি সংযোগ, নারী নির্যাতন শিশু হত্যা কোন কিছুই বাদ যায় নি৷ তখন হাজার হাজার বাঙালী গৃহহীন হয়ে বিভিন্ন ত্রাণ শিবিরে স্থান নেয়৷

এখন ত্রিপুরায় মিজোরাম থেকে বিতাড়িত রিয়াংদের পুর্নবাসন দেওয়াকে কেন্দ্র করে যে অগ্ণিগর্ভ অবস্থা তৈরী হয়েছে তারজন্য বর্তমান বিজেপি সরকারের পুলিশ ও প্রশাসন দায়ী৷ গত তিন দশক ধরে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার রিয়াংদেরকে ত্রিপুরার মাটিতে ভরণপোষণ করে যাচ্ছে৷ আমরা জানি ত্রিপুরার আয়তন ১০ হাজার ৬ শত ৯১ বর্গ কিলোমিটারের, জন সংখ্যা ৩৬ লাখ ৭১ হাজার জন৷ পাশাপাশি মিজোরামের আয়তন ২১ হাজার ৮ শত ৭০ বর্গ কিলোমিটার,জনসংখ্যা মাত্র ১০ লাখ  ৯১ হাজার ২০১১ জনগণনার  রিপোর্ট৷ অর্থাৎ ত্রিপুরা থেকে মিজোরামের  জমির পরিমান অনেক বেশী৷ অন্য দিকে জনসংখ্যাও অনেক কম৷ জন সংখ্যার নিরিখে ভারতের মধ্যে কম বসবাসকারি রাজ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে মিজোরাম৷ ত্রিপুুরায় রিয়াংদের পুনর্বাসন দিলে স্থানীয়ভাবে কতগুলো সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে সরকারকে৷ যেমন--- চল্লিশ হাজারের অধিক  মানুষের পুনর্বাসন মানেই এদেরকে মিনিমাম গ্যারান্টির ব্যবস্থা করতে গিয়ে অর্থনৈতিকভাবে ত্রিপুরাকে আরো পিছিয়ে যেতে হবে৷ কারণ বর্তমান বিজেপি সরকাবই নয়, কোন রাজনৈতিক দলের কাছেই অর্থনৈতিক সুষ্ঠু সমাধান নেই৷

পাশাপাশি ধীরে ধীরে এদের আত্মীয়রা নানা রকমের  প্রভাব খাটিয়ে ত্রিপুরায় বিভিন্ন স্থানে বসতি স্থাপন করে নেবে৷ উক্ত রিয়াংদের কর্মসংস্থান দেওয়া মানেই স্থানীয় নাগরিকদের বঞ্চিত করা৷

রিয়াংদের ভাষা ও সংস্কৃতিক স্থানীয়দের মত না হওয়ার জন্য সকল সময় স্থানীয়দের সঙ্গে  লড়াই হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যাবে৷ কেননা  আমরা দেখছি শিবিরে থাকাকালিন এরা সব সময় স্থানীয়দের ওপর অত্যাচার, বাড়ীতে অগ্ণি সংযোগ, লুটপাট করে এমনকি গৃহপালিত পশুকে বলপূর্বক নিয়ে খাদ্যে পরিণত করে,  অথচ সরকারের পক্ষ থেকে তাদের খাবার জোগানের অভাব ছিল না৷ তাই তারা যেখানেই থাকবে সেখানেই শান্তি শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হবে৷

মিজোরাম থেকে তাড়া খেয়ে আসা উদ্বাস্তু রিয়াংদের যদি শরনার্থী বলা হয় ও তাদের জন্য কোটি কোটি টাকার পুর্নবাসনের প্যাকেজ হতে পারে তবে ৮০ জুনের পর থেকে আজ  অবধি উগ্রবাদীদের আক্রমণে ত্রিপুরা, অসম, মেঘালয়, মনিপুব, অরুণাচল প্রভৃতি রাজ্য থেকে  বিতাড়িত হয়ে আসা বাঙালীদের পুনর্বাসনের জন্যে কোনো সরকারি আর্থিক সাহায্যের প্যাকেজ নেই কেন এটাই মানুষ জানতে চায়৷

এই পরিস্থিতিতে মিজোরাম থেকে তাড়া খেয়ে আসা রিয়াংদের ত্রিপুরা থেকে  মিজোরামে ফেরৎ পাঠানো, গত ২১শে নভেম্বর পানিসাগরে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর ত্রিপুরা পুলিশের গুলি চালানোর উচ্চ ন্যায়ালয়ের বিচারপতি দিয়ে তদন্ত করা, গুলি চালানোর ফলে নিহত শ্রীকান্ত দাসের পরিবারকে ৩০ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ দেওয়া  ও বাড়ীর একজনকে সরকারি চাকুরির ব্যবস্থা করা ও পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত পা কেটে ফেলা হরেকৃষ্ণ দাসকে ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ ও সরকারি চাকুরি দেওয়া৷ অন্যান্য আঘাতপ্রাপ্ত ব্যাষ্টিদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, ক্ষতিপূরণ প্রদান করা ও তাদেরকে সরকারি চাকুরি দেওয়া৷ তাছাড়া সিপিএমের আমলে গণহত্যা ও অসমের গণহত্যার উচ্চ ন্যায়ালয়ের দ্বারা বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে দোষী ব্যষ্টিদের উপযুক্ত শাস্তি বিধান করা উচিত যাতে কোনো দিন বাঙালীকে অত্যাচার করতে সাহস না পায়৷

আর যা করা দরকার বাঙালীদেরকে কোনঠাসা করার জন্য সরকার প্রত্যক্ষ মদতে উগ্রপন্থী জঙ্গিদের দ্বারা ক্রমাগত বাঙালী অপহরণকারীদের শাস্তি বিধান ও এদের সঙ্গে জড়িত সকল ব্যষ্টিকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা যাতে এই ধরনের  অপকর্ম করতে সাহস না পায়, ত্রিপুরার মিজোরাম সহ সকল সীমান্ত ও প্রত্যান্ত মিশ্রবসিত অঞ্চলে সুরক্ষার জন্য কেন্দ্রীয়  বাহিনী অবিলম্বে নিয়োগ করা৷ তৎসঙ্গে  ত্রিপুরা ও অসমের শান্তি সম্প্রীতি বিঘ্নকারী, সাম্প্রদায়িক বীজ বপনকারী এডিসি ও অসম চুক্তি সব বাঙালী বিদ্বেষী সকল আইন বাতিল করা৷ এমতাবস্থায় যা বলা দরকার বহিরাগত নাগাদের জন্য নাগাল্যাণ্ড, মিজোদের জন্য মিজোরাম অসমিয়াদের জন্য অসম রাজ্য, ত্রিপুরীদের জন্য ত্রিপুরাল্যাণ্ড হলে, বাঙালীদের বাঙালীস্তান হতে আপত্তি কোথায়? ভারতের বাংলা ভাষাভাষী স্থানকে  নিয়ে বাঙালীস্তানই ভারত ভূমিতে বাঙালী সমস্যা সমাধানের রাস্তা হতে পারে৷