‘কি নাম তোমার?’ নতুন ছেলেটিকে জিগ্যেস করলেন সংস্কৃতের পণ্ডিত বিশ্বনাথ কাব্যতীর্থমশাই৷
‘শ্রী সুভাষচন্দ্র বসু৷’
স্পষ্ট উচ্চারণ করলো নতুন ছেলেটি৷
‘কোন্ স্কুলে পড়তে আগে?’
‘প্রোটেষ্টান্ট য়ুরোপিয়ান্ স্কুলে৷’
‘কি শিখেছো সেখানে? সংস্কৃত জানো?
ধাতুরূপ? শব্দরূপ?’
‘না৷’
‘না! লজ্জা করে না বলতে?’
লজ্জা করে বৈকি৷ খুব করে৷ কিন্তু যা সত্য তাইতো বলতে হবে৷
মিথ্যে বলতে যে শেখেনি সুভাষচন্দ্র৷
‘তা বাংলা কদ্দুর শিখেছো?’ খেঁকিয়ে উঠলেন কাব্যতীর্থমশাই৷
‘বাংলা ওখানে পড়ানো হতো না, স্যর৷’ মাথাটা একটু নত হয়ে গেলো সুভাষচন্দ্রের৷
‘সে কি গো!’ বলে কাব্যতীর্থমশাই চোখ-মুখের এমন ভয়ঙ্কর অবস্থা করলেন, যেন এর চাইতে বড়ো অপরাধ আর হয় না৷ ‘নিজের মাতৃভাষাই জানো না? ওরা তোমায় মায়ের নাম ভুলিয়ে ছেড়ে দিয়েছে, দেখছি!’
পণ্ডিতমশাইর এহেন বিদ্রূপে বেশ মজা পেলো ছেলেরা৷ হো-হো করে হেসে উঠলো তারা৷
সহ্য হলো না সুভাষচন্দ্রের৷ ঘাড় উঁচিয়ে দাঁড়ালো৷ বললো, ‘শিখে নেবো, স্যর৷ দু’দিনেই শিখে নেবো৷’
‘বাংলা না হয় শিখলে, সংস্কৃত?’
‘তাও শিখে নেবো৷’
খ্যাঁক খ্যাঁক করে এক অদ্ভূত ভঙ্গিতে হেসে উঠলেন পণ্ডিতমশাই৷ ছোঁড়া বলে কি? তাচ্ছিল্য ঠোঁট বেঁকালেন তিনি৷ পুরোনো ছেলেদের বললেন, ‘এর চাইতে যে হিমালয় পর্বত উপড়ে ফেলা সহজ রে, তাই না?’
‘হ্যাঁ৷’ ছেলেদের নোয়ানো ঘাড়ে মৌন সম্মতি৷ যেখানে শব্দরূপ একখানা মুখস্থ করতে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কেটে যায়, সেখানে সংস্কৃতে ও কিনা রাতারাতি পণ্ডিত হয়ে যাবে! এ যে পাগলের প্রলাপ!
‘এই কলা শিখবে তুমি, বুঝেছো?’ সুভাষচন্দ্রের দিকে বুড়ো আঙুলটি তুলে বললেন পণ্ডিতমশাই৷
বছরের শেষ৷ বার্ষিক পরীক্ষার পর৷ ছুটির ঘন্টা পড়তেই ছেলেরা হুড় হুড় করে ক্লাশ থেকে বেরোতে লাগলো৷
হেডমাষ্টার বেণীমাধববাবু গম্ভীর গলায় ডাকলেন, ‘এই চারু, শোনো৷’ ভিড়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলো একটি ছেলে৷
‘এবার তোমাদের ক্লাসে ফার্ষ্ট হলো কে?’
একটু ইতস্ততঃ করেই উত্তর দিলো চারু, ‘সুভাষ, স্যর৷’
খুশি হলেন বেণীমাধববাবু৷ অনুমান তাঁর মিথ্যা নয়৷ প্রথম দিনেই তিনি চিনতে পেরেছিলেন, তার ভেতরে কিছু আছে৷ বুক-ভরা যার অফুরন্ত উদ্দীপনা, মনে যার কঠিন সঙ্কল্প, হৃদয়ে যার আত্মবিশ্বাসের অনির্বাণ শিখা, সে কি কখনো পিছিয়ে থাকতে পারে? কৌতুহল মেটেনি বেণীমাধববাবুর৷ জিগ্যেস করেন আবার, ‘সুভাষ সংস্কৃতে কতো পেয়েছে?’
‘একশো স্যর!’ এবার চারু খুশিতে যেন ডগমগ! এমন অদ্ভুত খবর দিতে পারলে কে না খুশি হয়? বছরের প্রথমে যে সুভাষ সংস্কৃতের ‘স’ -ও জানতো না, সে-ই শেষে পরীক্ষার একেবারে একশো পেলো!
অফিসঘরে পণ্ডিতমশাইকে ডেকে আনলেন বেণীমাধববাবু৷ কৌতুক করে বললেন, ‘সুভাষকে কি সারাজীবনের নম্বর একবারেই দিয়ে দিলেন নাকি?’
পণ্ডিতমশাই হাসলেন৷ বললেন, ‘কি করবো বলুন, একশো-এক দেবার উপায় ছিলো, কিন্তু নিরানববই দেবার উপায় ছিলো না৷ ওর যা মেধা!’
‘শুধু মেধা নয়’ সগর্বে বললেন বেণীমাধববাবু, ‘এ হচ্ছে আত্মবিশ্বাস৷ আত্মবিশ্বাসের শক্তিতে সুভাষ শক্তিমান৷’
‘সত্যি, ছেলেটা যেন আত্মবিশ্বাসের মূর্ত প্রতীক৷’ স্বীকার না করে পারলেন না পণ্ডিতমশাই৷ যিনি একদিন সুভাষচন্দ্রকে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করেছিলেন, তিনিই আবার তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠলেন৷
- Log in to post comments