প্রাচীনকাল থেকেই লোকে বলে আসছে যে পরমপুরুষকে পাবার তিনটে পথ–জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তি৷ তারা বলে, জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষ ৰুঝে নেয় পরমাত্মা কী, মানুষ কী ও পরমাত্মাকে পাওয়ার মানে কী৷ এখন বিচার করতে হবে, জ্ঞান দিয়ে মানুষ কী ভাবে ৰুঝবে পরমাত্মা কী৷ মানুষের জ্ঞান–ৰুদ্ধির দৌড় আর কতদূর৷ মানুষের ৰ্রেন তো খুবই ছোট আর সেই ৰ্রেনও সে পেয়েছে পরমপুরুষের কাছ থেকেই,পরমাত্মার কাছ থেকেই৷ সেই ৰ্রেন দিয়ে সে কীভাবে পরমপুরুষকে পরিমাপ করবে সে কীভাবে ৰুঝবে পরমপুরুষ কেমন তাই লোকেরা যে বলে, মানুষ জ্ঞানের দ্বারা ৰুঝবে পরমপুরুষ কী, পরমাত্মা কী– একথা কতদূর সত্যি? সামান্য রোগভোগের ফলে মানুষের ৰুদ্ধি চলে যায়, বার্দ্ধক্য এলেই ৰুদ্ধি কাজ করে না৷ একজন ২০/২২ বছরের যুবক যতখানি মনে রাখতে পারে, ৮০ বছরের বৃদ্ধ ততখানি পারে না৷ তাহলে মানুষ জ্ঞানের দ্বারা কী পেতে পারে, কতখানি পেতে পারে? আবার বলা হচ্ছে জ্ঞানের দ্বারা মানুষ জেনে যাবে সে কে৷ আজ থেকে ২০০ বছর আগে তোমরা কে কী ছিলে জান না, আর ২০০ বছর পরে কে কোথায় থাকবে তাও জান না৷ তাই একথা বলা আজো সত্যি নয় যে জ্ঞানের দ্বারা নিজেকে জানা যেতে পারে৷ হ্যাঁ, জ্ঞান দ্বারা মনের কিছুটা তৃপ্তি হয় বটে, কিছুদূর পর্যন্ত অন্যকে ৰোঝা যেতে পারে একথা ঠিক, কিন্তু এর চেয়ে বেশী না৷ আমি এমন কথা বলছিনা যে জ্ঞানের চর্চা করবে না৷ যতদিন জ্ঞানের ক্ষুধা রয়েছে, ততদিন জ্ঞানার্জন করে চলো৷ যখন সেই ক্ষুধার নিবৃত্তি হবে, যখন ৰুঝতে পারবে যে জ্ঞান দিয়ে কিছু হবে না, তখন জ্ঞানচর্চার পথ ছেড়ে দিও৷ এর আগে জোর করে জ্ঞানচর্চার পথ ছাড়বার কোন আবশ্যকতা নেই৷
আবার কিছু লোক বলেন, কর্মের মাধ্যমে মানুষ পরমপুরুষকে পাবে৷ কর্মের দ্বারা পাবে একথা ঠিক, কারণ পরমপুরুষের কাছে যাওয়া এটাও তো এক ধরনের কর্ম আর কর্ম ছাড়া মানুষ এক মুহূর্তও টিকতে পারে না৷ শ্বাস–প্রশ্বাসের ক্রিয়াও তো একটা কর্ম৷ কর্ম মানুষকে করতে হবে বইকি কিন্তু সেই কর্ম যেন যথার্থ কর্ম হয়৷ অর্থাৎ মানুষ এগিয়ে চলবে একথা ঠিক কিন্তু কোন দিকে? যদি পরমপুরুষের দিকে হয় তো সেটা ঠিক৷ আর যদি সেই চলাটা পরমপুরুষের দিকে না হয়ে অন্যদিকে হয় তাহলে সেটা অকর্ম বা বিকর্ম৷ ওতে বিশেষ কোন লাভ নেই৷ অর্থাৎ ধার্মিক ও আধ্যাত্মিক জগতে জ্ঞানের যা মূল্য তার থেকে কর্মের মূল্য কিছু কম নয়৷ যদি পরমপুরুষের ভাবনা নিয়ে কাজ করা হয় তা হলে তা ঠিক তা হ’ল কর্মায়িত ভক্তি, কর্মাধিগত ভক্তি, এটা ঠিক ৷
এই বিশ্বৰ্রহ্মাণ্ড পরমপুরুষের সৃষ্টি৷ পৃথিবীর যাবতীয় জীব পরমপুরুষেরই সন্তান৷ এদের সেবা করলে পরমপুরুষ প্রসন্ন হবেন– এটা মনে রেখে ভক্ত পৃথিবীর সেবায় ব্রতী হবে৷ মানুষ ধর্মের প্রচার করবে .....সমাজের সেবা করবে, মানুষের সেবা করবে, নিরাশ্রয়কে সাহায্য দেবে, কারণ এসবই পরমপুরুষের সেবা৷
ভক্তি সম্বন্ধে বড় বড় জ্ঞানীরাও মেনে নেন যে ‘‘মোক্ষকারণসমগ্র্যাং ভক্তিরেব গরীয়সী’’৷ তারা একথা মানে না যে ভক্তিই একমাত্র পথ কারণ তারা তো বড় বড় জ্ঞানী৷ যদি তাঁরা মেনে নেন যে ভক্তিই একমাত্র মার্গ তাহলে তাদের জ্ঞানের তো কোন মূল্য থাকে না৷ তাই তাঁরা নিজেদের জ্ঞানের মূল্য বাঁচাবার জন্যে বলেন, ‘ভক্তিরেব গরীয়সী’৷ আমি তো বলব পরমপুরুষকে পাবার একমাত্র পথ ভক্তি৷ ভক্তি যদি একবার জেগে যায় তো ব্যস্, তাতেই পুরো কাজ হয়ে গেল৷ ভক্তিকে জাগানোর জন্যে মানুষ জ্ঞানের চর্চা করুক, কর্মের সাধনা করুক আর ভক্তি যতদিন পুরোপুরি না জাগছে ততদিন জ্ঞান, কর্মের আবশ্যকতা অবশ্যই রয়েছে–ততদিন মানুষ জ্ঞান–কর্মের চর্চা অবশ্যই করতে থাকবে–আর যখন ভক্তি জেগে যাবে তখন পরমপুরুষের কাছ থেকে প্রেরণা নিয়ে কাজ করবে৷
এই বিশ্বৰ্রহ্মাণ্ড পরমপুরুষের সৃষ্টি৷ পৃথিবীর যাবতীয় জীব পরমপুরুষেরই সন্তান৷ এদের সেবা করলে পরমপুরুষ প্রসন্ন হবেন– এটা মনে রেখে ভক্ত পৃথিবীর সেবায় ব্রতী হবে৷ মানুষ ধর্মের প্রচার করবে .....সমাজের সেবা করবে, মানুষের সেবা করবে, নিরাশ্রয়কে সাহায্য দেবে, কারণ এসবই পরমপুরুষের সেবা৷ কিন্তু সব সময় মনে রাখবে যে এসমস্তই হচ্ছে নিজের প্রাণপ্রিয় পরমপুরুষকে প্রসন্ন করবার জন্যে৷ তার পেছনে আর কোন কারণ নেই৷ তাই ভক্তিই একমাত্র পথ আর যতক্ষণ দৃঢ়া ভক্তি না জাগছে ততদিন জ্ঞানচর্চা, কর্মসাধনা চালিয়ে যাও৷ আর সব সময় মনে রেখো এই জ্ঞানচর্চা, এই কর্মচর্চা ভক্তিকে জাগাবার জন্যেই, ভক্তিকে বাড়ানোর জন্যেই৷ সন্ধ্যা, ১৮ ফেব্রুয়ারী ১৯৮৪, আগ্রা