কালের কল call) আসে সময়ের তালে তাল মিলিয়ে৷ গজ-বৃহস্পতিরা বলেন এটা বিজ্ঞানের যুগ৷ মানুষ গণতন্ত্র, সাম্য, ঐক্য, শান্তি, বাকস্বাধীনতার পূজারী, আমরা এগিয়ে চলেছি৷ অগ্রগতির নমুনা ছড়িয়ে আছে পথে ঘাটে ফুটপাতে, হোডিংএ , ব্যানারে, গাছের গুঁড়িতে, পাহাড়ের গায়ে, মাঠে-ময়দানে এমনকি আলাপচারিতায়৷ এককটি সময় ছিল যখন মানুষ ছিল শ্রুতিনির্ভর৷ শ্রুতিটাই ছিল প্রামাণ্য৷ বেদ তো মানুষ শুণে শুণেই মনে রাখত৷ তাই বেদের আর এক নাম হয়ে গেল ‘শ্রুতি’৷ পাশাপাশি এও শোনা যায় যে শোনা কথার বা মুখের কথার মূল্য নেই৷ লিখিত নিদর্শন চাই৷ আদালতের শুনানিতে সাক্ষ্য প্রমাণ-এ লিখিত তথ্যাদির সঙ্গে বস্তুগত নমুনাই গ্রাহ্য হলেও শ্রুতিকেও সঙ্গে রাখা হয়৷ যাই হোক কথা হচ্ছিল অগ্রগতির ‘কালের কল’ নিয়ে৷ দেখা যাক কালের কল উত্তোরত্তর পরিবর্ত্তনের ছাপ কেমন রেখে যাচ্ছে৷ তবে অগ্রগতির নাকি একটা ‘হলমার্ক’ আছে৷ হলমার্ক টা হল ত্রিফলা শাস্ত্রের মতো৷ যথা একটা ফলা হল ‘আধুনিক’, অন্যটি ‘বৈজ্ঞানিক মনন ঋদ্ধ’ আর তৃতীয়টি হল ‘প্রগতিশীল’৷ এই হলমার্কের খোঁচায় কালের কলের ফসলগুলো তোলা যাক৷
সমাজে পরিবারতন্ত্রে কালের কল কলকাঠি নাড়ছে৷ যৌথ পরিবার ব্যবস্থাকে ছুটি দেয়া হয়েছে কেননা ওটা নাকি ‘ওল্ড হ্যাজার্ড’৷ আত্মনিয়ন্ত্রণ,-ব্যষ্টি-স্বাধীনতার হাত ধরে পরিবারতন্ত্রে এল ছোট পরিবার৷ ‘আমি আর তুমি, তুমি আর আমি, আর একটা ফাউ৷ বাবা-মা-পিসি চলে যাও কাশী৷ অবশ্য কাশীর আধুনিক নামকরণ হয়েছে ‘‘বৃদ্ধাশ্রম’’----যা একালের অনাথের নাথ, নিরাশ্রয়ের আশ্রয়, আকুলের কুল, শূন্য থেকে আশি--বার্দ্ধক্যের --বারাণসী৷ কথাটার আধুনিকীকরণ করা হয়েছে-- টাকা তো আছে, কেউ না দেখে তো তার বৃদ্ধাশ্রম আছে৷ পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি ও সময়ই সমাজ মনকে এই জায়গায় দাঁড় করিয়েছে৷
সময়ের অভিঘাত ‘সেবা’-কেও ধাক্কা দিয়েছে৷ তাই ‘সেবা’র এখন বড্ড পায়াভারী৷ ‘সেবা’ এখন উন্নীত হয়েছে ‘পরিষেবা’য়৷ ‘‘ফেলো কড়ি মাখো তেল , তুমি কী আমার পর! ’’ সেবা এখন ব্যাক ডেটেড৷ সেটার স্থান দখল করেছে পরিষেবা৷ পরিষেবার পরিধিরও বিস্তার ঘটেছে৷ রান্না করা, ভাত রাঁধা, বাসন মাজা,কাপড় কাচা, ঘর মোছা, ঝাঁট দেওয়া, টিকিট কাটা, রোগীর পাশের বাড়ির লোক হয়ে রোগীর দেখাশুনা করা, মড়া পোড়ানো, ভোজ বাড়ির রান্না পরিবেশন করা ইত্যাদি, ইত্যাদি সবই পরিষেবার খপ্পরে৷ একদা ঘরণী-গৃহিণী বা মায়ে-ঝিয়ের নিত্যকর্ম সেবা কর্ম হিসাবে মর্যাদা পেত৷ এখন তা রাঁধুনি, কাজের মাসিদের পরিষেবা৷ মাস মাইনে, আর বোনাস হপ্তা ছুটি পেলেই হল৷ সরকারী, বেসরকারী হাসপাতালের সেবিকা বা গৃহসেবিকা (নার্স)-রা রোগীকে সেবা করে না৷ মাস মাইনের বিনিময়ে পরিষেবা দেয়৷ চোখ খুললেই পরিষেবার জয়-জয়কার--বাস পরিষেবা (বাস সার্ভিস), রেল পরিষেবা (রেল সার্ভিস) , জাহাজ পরিষেবা, চিকিৎসা পরিষেবা, শিক্ষা পরিষেবা, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের পরিষেবা আরো কত কী! মোট কথা মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে কালের কল ব্যাপক সাড়া ফেলেছে৷ পূর্বে শ্রম বলতে মানুষ দৈহিক শ্রমের বিনিময়ে যেমন রোজগার করে তেমনই বৌদ্ধিক শ্রমের বিনিময়ে রোজগার করে৷ বৌদ্ধিক শ্রমজীবিদের সংখ্যা নেহাত কম নয়, মোট শ্রমের প্রায় ২০ শতাংশ৷
শ্রম দৈহিক বা মানসিক যাই হোক না কেন তা অবশ্যই সেবার মাধ্যম৷ সেবা পরিষেবার রূপান্তরিত হলেও সেবার গুরুত্ব আজকের পৃথিবীতে আরো বৃদ্ধি পেয়েছে৷ পরিষেবা এসে সেবাকে স্বার্থের খাঁচায় বন্দী করায় মানুষের সমাজ জীবনে অনেক অনর্থ ঘটেছে৷ আসলে আত্মকেন্দ্রিক, ভোগবাদী, জড়মুখী ভাবনাই যত নাটের গুরু৷ সেবা তো নিঃশর্ত-নিস্বাঃর্থ পরার্থে আত্মনিবেদন৷ ‘পর সুখ বিনা আত্ম সুখের মূল নাই’৷ পরের সুখ সমাজের সুখ---সবার সুখই আমার সুখ, এসব এখন কথার কথা৷
প্রচলিত বোধে এখানেই পরিষেবার সঙ্গে সেবার আসমান জমিন ফারাক৷ পরিষেবা রোজগারের মাধ্যম তাই অর্থ মূল্য তো থাকবেই৷ ওই অর্থই মানুষের নূন্যতম প্রয়োজন পূর্তির পাথেয়৷ কিন্তু সমস্যা ওখানে নয়৷ সমস্যা সেখানে--- যেখানে বিনিময় মাধ্যম কেবল অর্থের সঙ্গে যুক্ত হয়, পিছনে থাকে মানুষের দুর্নিবার লোভ আর লাভের চিটেগুড আর বিনিময়ে কিছু না দিয়ে বা কম দিয়ে বেশী লাভের আকাঙ্ক্ষা৷ কালের কল তো এখানেই কড়া নাড়ে৷ পরিষেবায় সেবার আবেগের জারণ চাই৷ কালের কলে সর্র্বধুনিক ভাবনায় সেবার পরিধি উন্মুক্ত হয়েছে শূদ্রাচিত সেবা, ক্ষত্রোচিত সেবা, বিপ্রোচিত সেবা ও বৈশ্যোচিত সেবায়৷ (সামাজিক প্রথানুসারে মানুষ চার শ্রেণীতে বিভক্ত-শূদ্র (দৈহিক শ্রমজীবী গোষ্ঠী), ক্ষত্রিয় (যোদ্ধৃ সম্প্রদায়) বিপ্র (বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ) ও বৈশ্য সবকরম পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত৷ তাই ওরা সবাই বাচ্যার্থে, লক্ষণার্থে পরিষেবার মোড়কে সেবার আসরে নামলে ব্যষ্টির কল্যাণ সমষ্টিরও কল্যাণ৷ কিন্তু কী ভাবে সম্ভব? পরিষেবার সঙ্গে সেবার তো অহিনকুল সম্পর্ক৷ কালের কলের ধবনি প্রতিধবনি হয়ে ফেরে এত সম্ভব, এও বাস্তব৷ কেবল পরিষেবায় চাই আত্মাভিমুখী ভাবনা বা আধ্যাত্মিক জীবন বোধ তথা সেবাত্মক পরিষেবা৷
- Log in to post comments