(কালী মাহাত্ম্য নয়, ইংরেজ আমলের এক টুকরো সামাজিক ইতিহাস তুলে ধরাই এই নিবন্ধ রচনার উদ্দেশ্য)
বালিঘাটা এড়াইল বেনিয়ার বালা৷ কালীঘাটে গেল ডিঙ্গা অবসান বেলা৷ মহাকালীর চরণ পূজেন সদাগর৷ তাহার মেলান বেয়ে যায় মাইনগর৷
কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের বর্ণনায় দেখা যাচ্ছে, ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে বাণিজ্য যাত্রার প্রাক্কালে শ্রীমন্ত সওদাগর চাঁদ সওদাগররা কালীঘাটে পুজো দিয়ে যেত৷ অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি আবির্ভাব ঘটেছে ইংরেজ বণিকদের৷ ইংরেজদের হাতে তখন অঢেল কাঁচা-পয়সা, রমরমা অবস্থা৷ তাদের সংস্পর্শে এসে এক শ্রেণীর বাঙালী জমিদার, বেনিয়ান, দেওয়ান, মহাজন, রাতারাতি ধনী হয়ে গেল৷ ধনী লোকেরা আরো ধনপ্রাপ্তির আশায় ধর্মকর্মে মন দিয়ে থাকেন৷ তাই ব্যবসায়ে উত্তরোত্তর উন্নতি মানসে বাঙালী ধনী ব্যবসায়ীরা কালীঘাটে মহা ধূমধাম সহকারে পূজো দিতেন৷
কালীঘাটের কালীর মাহাত্ম্য সেকালে এতই প্রবল ছিল যে, ইংরেজরাও তার প্রভাব এড়াতে পারেননি৷ খ্রীষ্টান ও অপৌত্তলিক হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা বাঙালী ব্যবসায়ীদের সাথে কালীর ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন৷ তবে ভক্তির চাইতে ব্যবসায়িক সাফল্যই বোধহয় তাঁদের বেশি কাম্য ছিল৷
১৯২৮ সালে পাদরী ওয়ার্ড সাহেব ইংরেজদের দশ হাজার টাকা খরচ করে কালীঘাটে পুজো দিতে দেখেছেন৷
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাহেবরা কালীঘাটের কালিকার খুব ভক্ত ছিলেন৷ প্রায়ই তাঁরা সেখানে পুজো দিতেন৷ পুণ্যাহ উপলক্ষ্যে কালীঘাটে খুব ধুমধাম করে দেবীর পুজো হত৷ কোম্পানীর সাহেবরা সেই পুজোয় অংশগ্রহণ করতেন৷
সেকালের ইংরেজরা যে কালীর কত ভক্ত ছিলেন তার উল্লেখ পাওয়া যায় মার্সম্যানের একটি পুঁথিতে৷ ইংরেজদের এদেশে এসে রাজা হওয়ার জন্য অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছিল৷ যুদ্ধ জয়ের পর তাঁরা কোম্পানীর নামে কালীঘাটে পুজো দিতেন৷ একবার পাঁচ হাজার টাকা পুজো দিয়ে ছিলেন৷ হাজার হাজার বাঙালী সেদিন ভিড় করেছিল ইংরেজদের পুজো দেখতে৷
১৯৫৭ খ্রীষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজদের মনোবল ও প্রতাপ অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়৷ ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দে ইস্টইণ্ডিয়া কোম্পানী বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করেন৷ রাজস্ব আদায়ের পুরো অধিকার কোম্পানীর হাতে আসে৷ আর এই দেওয়ানি প্রাপ্তির আনন্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্তারা তাঁদের অধস্তন কোলকাতার হিন্দু সিপাহীদের কালীঘাটে পুজো দেওয়ার জন্য শ’খানেক টাকা দিয়েছিলেন
১৭৭২ খ্রীষ্টাব্দে, ওয়ারেন হেস্টিংস-এর আমলে জমিদারদের সাথে রাজস্ব-সম্বন্ধীয় যে বন্দোবস্ত হয়েছিল ‘দেবোত্তর’ বলে কালীঘাটকে তার আওতার বাইরে রাখা হয়৷ ১৭৮৯ খ্রীষ্টাব্দে লর্ড কর্ণওয়ালিশ দশ বছরের জন্য আরেক নতুন বন্দোবস্ত করেন৷ এ বন্দোবস্তেও কালীঘাট সম্বন্ধীয় রাজস্বের কোন উল্লেখ পাওয়া যায়নি৷ কালীঘাটের জমির খাজনা জমিদাররাও নিতেন না, ইংরেজ কালেকটররাও আদায় করতেন না৷ অর্থাৎ কালীঘাটকে ইংরেজরা রাজ করের অধীন করেননি৷ ১৮৫৫ খ্রীষ্টাব্দে কিন্তু মেজর আর স্মিথ কালীঘাটকে করভুক্ত করার দাবী তোলেন৷ কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহের পর ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজ সরকার কালীঘাটকে ফের করমুক্ত করে দেন৷ এ থেকে বোঝা যায় কালীঘাটের প্রতি দুর্বলতা বা ভক্তি ইংরেজদের বরাবরই ছিল৷
১৮০০ খ্রীষ্টাব্দের ২৮শে ডিসেম্বর হুগলি জেলার শ্রীরামপুর শহরে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে৷ প্রথম বাঙালী হিন্দু কৃষ্ণপাল ঐ দিন খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত হন৷ কৃষ্ণপাল ছিলেন শ্রীরামপুরের অধিবাসী৷ শ্রীরামপুরের আলোড়ণ কলকাতাতেও ছড়িয়ে পড়ে৷
ঠিক তিন বছর বাদে সমগ্র দেশব্যাপী আবার এক আলোড়ণ ওঠে৷ সেই ঘটনারও কেন্দ্রস্থল শ্রীরামপুর৷ ঘটনাটি হচ্ছে প্রথম দেশীয় খ্রীষ্টানদের মধ্যে বিবাহ৷ পাত্র কৃষ্ণপ্রসাদ৷ পাত্রী কৃষ্ণ পালের কন্যা৷ কৃষ্ণপ্রসাদ জাতিতে ব্রাহ্মণ আর কৃষ্ণ পাল সূত্র ধর৷ শ্রীরামপুরে তখন খ্রীষ্ট ধর্মের প্রচারে এসেছিলেন কেরী, মার্সম্যান ও ওয়ার্ড৷ শ্রীরামপুর সেই সময় দিনেমারদের অধীন৷ শাসক হয়েও ইংরেজরা তখন খ্রীষ্ট ধর্ম প্রচার করতেন খুব ভয়ে ভয়ে৷ পাছে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ভারতীয়রা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে৷ তাই ইংরেজ সরকার উক্ত তিন প্রচারককে কলকাতায় খ্রীষ্ট ধর্মপ্রচারের অনুমতি দেননি৷ তখন তাঁরা ডেনমার্কের অধিপতির কাছে অনুমতি পত্র পেয়ে শ্রীরামপুরে খ্রীষ্টধর্ম প্রচারে আসেন৷ প্রথম দেশীয় খ্রীষ্টানদের বিবাহে তাঁরা উপস্থিত ছিলেন৷ মিশনারীদের এই সাফল্যে উৎফুল্ল হয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী পাঁচ হাজার টাকা খরচ করে কালীঘাটে পুজো দিয়েছিলেন৷
পাদরী ওয়ার্ড সাহেব লিখে গেছেন, ইউরোপীয় নারীরা পাল্কী চেপে কালীঘাটে পুজো দিতে যেতেন ও দেবীকে জাগ্রত মনে করে বর প্রার্থনা করতেন৷ একবার কোম্পানীর একজন কর্মচারী মামলায় জয়লাভ করে কালীঘাটে তিনহাজার টাকা খরচ করে পূজো দিয়েছিলেন৷
কবিয়াল এন্টনী ফিরিঙ্গীর কালী ভক্তি তো সর্বজন বিদিত৷ ‘ভজন পূজন জানি নে মা জেতেতে ফিরিঙ্গী/ যদি দয়া করে তারো মোরে এভাবে মাতঙ্গী৷’ ২৪৪ নং বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী স্ট্রীটের সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির বহুকালের প্রাচীন৷ লোকে বলে ফিরিঙ্গী কালী৷ যদি বিগ্রহের প্রতিষ্ঠাতা এন্টনী নন! তিনি প্রতিদিন মন্দিরে আসতেন, ভক্তিভরে গান গাইতেন, পুজো দিতেন৷ ধর্মে খ্রীষ্টান ও জাতিতে পর্তুগীজ হয়েও তিনি ছিলেন কালীর পরম ভক্ত৷
- Log in to post comments