কেন আমরা বাঙালী, কেন বাঙালীস্তান

লেখক
মন্ত্র আনন্দ

প্রাউট (প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব)প্রণেতা পরম শ্রদ্ধেয় শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকার স্পষ্টই বলেছেন----" মানুষের সমাজ এক ও অবিভাজ্য"। কিন্তু তিনি তাঁরসামাজিক অর্থনৈতিক তত্ত্ব প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভারতবর্ষকে ৪৪টি সমাজ ও পৃথিবীকে ২৫০ এর বেশি সমাজে বিভক্ত করেছেন। তিনি কেন এটা করেছেন তা বোঝার আগে আমাদের শ্বসনের সংজ্ঞা জানা দরকার। কাল মার্কসশোষণ কে অর্থনৈতিক দিক থেকে বিচার করে বলেছেন মুনাফাই শোষণ, কিন্তু কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলি এই তত্ত্ব কে খারিজ করে দেয়।

প্রাউটেরদৃষ্টিকোণ থেকে শোষণের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে---"একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে অবস্থিত তথাকার জনগোষ্ঠীর দৈহিক, মানসিক ও আত্মিক বিকাশকে স্তম্ভিত করে, ওই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদের সঙ্গে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর শ্রম ও মানসিক সম্পদের অবাধ লুন্ঠনই শোষণ"।
 ('প্রাউটের অর্থনীতি' পৃষ্ঠা ২৬১)

প্রাউটেরদৃষ্টিতে শোষণ শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকেই হয় না, মানসিক ও আধ্যাত্বিক দিক থেকেও শোষণ হয়।শোষক শ্রেণী একটি বিশেষ ভৌগলিক সীমানা ও ওই ভৌগোলিক সীমানায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে বেছে নেয় শোষণের কেন্দ্র করে। ভারতবর্ষে বাঙালী হয়েছে সেই শোষণের শিকার। তবে অন্যান্য জনগোষ্ঠীগুলো শোষিত হচ্ছে, কিন্তু কেন্দ্রবিন্দু বাঙলা। শোষকের কৌশল হচ্ছে ভাগ কর ও শোষণ করো। তাই বাঙলার ভৌগোলিক সীমানা যেমন টুকরো টুকরো করা হয়েছে, তেমনি বাঙালী জনগোষ্ঠীকেও বিভক্ত করে দেয়া হয়েছে।
প্রাউটের দৃষ্টিতে শোষণকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে, যেমন--- সম্রাজ্যবাদী শোষণ, উপনিবেশিক শোষণ ও ফ্যাসিস্টশোষণ। এই ফ্যাসিস্টশোষণ সম্পর্কে প্রাউট প্রবক্তা বলেছেন----"ফ্যাসিস্ট শোষকরা তাদের শোষণের সুবিধার জন্য প্রথমেই প্রাকৃতিক সম্পদ পূর্ণ একটি জনগোষ্ঠীকে বেছে নেয়।ফ্যাসিস্টদের ক্রুর দৃষ্টি যে জনগোষ্ঠীর ওপর নিবদ্ধ হবে সেই জনগোষ্ঠীকে তারা প্রথমেই চেষ্টা করবে তাদের নিজস্ব সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিবেশ থেকে উৎখাত করতে। এই প্রয়োজনে ফ্যাসিস্ট শক্তি সর্বদাই ওই জনগোষ্ঠীর ওপর অন্যতর এক ভাষা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ কে চাপিয়ে দিতে চায়, যার ফলে ওই জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ব্যষ্টি মানস সহজে নিজেকে প্রকাশ করতে পারেনা, তার মধ্যে এক ধরনের পরাজিত মনোভাবগড়ে উঠতে থাকে। ওই পরাজিত মনোভাব তার তেজকে, সংগ্রামশীলতাকে ধ্বংস করে তার মানসি- কতাকে সম্পূর্ণ বিনষ্ট করে ফেলে। তীব্র অর্থনৈতিক শোষণের জন্য ফ্যাসিস্টরা ওই পটভূমিকে নিপুণভাবে ব্যবহার করে।ফ্যাসিস্ট শোষণের প্রধান লক্ষ্য হলো প্রাকৃতিক সম্পদের অবাধ লুন্ঠনেরজন্য প্রয়োজনে একটি জনগোষ্ঠীকে ইতিহাসের বুক থেকে বিলুপ্ত করে দেওয়া।"

'প্রাউটের অর্থনীতি'পৃষ্ঠা ২৬৭

ব্রিটিশ আমলেইবাঙলা উপনিবেশিক, সাম্রাজ্যবাদী ও ফ্যাসিস্ট শোষণের শিকার হয়। ব্রিটিশ পরবর্তী যুগে শুরু হয় দেশীয় সাম্রাজ্যবাদী ও ফ্যাসিস্টশোষণ। সেই শোষণ আজ বাঙলায় তীব্র আকার ধারণ করেছে।আজ বাঙলায় যে দারিদ্রতা ও অসংস্কৃতির প্রভাব, তার মূল কারণই হচ্ছে বহিরাগতের ফ্যাসিস্ট শোষণ। এই ফ্যাসিস্ট শোষণের বর্ণনা দিয়েছেন প্রাউট প্রবক্তা----"বাঙালী জনগোষ্ঠীর মূল সংখ্যাকে কমিয়ে ফেলার সঙ্গেই রয়েছে তাদের প্রাণশক্তিকে ধ্বংস করার অপচেষ্টা। মানসিক শক্তি বিকাশের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হলো ভাষা- সাহিত্য। তাই আপন ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে উৎখাত করার চেষ্টা হলো মানসিক শোষণের এক বিশেষ পদ্ধতি। সমগ্র পূর্ব ভারত জুড়ে বাঙলার জনমানসের ওপর এই সাংস্কৃতিক অন্যায় অবাধে চলছে। বাঙালীর জাতীয় চরিত্রের নৈতিকতা ও দৃঢ়তাকে শিথিলকরার জন্য রাজ্যের সর্বত্র মদ-জুয়া, আফিম, গাঁজা, সাট্টা, পতিতালয়, ক্যাবারে ইত্যাদি দূষিত ক্ষতের মতো ছড়িয়ে রাখা হয়েছে।একইসঙ্গে বাঙলা জুড়ে দুষ্ট ক্ষতের মতো ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে যৌন আবেদন মূলক অপরাধপ্রবণ চলচ্চিত্র ও অশ্লীল সাহিত্যের বিপুল প্রচার"।

'প্রাউটের অর্থনীতি'পৃষ্ঠা২৬৮

তাইতো নির্বীজ বাঙালী আজ তার উন্নত ভাষা-সংস্কৃতি ভুলে, তার গৌরবোজ্জ্বল অতীত ভুলে গো-হনুরপুজোয় মেতেছে! তাই বাঙালী জাতিসত্ত্বার অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথতাঁর সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে এক প্রবন্ধে লিখেছেন----"এই বৃহৎ সত্তারমধ্যে রয়েছে এক ক্ষুদ্র সত্তা, তাকে বলা হয় জাতীক সত্তা। মানুষকে মানুষ করে তুলবার ভার এই সত্তার উপর। এই তার বৃহৎ দেহ, মহৎআত্মা। এই আত্মিক ঐক্যবোধ যে জাতির মধ্যে নেই মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকার অধিকার তার দুর্বল।"

বাঙালীর এই দুর্বলতার ফাঁক দিয়েই ফ্যাসিস্ট শোষক ও তার পোষ্য হিন্দি সাম্রাজ্যবাদী শাসক বাঙলারঘাড়ে চেপে বসেছে। সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস সভাপতির পদ ত্যাগ করার পর বিশ্বকবি তাকে যে ঐতিহাসিক পত্র লিখেছিলেন, সেখানেও বিশ্বকবিবাঙলার বুকে ফ্যাসিস্টশোষণের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
 তাই আজ শোষণমুক্তির শোষণ মুক্তির জন্য প্রয়োজন বাঙালী জনগোষ্ঠীর ঐক্যবদ্ধ হওয়া ও ছিন্নভিন্নবাঙলার মাটিকে সংযুক্ত করা। তাই 'আমরা বাঙলী', তাই বাঙালী স্তান।
তবে শুধু আমরা বাঙালী নয়,একসুমহান আদর্শের ছত্রছায়ায় ভারতবর্ষের ৪৪ টি জনগোষ্ঠীশামিল হয়েছে। সারা বিশ্বের২৫০ টির বেশি জনগোষ্ঠী এই আদর্শের ছত্রছায়ায় শামিল হয়ে শোষণমুক্তির আন্দোলন শুরু করবে। আমরা বাঙালী তারই পথ প্রদর্শক। তাই আমরা বাঙালী বা বাঙালীস্তানের আন্দোলন শুধু বাঙালী জনগোষ্ঠীর আন্দোলন নয়, বিশ্বের প্রতিটি শোষিত, নিপীড়িত, অবদমিত মানুষের মুক্তির আন্দোলন। তাই বিশ্বের প্রতিটি শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ--- যারা পৃথিবীতে আদর্শ মানুষের সমাজ দেখতে চান তাদের উচিত আমরা বাঙালী ও বাঙা লীস্তানের আন্দোলনকে শক্তি ও সমর্থন যোগানো।