কেন্দ্রীয় আয়-ব্যয় মাত্রিকার উদ্দেশ্য

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

আগামী ২০২১-২২-এর কেন্দ্রীয় আয - ব্যয়-মাত্রিকার (বাজেট) সবচেয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি চোখে পড়ল, তারমধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখনীয় হ’ল কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন ঘোষণা করলেন, কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে ব্যাপকভাবে পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়া হবে৷ কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত,সংস্থাগুলির মধ্যে ৪টি মাত্র ষ্ট্রাটেজিক (জাতীয় স্বার্থে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ,শিল্পের ক্ষেত্রে সরকার সামান্য অংশীদাদায়িত্ব রাখবে,বাকি সবগুলির বেসরকারীকরণ করা  হবে৷

গতবছর মন্ত্রীসভার বৈঠকে প্রস্তাব নেওয়া হয়েছিল, কেন্দ্রীয় পরিচালিত শিল্প সংস্থাগুলির মধ্যে ১০টি সেক্‌টরকে জাতীয় স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ ষ্ট্রটেজিক শিল্প হিসেবে ধরা হোক৷

তার মধ্যে ছিল বিদ্যুৎ, কয়লা, সার পেট্রোলিয়াম, ব্যাঙ্কিং, বীমা ইস্পাত প্রতিরক্ষার জন্যে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি তৈরীর শিল্প৷ কিন্তু এ বছরে আয়-ব্যয় মাত্রিকা (বাজেট) পেশের পূর্বে এই ষ্ট্র্যাটেজিক সেক্‌টরের সংখ্যা ১৮ থেকে কমিবে ৪টি করা হ’ল৷ কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পরিষ্কার ঘোষণা করে দিলেন কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রস্তাব অনুমোদন করেছে৷ তিনি জানালেন, ২০২১-২২ আর্থিক বছরে এই বিলগ্ণিকরণ থেকে ১.৭৫ লক্ষ কোটি টাকা পাবেন বলে তিনি আশা করছেন৷

এবার কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির বিলগ্ণিকরণ করার কথা ঘোষণা করা হ’য় সেগুলি হ’ল---

ভারত পেট্রোলিয়াম কর্র্পেরেশন লিমিটেড, এয়ার ইন্ডিয়া, শিপিং কর্র্পেরেশন অব্‌ ইন্ডিয়া, কনটেনার কর্র্পেরেশন অব্‌ ইন্ডিয়া, আই ডি.বি আই ব্যাঙ্ক, ভারত আর্থ মুভার্স  লিমিটেড, পবন হংস৷ অর্থমন্ত্রী আরও জানান, ২টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ও একটি জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীতেও বিলগ্ণীকরণ করা হবে৷

এইভাবে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদগুলিকে বেসরকারী কোম্পানীর হাতে তুলে দিয়ে  সরকার পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে আরও দৃঢ় করছেন৷ ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান আরও বাড়িয়ে তুলছেন৷

এই ব্যবধান এমনিতেই এখন তুঙ্গে উঠেছে৷ ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে ,তাদের সম্পদ হু-হু করে বাড়ছে৷ অন্যদিকে কোটি কোটি দরিদ্র ও বেকার মানুষ মৃত্যুর সঙ্গে পাঙ্গা লড়ছে৷ আর সরকার পুঁজিপতিদের  এই অর্থনৈতিক শোষণকে আরও মদত দিচ্ছে৷

ক্রমশঃ ধনবৈষম্যের এই যে মারাত্মক বাইরাসের virus) প্রকোপ  বাড়ছে, আর এর কারণে যেভাবে গণ অসন্তোষ বৃদ্ধি পাচ্ছে তা হয়তো অচিরেই এক মহা বিস্ফোরণ রূপে আত্মপ্রকাশ করবে৷ এ আশঙ্কা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও চিন্তাশীল ব্যষ্টিরাই করছেন৷

করোনা বাইরাসের চেয়ে এ মোটেই কম বিপজ্জনক নয়৷ এই মহাবিষ্ফোরণের  বিপদ থেকে তখন ধনীরা ও রাষ্ট্রনায়করাও রেহাই পাবেন না৷

এখন সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ণ জাগছে, এই সরকারকে পুঁজিপতিগোষ্ঠীই চালাচ্ছেন না তো! কথায় বলে এ দুনিয়া টাকার বশ!

এদিকে সরকারের তিন কৃষিনীতির  বিরুদ্ধে দিল্লি সীমান্তে  ৪০০ কর্ষক সংঘটন ২মাসের  অধিক সময় ধরে অভূতপূর্ব আন্দোলন চালিয়ে  যাচ্ছে৷ এর মধ্যে ১৫০ জন কর্ষক আন্দোলনের বলি হয়েছে৷ তবুও সরকার বেপরোয়া৷  আসলে কৃষিপ্রধান ভারতবর্ষের কৃষিক্ষেত্রকেও পুঁজিপতিদের অবাধ লুন্ঠনের জন্যে অধিকার দেওয়ার বিরুদ্ধেই এই অভূতপূর্ব কর্ষক আন্দোলন৷

দেশের বিক্ষুব্ধ অন্নদাতা কর্ষকদের ক্ষতে কিছুটা প্রলেপ দেওয়ার অন্ততঃ সুযোগ ছিল আগামী বাজেটে৷ কিন্তু আশ্চর্যের  বিষয়, এই পরিস্থিতিতে কৃষি বাজেটের বরাদ্দও ৮ শতাংশ কমিয়ে দিল কেন্দ্র৷ টাকার অংকে গতবারের চেয়ে ১১ হাজার কোটি টাকারও বেশি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ ‘প্রধানমন্ত্রী কিষাণ সম্মান নিধি’ প্রকল্পে--- যাতে বছরে কর্ষকদের ৬ হাজার টাকা দেওয়ার কর্মসূচী, এতেও গত বছর ৭৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল, এবার তা কমিয়ে করা হয়েছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা৷ আবার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক  চাষীদের ৬০ বছর বয়স্কের পর থেকে মাসে ৩ হাজার টাকা পেনসন দেওয়ার যে প্রকল্প রয়েছে তাতে চলতি অর্থবর্ষে বরাদ্দ ছিল ২২০ কোটি টাকা, আগামী ২১-২২এর অর্থবর্ষে তাও কমিয়ে করা হয়েছে ৫০ কোটি টাকা৷

দেশে গরীব চাষী, ভূমিহীন কৃষিমজুর ও গ্রামের বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাটা যে বর্তমানে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা এই সমস্যা সমাধানের জন্যে প্রয়োজন ব্লকভিত্তিক পরিকল্পনা৷ তার জন্যে প্রতিটি ব্লকে কোন্‌ কোন্‌ কৃষিভিত্তিক ও কৃষি সহায়ক বা অকৃষি শিল্পের সম্ভাবনা রয়েছে এ ব্যাপারে ব্যাপক সমীক্ষা করে স্থানীয় মানুষদের সমবায়ে ব্যাপক শিল্পায়নের পরিকল্পনা নেওয়া খুব জরুরী ছিল৷ এজন্যে যথাযথ সমীক্ষান্তে স্থানীয় মানুষদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের মূলধন জুগিয়ে ব্যাপকভাবে ক্ষুদ্র শিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে দেশের দারিদ্র্য ও বেকার সমস্যা সমাধানের  একটা বিরাট সুযোগ ছিল৷ কিন্তু সে সুযোগের ব্যবহার করা হল না৷

প্রধানমন্ত্রী সর্বত্র ‘আত্মনির্ভর ভারত গড়ার শ্লোগান তুলছেন, কিন্তু  কী  করে দেশের দরিদ্র মানুষ ‘আত্মনির্ভর’ হবে সেই পথে হাঁটতে তাঁকে দেখা যাচ্ছে না৷ বর্তমান সরকারের আয়-ব্যয় মাত্রিকার  মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে মূলতঃ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের ধনকুবের গোষ্ঠীকেই সহায়তা করছেন৷ তাঁরা পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার ‘ট্রিক্‌ল ডাউন’ তত্ত্বের ওপর অবস্থা রেখে এই পুঁজিপতিদের আরও পুঁজি বৃদ্ধির  প্রয়াস চালাচ্ছেন৷ পুঁজিপতিদের  একমাত্র লক্ষ্য যেন তেন প্রকারেণ অধিক থেকে অধিকতর মুনাফা লুন্ঠন, এটা তাদের নেশা, সেবা মানসিকতা তাদের নেই৷ তাই পুঁজিবাদকে পুষ্ট করে জনসাধারণের অর্থনৈতিক সমস্যা দূর করার  চিন্তা অবান্তর৷