যদিও সাধারণ অর্থে ‘কদলী’ ৰলতে সব কলাকেই ৰোঝায়, তবু বিশেষ অর্থে ‘কদলী’ অর্থে কাঁচকলা আর ‘রম্ভা’ মানে পাকা কলা৷ এখানে কাঁচকলা বলতে আমরা সেই কলাকে ৰোঝাচ্ছি যা কাঁচা অবস্থায় তরকারী রেঁধে খাওয়া হয়, আর পাকা অবস্থায় সাধারণতঃ খাওয়া হয় না৷ কলা সমস্ত গ্রীষ্মপ্রধান দেশেই জন্মায়৷ তবে কলার আদি নিবাস পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ–ড্র্ত্রব্দব্ধ ঢুস্তুন্ন্দ্বব্দ ট্টব্জন্তুড়ন্হ্মন্দ্বপ্) অর্থাৎ মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স প্রভৃতি দেশ৷ ভারতও অন্যতম কলা–উৎপাদনকারী দেশ৷ কেবল ভারতেই শতাধিক প্রজাতির গাছ রয়েছে৷ ভারত ও বহির্ভারত নিয়ে সমগ্র বিশ্বে কলার প্রজাতির সংখ্যা দেড় হাজারের মত৷ ভারতের কেরলেই সবচেয়ে বেশী প্রজাতির কলা পাওয়া যায়৷ ৰাংলায় সবচেয়ে বেশী কলার চাষ হয় হুগলী জেলায়৷ এছাড়া হাওড়া, মেদিনীপুর, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, চব্বিশ পরগণা, জলপাইগুড়ি ও ত্রিপুরায় প্রচুর পরিমাণ কলা জন্মায়৷
কলার কোন অংশই পরিত্যাজ্য নয়৷ কলার খোলাও পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের লোকেরা বিভিন্ন ভাবেই খেয়ে থাকেন৷ ফলন্ত কলা গাছের কাণ্ডের অভ্যন্তরভাগ যাকে ৰাংলায় থোড় বলা হয়, তাও মানুষের খাদ্য৷ থোড়ের বেশির ভাগ অংশই জল৷ তবে থোড়ে কিছু মূল্যবান খনিজ লবণও রয়েছে৷ সেই হিসেবে থোড়ের একটা খাদ্যমূল্যও রয়েছে৷ যারা রক্তাল্পতায় ভোগে অথবা যাদের চর্ম কিছুটা বিবর্ণ, থোড় তাদের পক্ষে মোটামুটি বিচারে ভাল৷ কলাপাতা ভোজনপাত্র হিসেবে ব্যবহূত হয়৷ কলাগাছ পোড়ালে যে ক্ষার পাওয়া যায় তা দিয়ে এককালে কাপড় কাচা হত৷ এই কলাগাছের ক্ষার–সোডিয়াম কার্বনেট (হল) যা কাপড় কাচা সোডার মূল উপাদান৷ কলাগাছের সূতোতে পৃথিবীর অনেক দেশে বস্ত্র প্রস্তুত করা হয়৷ যেমন বস্তু প্রস্তুত হয় আনারসের সূতো দিয়ে৷
কদলী একটা খুব পুষ্টিকর খাদ্য৷ পালা জ্বর ৰলে এক রকমের যে জ্বর হয় একদিন অন্তর বা দু’দিন অন্তর–তার ঔষধ কদলী৷ যকৃত, অগ্ণ্যাশয়, কিডনী এই তিনের কাজ ভাল রাখে কদলী৷ আমাশয় রোগেরও খুব ভাল ঔষধ কদলী৷ আবার মৃতবৎসা নারীর পক্ষে খুব ভাল খাদ্য কদলী৷
(আগেই ৰলেছি) খাদ্য হিসেবে কলা বেশ পুষ্টিকর৷ তবে যেসব কলায় অম্লভাব বেশী (যেমন চাঁপা কলা) সেগুলি সন্ধ্যার পর খেলে অম্লদোষ হতে পারে৷ ঙ্ম যদিও সব প্রজাতির কলাতেই পুষ্টিমূল্য প্রায় সমান, তবুও কাঁটালী কলার পুষ্টিমূল্য তুলনামূলক ভাবে একটু বেশী৷ বিশেষ করে ঔষধ হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে–আমাশয় বা রক্ত–আমাশয়ে ঘিয়ে ভাজা বা দুগ্ধক্ষীরার রস সহ পাকা কলা–এক্ষেত্রে কাঁটালী কলাই ব্যবহার করা উচিত ৰ
তরমুজ
পৃথিবীতে তরমুজের অনেক প্রজাতি রয়েছে৷ ভারতীয় তরমুজের ওপর–শাদা, ওপর–সবজে ও ওপর–কালচে–তিন প্রজাতিই রয়েছে৷ সাধারণতঃ ভারতীয় তরমুজের ভেতরটা ঘোর লাল অথবা ফিকে লাল হয়ে থাকে৷ গোয়ালন্দ, আমতা, তারকেশ্বর, ৰর্দ্ধমান, ভাগলপুর ও সাহারাণপুরের তরমুজেরও নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে৷ আকারে সবচেয়ে ৰড় হয়ে থাকে ভাগলপুরী তরমুজ৷ যার ভেতরটা হলদে সেই চীনা তরমুজের আকার কিছুটা ছোট হয় কিন্তু মিষ্টত্ব খুবই বেশী৷ বর্ত্তমানে সাৰেকী জাপানী বর্গীয় তরমুজ দক্ষিণ ৰাংলায় সমুদ্র–ঘেঁষা অঞ্চলে ভালই জন্মাচ্ছে–এর স্থানিক নাম দেওয়া হয়েছে সাগরশ্রী৷ উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা ৰলেন তরমুজের আদি বাসস্থান নাকি আরব দেশে৷ অনুমিত হয় জলপথে এই তরমুজ কলিঙ্গ দেশে (বর্ত্তমান ওড়িষ্যা) প্রথম এসেছিল৷ তাই ভাল ৰাংলায় তরমুজের নাম হচ্ছে কালিঙ্গ (কলিঙ্গ অণ্)৷ তরমুজের অপর একটি ভাল নাম (সংস্কৃত) হচ্ছে ‘কালিকাফলম্’৷ খরৰুজাকে ত্তব্ভব্দন্সপ্পন্দ্বপ্ ৰাংলায় খরমুজ বলা হয়৷ সংস্কৃতে বলা হয় স্ফোটক বা স্ফোটন৷ আর ফুটিকে বা ‘বাঙ্গি’কে ৰলা হয় স্ফুটিকা৷ এই তরমুজেরই একটি স্বগোত্র যা কালক্রমে মূল শাখা থেকে পৃথক হয়ে যায়, সেটি ‘খেঁড়ো’ নামে পরিচিত৷ খেঁড়ো অনেক ব্যাপারেই তরমুজের মত৷ তরমুজ কাঁচায় খাওয়া যায় না, পাকলে খাওয়া যায়৷ খেঁড়ো কাঁচাতেই খাওয়া যায়৷ তবে রেঁধে খেতে হয়–পাকলে খাওয়া যায় না৷ তরমুজ একটি লতানে গাছ৷
তরমুজ আজ একটি বিশ্বের সুপরিচিত ও উপাদেয় ফল৷ তরমুজের মধ্যমাংশে শর্করার হার অত্যন্ত অধিক ঙ্ম তাই গ্রীষ্মকালে শরীর থেকে অতিরিক্ত ঘাম বেরিয়ে শরীরে যে প্রাণশক্তির ঘাটতি হয়, সরস ও সুমিষ্ট তরমুজ তার অনেকটাই পূরণ করে ৰ৷ তরমুজের রস থেকে এক ধরনের চীনী প্রস্তুত করা যায়৷ পাকা তরমুজের শাদা অংশটা শুকিয়ে আটা ও ময়দার মত ব্যবহার করা যায়৷ এর পুষ্টিমূল্য (গমের) আটা ময়দা থেকে কম হলেও আপদকালীন খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়৷ গরীবের পেট ভরাবার কাজেও এ কিছুটা সাহায্য করবে৷ ৰাংলা, ভারত তথা পৃথিবীর খাদ্যসংকটযুক্ত দেশগুলিতে নদীর উভয় তীরের পতিত জমিতে তরমুজ, খেঁড়ো, মেঠো শশা, কাঁকুড় বর্গীয় গাছের অধিক চাষ হওয়া দরকার৷ তাতে বিশ্বের খাদ্য সমস্যার সমাধানে যথেষ্ট সাহায্য করবে৷
তরমুজ ও খোঁড়োর ৰীজ থেকে রন্ধন তৈলও যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যেতে পারে৷ বস্তুতঃ তরমুজ, শশা, কাঁকুড়, খরমুজ, ফুটি ও কুমড়োর ৰীজ থেকে যে মূল্যবান তেল পাওয়া যায় তার পুষ্টিমূল্য বাদাম তেলের মতেই৷ স্বাদ কোন কোন ক্ষেত্রে ঘি–এর কাছাকাছি৷
সয়াবীন
সয়াবীন একটি প্রচুর স্নেহগুণ–যুক্ত উত্তম খাদ্য৷ কিন্তু এতে রয়েছে কিছুটা বুনো গন্ধ৷ এর আদি বাস চীন ও উত্তর পূর্ব এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে৷ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে একে স্তুন্দ্ব–প্সস্তুপ্সব্ভ (দুর্গন্ধনাশক) করতে পারলে এর জনপ্রিয় হওয়ার পথে কোন ৰাধা থাকে না৷
এই সয়াবীন থেকে দুগ্ধের সমস্ত উপাদান ও উপকরণই পাওয়া যায়৷ তাই এ থেকে দই, ছানা, মাখন, সয়াবীন তৈল (ঘৃতের বিকল্প) পাওয়া তো যায়ই, গুণেও এ দুধের চেয়ে কিছু বেশী তো কম নয়৷ দুধের ছানার চেয়ে সয়াবীনের ছানার পুষ্টিমূল্য বেশী৷ ঙ্ম সয়াবীন তৈল ছাড়া এর অন্যান্য ব্যবহার এখনো ভারতে জনপ্রিয় হয়নি৷ অথচ সাধারণ মানুষের সহজে প্রাপ্ত পৌষ্টিক ও প্রোটিন উপকরণ হিসেবে একে জনপ্রিয় করা উচিত৷ এর চাষও কঠিন কিছু নয়, অন্যান্য ডাল–চাষের মতই৷ সয়াবীন আগের রাত্রে ভিজিয়ে রেখে, পরের দিন তা শিলে ছেঁচে নিয়ে যে কোন তরকারীতে ছড়িয়ে দেওয়া যায় বা তা শিলে ভাল করে পিষে নিয়ে, অন্যান্য উপকরণ মিলিয়ে ৰড়া তৈরী করে তরকারী বানালে, শুধু উপাদেয় হবে না, হবে প্রোটিন–গুণে সমৃদ্ধ একটি মহার্ঘ–খাদ্য ৰ
ৰরবটী
যোগারূঢ়ার্থে ‘কৃষ্ণ শিম্বী’ বলতে বোঝায় ৰরবটীকে৷ বর্ত্তমান ভারতের অধিকাংশ প্রজাতির শীম–ই প্রাচীনকালে চীন থেকে এসেছিল৷ ৰরবটীও এক প্রজাতির শীম৷ তবে অনেকের মতে ৰরবটী ইন্ডিকা গ্রুপের উদ্ভিদ–অর্থাৎ এর আদিবাস ভারতে৷ সাধারণতঃ শীমের রোপণের সময় বর্ষা, ফলনের সময় শীত, কিন্তু ৰরবটী এর ব্যতিক্রম৷ তাই মনে হয় যাঁরা বলেন ৰরবটী ইন্ডিকা গ্রুপের উদ্ভিদ, তাঁদের কথাই ঠিক৷ তবে শাদা রঙের অপেক্ষাকৃত সরু আকারের ৰরবটীগুলি সম্ভবতঃ বাইরে থেকে এসেছে৷
ৰরবটী একটি পুষ্টিকর ও শরীরের পক্ষে শুভফলদায়ক সব্জী৷ অতিরিক্ত পরিমাণে ৰরবটী খেলে আমাশয় রোগ দেখা দিতে পারে৷ তাই কেউ যেন প্রত্যহ ৰরবটী না খেয়ে মধ্যে মধ্যে এক–আধ দিন বাদ দিয়ে খান৷ পাকা ৰরবটীর দানা ডাল হিসেবেও ব্যবহূত হয়৷ পাকা ৰরবটীর দানা শাদা রঙের কিন্তু মুখটি ঘোর কৃষ্ণ৷ সম্ভবতঃ এই জন্যেই এর নাম রাখা হয়েছে কৃষ্ণশিম্বী৷ মুখের কাছটা কালো রঙের বলে রাঢ়ে–বিশেষ করে বর্ধমান অঞ্চলে–কাঁচা ৰরবটীকে ৰরবটী বললেও, পাকা ৰরবটীর দানাকে হনুমান কড়াই বলা হয়৷ হনুমান কড়াই রাঢ়ের কোন কোন অংশে অতি প্রিয় জলখাবার৷ আমাদের ছোট বেলায় ৰর্দ্ধমানের গ্রামে আমরা প্রায়ই মুড়ির সঙ্গে হনুমান কড়াই সেদ্ধ খেতুম৷ সাধারণ হিসেবে ৰরবটী যতটা পুষ্টিকর, হনুমান কড়াইয়ের পুষ্টি মূল্য তার চেয়েও বেশী৷ অবশ্য কাঁচা ৰরবটী ভিটামিন সমৃদ্ধ৷ ৰরবটী ও হনুমান কড়াইকে উত্তর ভারতে ‘ৰোড়া’ ৰলা হয়৷ ৰাংলারও কোথাও কোথাও ‘ৰোড়া’ ৰলা হয়৷
ৰিঢ়ি কলায় (ডাল)
তোমরা নিশ্চয়ই জান সংস্কৃত ভাষায় সাধারণ অর্থে ‘কলায়’ মানে যে কোন প্রকারের ডাল৷ কলকাতায় কথ্য ভাষায় ‘কড়াই’৷ কড়াই–ভাজা মানে যে কোন ডাল ভাজা৷ রাঢ়েও কোথাও কোথাও মুগের ডালকে মুগ–কলাই, খেসারীর ডালকে খেসারী–কলাই ৰলা হয়ে থাকে৷ কলায় শব্দ বিশেষার্থে কালো–খোলার ৰিঢ়ি কলাইয়ের ত্ব্প্ত্ত্রন্তুন্স ন্ধব্জ্ত্রপ্পগ্গ জন্যে ব্যবহূত হয়ে থাকে৷ এই ৰিঢ়ি কলাই–কলকাতা অঞ্চলে বলা হয় বিউলির ডাল–এরই প্রকার ভেদকে ৰাংলায় মাষ–কলাই বলে৷ সংস্কৃতে বলে ‘মাষ’ বা মাষকলায়৷ গোর্খালী ভাষাতেও ‘মাষ’ বলে৷ পঞ্জাবীতে মাষ বা মাহ বলা হয়ে থাকে৷ ৰড় জাতীয় কলাইকে পঞ্জাবীতে রাজমাষ বা রাজমাহ বলা হয়৷ যত ডালে যত গুণ আছে, এক ৰিঢ়িকলাইয়ে তার সব কটিই আছে৷ তৎসহ সহজলভ্য ডালের মধ্যে এটি সবচেয়ে পুষ্টিকর৷ ৰিঢ়ি কলায় ৰোনা হয় আষাঢ় মাসে আর তোলা হয় আশ্বিন মাসে৷
টমেটো
লৌকিক সংস্কৃতে ‘কৃমীলক’ মানে টমেটো৷ এই মৌলিক আমেরিকাজাত সব্জি বা ফলটি সেখানকার আদি বাসিন্দারা এর বুনো গন্ধের জন্যে নিজেরা খেতেন না–গৃহপালিত পশুকে খাওয়াতেন৷ এতে পশুও হূষ্ট–পুষ্ট হত, দুধ দিত বেশী৷ ইউরোপীয়রা আমেরিকায় গিয়ে এই সব্জিটির সংস্পর্শে এসে একে মনুষ্য খাদ্যরূপে গ্রহণ করলেন৷ খেতে শুরু করলেন লবণ সহযোগে ফল হিসেবে৷ এর থেকে তৈরি হল সস্, মার্মালেড, জেলি প্রভৃতি৷ এর রস থেকে তৈরি করলেন কয়েকটি ঔষধও৷ তাঁরা জেনে ফেললেন, এতে রয়েছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ লবণ ও মূল্যবান বিটামিন৷ ঙ্ম টমাটো কাঁচা স্যালাড হিসেবে বা স্যুপ হিসেবে অথবা টমাটোর রস নিয়মিত ভাবে খাওয়া উচিত, কেননা এটি লিবার ও প্রোস্টেট গ্ল্যান্ডের সুস্থতা রক্ষার পক্ষে সহায়ক৷ কর্কট রোগ বা ক্যান্সারের ক্ষেত্রেও টমেটো আহার ও ঔষধ দুই–ই৷
বৈজ্ঞানিকেরা আমেরিকার মৌলিক আর একটি ফসল–আলুকেও টমেটোর সঙ্গে যোড় কলম করে ‘পমেটো’ নামেও একটি সব্জি উৎপাদন করলেন৷ কিন্তু এই সব্জিটি জনপ্রিয় হতে পারল না৷ সমুদ্রপাড় থেকে এসেছিল বলে ৰাংলায় গোড়ার দিকে এর নাম রাখা হয়েছিল ৰিলাতি বেগুন৷ কারণ এর ৰীজ দেখতে কতকটা বেগুন–এর মত৷