কল্যাণ চেতনার হীরে মানিক

লেখক
একর্ষি

পূর্ব প্রকাশিতের পর,

ইদানিংকালে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে দুটি ভাবনার চল আছে৷  (১) পার্শ্বিক বা আংশিক বা অপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী (ডারুনিয়ান ভিউ)---যা মানুষের মানসভূমির (সত্তার) পরিধিতে ৬০ থেকে ১২০ ডিগ্রীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ও (২) সামগ্রিক বা সামুহিক বা পরিপূর্ণ ও যথার্থ দৃষ্টিভঙ্গি (সিম্‌বায়োটিক্‌ ভিউ) যা মানব সত্তার বা চেতনার ৩৬০ ডিগ্রী জুড়ে অধিকার করে থাকে৷ এ পর্যন্ত জগতে যতগুলো জীবনধর্ম বা জীবনবোধ বা জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় পাওয়া যায় তাদের মধ্যে একমাত্র আধ্যাত্মিকতা বা আধ্যাত্মিক জীবনবোধের মধ্যেই মানব জীবনের ৩৬০ ডিগ্রী অধিকার করে থাকে৷ কিন্তু ব্যাপারটা কী? দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে বৈচিত্র্যময় প্রকৃতির কোলে আশ্রিত মানুষের ব্যষ্টিগত ও সামুহিক দৈনন্দিন জীবনচর্যা ও সামাজিক অভিভাবন থেকে৷ মানুষ শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক সত্তা নিয়ে ত্রয়ী সত্তা বিশিষ্ট জীব হিসেবেই চিন্তা ভাবনা করেছেন৷ মানুষ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির অনুপপত্তি বা বিভ্রান্তি এখানেই৷ মানুষের নৈমিত্তিক চলাটা খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান কে নিয়ে৷ সঙ্গে অনিবার্যভাবে সামনে এসে যায় শিক্ষা ও চিকিৎসা৷ এই মৌল পাঁচটি পাওয়ার অভাবে পঞ্চত্ব তো পেতেই হয় অর্থাৎ অস্তিত্বই থাকে না৷ বলাবাহুল্য,সুখ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাই মানুষকে কর্মের পথে ঠেলে দেয়৷ বাইরের জগতের সঙ্গে মানিয়ে চলতে, টিকে থাকতে রসদ হিসেবে পাঁচটি মৌলিক উপাদানকে ভিত্তি করেই মানুষের সুখান্বেষার জন্ম৷ কিন্তু এগুলোকে পাওয়ার পরেও, এমনকি পর্যাপ্তভাবে পাওয়ার পরেও অসুখের বাড়বাড়ন্তে আসে সীমাহীন সুখের বাসনা,  অর্থাৎ অনন্ত সুখের এষণা---যার আধার ও উদগম তো মনেই৷ আর দেহের সাথে মানসিক-আত্মিক চাহিদাকে জুড়ে ও এগুলোকে উপলক্ষ্য করেই এসেছে সমাজশাস্ত্র, সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, অনন্তসুখের এষণার নিবৃত্তির দিশা-দর্শন ইত্যাদি অনেক কিছুই৷ তবে কাউকে বা কিছু ছেড়ে, কাউকে বা কিছু নিয়ে নয়--- জগৎ ও জীবনটা এই সব কিছুকে নিয়েই৷ সঠিক-স্বচ্ছ-সম্যক-সামগ্রিক জীবনবোধের বা দৃষ্টিভঙ্গীর এটাই হচ্ছে ৩৬০ ডিগ্রী৷ একে চেনা বা বোঝা যায় এর কতগুলো মৌলিক বৈশিষ্ট্য কে ভর  করে৷ অর্থাৎ সিম্বায়োটিক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে---১.এই দৃষ্টিভঙ্গীর সর্জনভূমি বা ভিত্তি হল আধ্যাত্মিকতা৷ ২. এর ভাবনার পরিধির মধ্যে আছে জড় অজড়, চেতন-অচেতন, মানুষ মনুষ্যেতর প্রাণী, জীবকুল-উদ্ভিদকুল সব কিছুই৷ ৩. সবার সুখের জন্যে-সবার হিতের জন্যেই এ ভাবনা প্রয়াসী. ৪. এই ভাবনায় ভূগোলে কেউ ছোট নয়, কেউ বড়ও নয়, ৫. বৈচিত্র্য হচ্ছে প্রাকৃত ধর্ম, তাই সিম্‌বায়োটিক দৃষ্টিতে বৈচিত্র্যকে মান্যতা ও গুরুত্ব দেয়া হয়, কিন্তু এই চেতনা (আউটলুক) বৈষম্য ও বিভেদকে সর্বতোভাবে বর্জন করে, কারণ বিভেদ-বৈষম্যের বিষফলটা স্বার্থান্বেষী - ধান্দাবাজ - আত্মকেন্দ্রিক - পরশ্রীকাতর - হিংসুটে-প্রতিহিংসা পরায়ন বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষেরই সৃষ্টি-যা সহজাত প্রকৃতিগত নয়৷ ৬. পরিবর্তনশীল জগতে স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যথাযোগ্য মনোভাব গ্রহণে ও যুক্তিসঙ্গত অভিপ্রকাশে সহমত৷ ব্যষ্টিস্বার্থের সঙ্গে সমষ্টির স্বার্থের সম্যক রসায়নেই এর আস্থা৷ ৭.প্রতিভাসিক জগতের প্রতিটি সত্তাই এক ও অনন্তশক্তি থেকে উদ্ভূত---আর তিলের মধ্যে তৈলের মত সবার মধ্যে তা বিরাজমান প্রকৃত জীবনবোধ বা সিম্‌বায়োটিক আউটলুক্‌-এর প্রয়োগভৌমিক বহিঃপ্রকাশ সরণীর কিছু নির্ণয়---১. মানুষ অমৃতের সন্তান, একই উৎসজাত৷ তাই প্রতিটি মানুষের সমান মূল্য, সমান মর্যাদা, সমান গুরুত্ব৷ বলাবাহুল্য ---মানুষ-মনুষ্যেতর প্রাণী, গুপ্ত-সুপ্ত-ব্যাপ্ত প্রতিটি সত্তাই সেই একেরই সংখ্যাতীত অভিব্যক্তি৷ তাই আদর্শ সমাজে হীনমন্যতা-মহামন্যতা, ছোট-বড়’র মনকুণ্ডয়ন, জাতিভেদ-বর্ণভেদ প্রথা, আভিজাত্যের দম্ভ, ঐশ্বর্যের অহংকার বা আমিত্বের আস্ফালন বড়ই বেমানান৷ বরং বলা চলে---এগুলোকে মানা, প্রশ্রয় দেয়া বা প্রচার করা ভয়ঙ্কর মিথ্যার বেসাতি, জালিয়াতি, ভণ্ডামি আর ঠাণ্ডা মাথায় সত্যের ঘাতক ছাড়া কিছুই নয়৷

২৷ আধ্যাত্মবাদের দৃষ্টিতে, বৈজ্ঞানিক মনন ঋদ্ধতায় বা সঠিক জীবনবোধের নিরিখে মানুষের জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে বহিঃজগতের সঙ্গে মানিয়ে চলতে চলতে অনন্তের অভিসারী হওয়া, পূর্ণ হয়ে ওঠা৷ আসলে জাজ্‌-ব্যরিষ্টার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি হওয়াটা জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য নয়৷ প্রকৃতপক্ষে এগুলো হচ্ছে ব্যষ্টি মানুষের মেধা-যোগ্যতা-আর্থসামাজিক পারিপার্শ্বিকতা-কর্মতুষ্টি  অনুযায়ী জগত ও জীবনের সঙ্গে সন্তুলনের বহুর মধ্যে এক একটা পাথেয় মাত্র৷

৩.প্রয়োজনের অতিরিক্ত সঞ্চয় প্রবণতা বা কুক্ষীগতকরণ বাসনা সমাজে শোষণ-বঞ্চনা-দুর্নীতি অবিচারের জন্ম দেয়৷ কেননা সসীম পৃথিবীর বুকের সম্পদও সীমিত---যা দিয়ে জগতের মানুষের সীমাহীন চাহিদার পূর্ত্তি ঘটাতে হয়৷ কিন্তু মানুষের আশা সীমাহীন৷ এই কারণে মানুষের মধ্যে সম্পদ সঞ্চয়ের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা আছে৷ এর পিছনে প্রধানত চারটে কারণ কাজ করে৷ যথা ক. ব্যষ্টি প্রয়োজনে, পারিবারিক প্রয়োজনে ও সামাজিক প্রয়োজনে মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন পূর্ত্তি৷ খ. মানুষের আকস্মিক ও অনুবন্ধী প্রয়োজন পূর্ত্তি৷ গ. ব্যষ্টি তথা পরিবার-পরিজনের ভবিষ্যতের আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা ও নিশ্চিততা৷ ঘ. মানুষের অনন্ত সুখের এষণাটা স্থূল-সীমিত পার্থিব দম্পদের মধ্যে দিয়ে পাওয়ার অপচেষ্টা- যা আসলে একটা মানসিক ব্যধিতে পরিণত হয়৷ অর্থাৎ অতিসঞ্চয় প্রবণতা একটা মানসিক ব্যধি৷ তাছাড়া ভৌতিক সম্পদের অত্যধিক সংস্পর্শ মানুষের মনে এক প্রকার আসক্তির (প্রয়োজনের অতিরিক্ত পাওয়ার পৌনপুনিক অতৃপ্ত আকাঙ্খা) সৃষ্টি করে৷ তাই প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক মানুষ সম্পদ সঞ্চয়ের ক্রমাগত চেষ্টা করবেই৷ এই কারণে সঞ্চয়ের ওপর সমাজের একটা নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার৷

বলাবাহুল্য, নিম্নোক্ত তিনটি শর্ত পূরণ করতে পারলে সঞ্চয়-শোষণ-অবিচার জনিত অভিশাপ থেকে সমাজকে মুক্তি দেয়া যেতে পারে৷ যথা ১. মানুষকে দৈনন্দিন নূ্যনতম প্রয়োজন পূর্ত্তির গ্যারান্টি দেয়া, ও সমাজে যুগের সর্বাধিক সুখ-সুবিধা পাওয়ার ব্যবস্থা থাকা ও তার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ঘটানো৷ ২. অতিরিক্ত প্রয়োজনটা অনুমোদন সাপেক্ষে হওয়া দরকার---যার জন্যে একটা নিয়ামক সংস্থার (সামবায়িক সংস্থা ব্যবস্থাপনা) দরকার৷ ৩. মানুষের মনকে মানস আধ্যাত্মিক সম্পদ অর্জনের দিকে ছুটিয়ে দেয়া---যা অনন্ত, যত খুশি সঞ্চয় করা হোক না কেন কারো ভাগেই কম পড়বে না, আসক্তি বা মানসিক ব্যাধির প্রশ্ণ থাকবে না৷