কথাটা আজকের নয়৷ সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে করাপশনও তার ছায়া সঙ্গী হয়ে চলেছে৷ প্রায় দুই শতাব্দী আগে ব্রিটিশ পার্র্লমেন্টেরিয়ান তথা ঐতিহাসিক লর্ডএ্যাকটন্ একটা কথা বলেছিলেন---‘‘পাওয়ার টেণ্ডস্ টু করাপ্ঢ এ্যাব্সলিউট্ পাওয়ার্ করাপ্ঢ্স্ এ্যাব্সলিউট্লি৷’’ বাংলায় তো একটা প্রবাদই আছে---’ যে যায় লঙ্কায় সে হয় রাবণ’৷ কেবল বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতবর্ষ নয়, গোটা পৃথিবীর মানুষ এটা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে৷ বিগত কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে যে পৃথিবীর প্রায় সব বড়, মেজো, সেজো ও ছোট ছোট সাম্রাজ্য আর রাজবংশ বা সরকার-এর পতন হয়েছে, ইতিহাস থেকে মুছে গেছে কিংবা ধবংস হয়ে গেছে কিংবা ধবংস হয়ে গেছে দুর্নীতি বা করাপ্শন-এর চোরাবালিতে ডুবে৷ সমাজ জীবনের এই মারণ ব্যাধি অতিমারী থেকে মুক্তি পেতে চিন্তা-ভাবনা, নিয়মনীতি, আইন-কানুন কম হয়নি, তদন্ত কমিশনও কম বসেনি৷ কাজের কাজ কিছুই হয়নি, সমস্যা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই আছে৷ বরং আজকাল দুর্নীতিবাজেরা দুর্নীতিকে আড়াল করতে বৈজ্ঞানিক কৃৎকৌশল-এর আশ্রয় নিয়েছে, নিচ্ছে৷ এখন তো বৌদ্ধিক-অনৈতিক প্রশ্রয়ে, অসুস্থ-প্রতিযোগিতার দৌড়ে টিকে থাকতে, অসম-জীবনযুদ্ধে অস্তিত্ব রক্ষা করতে করাপ্শন একটা শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছিয়েছে, এটা একটা বুক বাজিয়ে বলার আর্ট না পারাটাই যেন বোকামির পরিচয়---আজকাল এটা একটা যেন সেকেলে ‘মিডিল ক্লাস-পিউরেটিয়ান-গুডি’ গুডি-ঠুনকো সেন্টিমেন্ট মাত্র৷ অনেকে তো গর্ব করে বলে---আমার অমুকের কাজে তো বিস্তর উপরি রোজগার আছে, যার পর নাই সে আধুনিক আর স্মার্ট৷ নীট ফল দাঁড়িয়েছে---আজকাল ঘুষ দেয়া-নেয়া, কাটমানি খাওয়াটা কৃতিত্বের ব্যাপার৷ বদ্ধ-দুষিতপুকুরের সব বিন্দুর পচা জলের মত করাপশন নামক কর্কট ব্যধিটা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধেছে, সর্বত্র তার শিকড় ছড়িয়ে পড়িয়েছে৷ ব্যষ্টি থেকে সমাজ বা সমষ্টি, সরকার থেকে শাসক দল ও বিরোধীদল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে মিশনারী মায় সমাজসেবী প্রতিষ্ঠান ও কৃষি-শিল্প-খনি-বন-সামুদ্রিক সম্পদ আহরন-ব্যবসা বাণিজ্যাদি প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে দুর্নীতির বা করাপশনের কালো বোরখার উপস্থিতি৷ ‘গীতা’য় শ্রীকৃষ্ণ একেই বলেছেন ‘ধর্মের গ্লানি’ অর্থাৎ ‘ধর্মচ্যুতি’৷ অথচ ধর্মই সমাজ বন্ধনের মৌল সূত্র বা উপাদান, সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে চলার অদৃশ্য বিনে সুতোর মেলবন্ধন৷ তাই সমাজ থেকে শ্রীকৃষ্ণোক্ত ‘ধর্ম’ হারিয়ে গেলে সমাজটা আর সমাজ থাকে না, করাপটেডদের খোঁয়াড়ে পরিণত হয়৷ বর্তমান বাঙলা, ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীটাই তার জাজ্বল্যমান নজির৷
দুর্নীতি নিয়ে কথা বলতে গেলে শ্রীকৃষ্ণের ধর্ম ভাবনা নিয়ে কিছু আলোকপাত করা দরকার৷ বিজ্ঞানসিদ্ধ বিচারে ‘ধর্ম’ হচ্ছে জড়-অজড়, চেতন অচেতন-অবচেতন, অতিন্দ্রীয় প্রতিটি সত্তারই বৈশিষ্ট্য বা গুণ৷ ইংরেজীতে একেই বলে প্রপার্টি বা ক্যারেক্টরিস্ট৷ তবে ইংরেজি ‘রিলিজিয়ন আর বাংলা বা সংস্কৃত ধর্ম শব্দটি সমার্থক নয়৷ বাংলায় ধর্মের প্রতিশব্দরূপে আরবী ‘ইমান’ শব্দটি চলতে পারে৷ ‘রিলিজিয়ন’-এর বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে---‘ধর্মমত’, আরবিতে---‘মজহব্’৷ বলাবাহুল্য, ধর্ম বদলালে কোন সত্তার অস্তিত্বই থাকে না৷ তাই মানুষ যদি তার ধর্ম---যা বৃহতের প্রতি এষনা অর্থাৎ মানুষ যা চায় তা অনন্তভাবে চায়, এক কথায় ‘মানবধর্ম’---তা ত্যাগ করে তাহলে মানুষ আর মানুষ থাকে না, মানুষ ছাড়া অন্য জীব--- মানুষ দেহধারী পশুতে পরিণত হয়, আর করাপশন্ তাকে গ্রাস করে, ও করাপশনের প্রতি অন্যায় বোধটাই হারিয়ে যায়--- কোন বিচারশীলতা থাকে না৷ তাই মানুষের থেকে যদি তার ধর্ম ছেড়ে যায় বা তার ধর্মের পরিপূর্ত্তির বা ধর্মপিপাসা মেটানোর সঠিক রাস্তা না থাকে তবে ব্যষ্টি মানুষের ও তার সমাজের বিনাশ অনিবার্য৷ বলা বাহুল্য, মানুষ তার ‘প্রপাটির’ স্ফূরণের রাজপথ না পেলে বা না জানলে, অলি-গলিতে ঢুকবে---আর সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতি তাকে গ্রাস করে বসবে৷ নির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ আকার আয়তনের পার্থিব জগতে পার্থিব সম্পদ সীমিত৷ তাই কেউ যদি সত্তাগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী অনন্ত ক্ষুধা মেটাতে মনটাকে ‘আরো চাই আরো চাই করে ‘পার্থিব সম্পদের দিকে ছুটিয়ে দেয়--- সব সম্পদ কুক্ষীগত করতে চায়--- তবে তো অন্যদের না-ঠকালে না বঞ্চিত করলে তা কিভাবে সম্ভব! অর্থাৎ দুর্নীতির আশ্রয় তাকে নিতেই হবে৷ একই ভাবে অসীম ক্ষমতা, মান-খ্যাতি-যশ, প্রতিপত্তি, প্রভাব, দোর্দণ্ড প্রতাপাদির অধিকারী হওয়া করাপশনের দাস হওয়া ছাড়া সম্ভব নয়৷
মানুষের সত্তাগত বৈশিষ্ট্য বা স্বভাব ধর্ম ছাড়াও আরো একটি ধর্ম আছে তা হচ্ছে সামাজিক পরিচয়গত ধর্ম৷ মানে হল---সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে একই মানুষের এক একটা বৈয়ষ্টিক পরিচয় আছে, সঙ্গে আছে সামাজিক পরিচয়---আর আছে তার আলাদা আলাদা ধর্ম৷ যেমন বৈয়ষ্টিক পরিচয়ে কোন লোক একাধারে ঠাকুরদা, দাদু, বাবা, জ্যাঠা, কাকা মামা, দাদা, ভাই, দেওর, ভাসুর, বোনপো, ভাইপো,শ্যালক, নিকট, আত্মীয়, বন্ধু বা প্রতিবেশী গৃহী, সন্ন্যাসীও হতে পারেন৷ একই ভাবে কোন নারী একাধারে ঠাকুরমা, দিদিমা, মা, মাসি, পিসি,জ্যেঠি, দিদি,বোন, বোনঝি, ভাইঝি, বৌদি,ননদ,জা, শ্যালিকা, গৃহিনী, সন্ন্যাসিনীও হতে পারেন৷ অন্যদিকে সামাজিক পরিচয়ে বা পেশাগত পরিচয়ে মানুষ হতে পারে কর্ষক, রাজা, সম্রাট, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, মোক্তার, জজ,ব্যারিষ্টার, আমলা,রাজনীতিবিদ, সমাজসেবী, শাসক-প্রশাসক, পুলিশ, সেনা, হকার, ড্রাইভার, রিকসা-টোটো-ম্যাজিক-অটো চালক, কেরানি,আধিকারিক, মুৎসুদ্দি, ম্যানেজার, পরিচারক- পরিচারিকা, শিক্ষক-অধ্যাপক ইত্যাদি৷ সকলেই নিজ পেশার একটা ধর্ম আছে৷ সমাজ তথা মানুষ সকলেরই কাছ থেকে নিজ নিজ সামাজিক অবস্থানে ধর্ম পালনের প্রত্যাশা করে৷ অবশ্য এখানে ‘ধর্ম কথাটির মধ্যে তিনটি বৈশিষ্ট্য লগ্ণ হয়ে আছে৷ যেমন-কর্তব্য দায়বদ্ধতা ও নিঃস্বার্থ বা অপাপবিদ্ধ ভালবাসায় সেবা৷ দুর্ভাগ্যের বিষয়---সিংহভাগ ক্ষেত্রেই মানুষের স্ব-ধর্ম থেকে বিচ্যুতি সমাজে বিপর্যয় ডেকে এনেছে৷ ফলে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে৷ শ্রীকৃষ্ণ ‘ধর্মসংস্থাপনা’ সংকল্পে মানুষের ধর্মের এই উভয় দিকেই দৃষ্টি দিয়েছিলেন৷ কাজেই মানুষকে তার স্ব-ধর্মে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে সমাজ থেকে বা মানুষের মন থেকে করাপ্শন্ যাবে না৷ মানুষের নিজ নিজ অবস্থানে স্থান-কাল-পাত্রে সাম্য অবস্থায় বাঁচা ও বিকাশ উদ্বর্তনায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাওয়া ও পাওয়ার লাগাম ছাড়া আকাঙ্খাকে আমরা বলি ‘লোভ’৷ আর কোন বস্তু বা বিষয়ের প্রতি অপ্রয়োজনীয় অস্বাভাবিক অনুরাগকে আমরা বলি, ‘‘লালসা’ বা ‘আসক্তি’৷ স্ব-ধর্মে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত না হলে এই লোভ ও আসক্তি মানুষকে সহজেই ধর্মচ্যুত করে, মানুষ দুর্নীতির পাঁকে তলিয়ে যায়৷
তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে দুর্নীতি বা করাপশ্নের বীজ ও শিকড় মানুষের মনে৷ শুধু বাইরের কড়া-শাসন, তীক্ষ্ম সদাজাগ্রত নজরদারী দিয়ে কাজ হবে না৷ মন থেকে করাপশনের শিকড়টা উপড়ে ফেলতে না পারলে দুর্নীতি দমন আদৌ সম্ভব নয়৷ দ্বিমুখী সাঁড়াশি অভিযান দরকার৷ তাই চাই একদিকে এক্সটারনাল্ প্রেসার, অন্যদিকে আধ্যাত্মিকতা-অনুসারী ইন্টারন্যাশনাল্ আর্জ সৃষ্টি করা অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের ভাবনায় ‘ধর্মসংস্থাপনায়’৷
এতো গেল করাপশনের ভাবাদর্শগত গোপন রহস্য৷ এবার বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা পরখ করা যাক৷ আধুনিককালে করাপশন বা দুর্নীতি বলতে বোঝায়---কোন মানুষের বা পদাধিকারীর বা সমাজ বন্ধুর ইচ্ছাকৃতভাবে ও উদ্দেশ্য-প্রণোদিত হয়ে লোভের বশে ক্ষুদ্র ব্যষ্টি স্বার্থে অন্যদের বঞ্চিত করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পদ, সামাজিক প্রতিষ্ঠা, সম্পদ কুক্ষীগত করা৷ কেবল পার্থিব সম্পদের বেআইনী আত্মসাৎই নয়, ---ক্ষমতা পদমর্যাদা-যোগ্যতা-দায়ভার কর্তব্যের অপব্যবহার ও নিয়ম বর্হিভূতভাবে ক্ষমতা -মর্যাদা-প্রভাব, প্রতিপত্তি বৃদ্ধিও দুর্নীতি বা করাপশন৷
‘করাপশন’ বা দুর্নীতি কথাটার সঙ্গে নৈতিকতা জড়িয়ে আছে৷ ‘অক্সফোর্ড’ ইংরেজী অভিধান অনুযায়ী করাপশনের তিনটি রূপ---*ভৌতিক---অর্থাৎ দায়িত্বে থেকে অস্বাস্থ্যকর নোংরা পরিবেশে রেখে কোন কিছু ভেঙে চুরে বিকৃতি ঘটিয়ে বা পচিয়ে নষ্ট করা বা ধবংস করা৷ *নৈতিক---ঘুষ নিয়ে বা পক্ষপাতিত্ব করে দায়িত্ব কর্তব্যে বিচ্যুতি---সঠিকভাবে পালন না করা৷ ও বিপথ গামিতা (পারভারশন্)---প্রকৃত ও বিশুদ্ধ অবস্থা থেকে কোন কিছুর রূপ বিকৃত করা বা পালটে দেয়া৷
এখন প্রশ্ণ হচ্ছে---বিচারশীল হয়েও মানুষ কেন দুর্নীতির জালে জড়িয়ে পড়ে? সমাজেই বা কেন দুর্নীতি বা করাপশন হয়৷ এ বিষয়ে ‘পঞ্জাব এ্যাড্মিনিষ্ট্রেটিভ্ রিফর্মস কমিশন’ কতগুলো কারণের কথা উল্লেখ করেছে৷ যথা---১) বেসামরিক ও সরকারি কর্মচারীদের (সিভিল সার্ভেন্টস্) যথোপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাব৷ ২) কম মাইনে৷ ৩) নজরদারীতে দক্ষতা ও কড়াকড়ীর অভাব বা নজরদারীতে শৈথিল্য ও দক্ষতার অভাব৷ ৪) আধিকারিকদের ওপর রাজনৈতিক মাতববরি৷ ৫) কর্মপদ্ধতিতে জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা৷ ৬) আধিকারিকদের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ৷ ৭) জনমতের প্রবলতা না থাকা (পুওর পাবলিক ওপিনিয়ন)৷ ৮) করাপশনের বিরুদ্ধে জনগণের অভিযোগে অনীহা৷
সাধারণ দৃষ্টিতে করাপশনের পিছনে আরো কতগুলো অবস্থা দায়ী৷ যথা---১ দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত বা নৈতিকতা বর্জিত রাজনীতি৷ বলাবাহুল্য, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ফলে সমাজের ওপরতলার থেকে নীচতলা পর্যন্ত দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে৷
২) অনেকক্ষেত্রেই সরকারী ব্যবস্থাপনায় (পাবলিক ডিলিংস) গোপনীয়তা ও অসচ্ছ্বতা (ল্যাক্ অব্ ট্রান্সপারেন্সি) দুর্নীতির জন্ম দিয়েছে৷ ৩) পাবলিক অফিসিয়ালসদের আয় পরিসম্পতের (এ্যাসেট্স) পরিমাণ কত--- তা হিসাব দেওয়ার বা জানানোর কোন নিয়ম, আইন বা বাধ্যবাধকতা নেই৷ (ক্রমশ)
- Log in to post comments