গত ১৪ই ফেব্রুয়ারী ২০১৯ বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ কশ্মীরের জম্মু থেকে শ্রীনগর যাওয়ার সময় পুলওয়ামার অবন্তীপোড়ায় সি.আর.পি. জওয়ানদের ৭৮টি গাড়ীর কনভয়ের ওপরে গাড়ীবোমার দ্বারা আত্মঘাতী হামলা চালায় আদিল আহমেদ ওরফে ওয়াকাস নামে এক জৈশ-ই-মহম্মদ জঙ্গী৷ সংবাদে প্রকাশ, ২৫৪৭ জন সি.আর.পি. জওয়ান সহ ৭৮টি গাড়ীর কনভয়ের দু’টি বাসের মাঝখানে জম্মু-শ্রীনগর জাতীয় সড়কের ওপর বিপুল পরিমাণে বিস্ফোরক ঠাসা একটি স্করপিও গাড়ী ধাক্কা মারে৷ ফলে প্রবল বিস্ফোরণ হয় ও একটি বাসে আগুন ধরে যায়৷ এছাড়া সি.আর.পি.-দের লক্ষ্য করে গুলি ও গ্রেনেড ছোঁড়া হয়৷ তথ্যাভিজ্ঞদের মতে এতবড় গাড়ী বোমার হামলা ইতোপূর্বে আর হয়নি৷ এর আগে ২০০১ সালের ১ অক্টোবর জম্মু-কশ্মীর বিধানসভায় গাড়ী বোমার হানা সংঘটিত হয়েছিল৷ পুলওয়ামার ঘটনায় ৪৯ জন সি.আর.পি. জওয়ান নিহন হন---তার মধ্যে দুই জন বাঙালী, হাওড়ার বাউরিয়ার চককাশী রাজবংশী পাড়ার বাবলু সাঁতরা (৩৯ বৎসর) ও নদীয়ার তেহট্টের পলাশী পাড়ার হাঁসপুকুরিয়া তিলিপাড়ার সুদীপ বিশ্বাস (২৭ বৎসর) ছিলেন৷ এই ঘটনার অভিঘাতে আমরা, প্রতিটি ভারতবাসী মর্মাহত, শোকসন্তপ্ত---একই সঙ্গে ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ৷ স্বাভাবিকভাবেই এই শোক, ক্ষোভ ও ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ সারা দেশেই বিভিন্ন ভাবে প্রদর্শিত হচ্ছে৷ এই কাপুরুষোচিত হিংস্রতার নিন্দার ভাষা নেই বললেই চলে৷ নিহত জওয়ানদের আত্মীয়-পরিজনদের প্রতি সমগ্র দেশবাসী জানাচ্ছে সমবেদনা ও সহানুভূতি৷ ওই সব জঙ্গীর দল যতই নিজেদের বীর জেহাদী বলে গৌরবান্বিত মনে করুক না কেন, এর দ্বারা মানব জাতির কোনও কল্যাণ সাধিত হবে না---ইতিহাস তাদের কখনই ক্ষমা করবে না, আস্তাকুঁড়েই হবে তাদের স্থান৷ সাধারণ দেশবাসী ও মানুষ হিসেবে অবশ্যই আশা করব, এইসব জঘন্য কর্মকাণ্ডে লিপ্ত নরপশুদের পেছনে যাদের সহযোগিতা ও সক্রিয়তা রয়েছে সেই সব নরপিশাচদের যথোচিত শাস্তি অবশ্যই হবে৷ এই আত্মঘাতী হামলার চারদিন পর পুলওয়ামারই পিংলান গ্রামে লুকিয়ে থাকা জঙ্গীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হয়েছে তিনজন জৈশ জঙ্গী৷ অবশ্য এই অভিযানে সেনাবাহিনীর একজন মেজর সহ চারজন সেনা, জম্মু-কশ্মীর পুলিশের একজন হেড কনস্টেবলও নিহত হন৷ দু’পক্ষের গুলির লড়াইয়ের মধ্যে পড়ে নিহত হন একজন নাগরিক৷ সেনাবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ার, পুলিশের ডি.আই.জি. সহ দশজন আহত হন৷ এই সংঘর্ষ চলে প্রায় ১৮ ঘণ্টা৷
এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের অর্থাৎ দেশবাসীদের অত্যন্ত সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে যাতে আমাদের দিক থেকে ওই সব নরপিশাচেরা কোনরকম প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রশ্রয়, প্রেরণা ও সহযোগিতা না পায়৷ সেই সঙ্গে প্রশাসন ও নিরাপত্তা বিভাগকে যথোচিত সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যেন এই ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে৷ মনে রাখতে হবে, সন্ত্রাসবাদীদের কোনও ধর্ম, জাত বা দেশ হয় না---তারা শুধুই সন্ত্রাসবাদী ও মানুষের অনিষ্টসাধনকারী৷ গত তিন বছরে ২০১৬ সালের ২রা জানুয়ারী পাঠানকোটের বায়ূসেনা ঘাঁটিতে, সেই বছরেরই ২৫ জুন জম্মুর পাম্পোরে জম্মু-শ্রীনগর সড়কে সি.আর.পি.র কনভয়ে ও ১৮ই সেপ্ঢেম্বর বারামুলার উরির সেনাঘাঁটিতে জঙ্গী হানা হয়েছে৷ এছাড়াও ওই সব ঘটনার আগে-পড়ে বহু ছোট বড় হানা-হামলা হয়েছে৷ পুলওয়ামা ঘটনার মতই ওই সব ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রেও দেখা গেছে সতর্কতার শৈথিল্য, সচেতনতার অভাব ও গোয়েন্দা বাহিনীর ব্যর্থতা৷ যার ফলে সময়োচিত ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব না হওয়ায় আমাদের দেশ বহুবিধ ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে---কারোর পিতা-মাতা হারিয়েছে সন্তান,স্ত্রী হারিয়েছে স্বামী, পুত্র-কন্যা হারিয়েছে পিতা৷ দেশও হারিয়েছে তার অমূল্য বীর সন্তান-সন্ততি ও বিপুল অস্ত্র-শস্ত্র, গোলা-বারুদ ইত্যাদি৷ সংবাদ মাধ্যমগুলি থেকে জানা যায় যে গত ৮ই ফেব্রুয়ারী জঙ্গী হানা সম্পর্কে গোয়েন্দাবাহিনী সতর্কতা জারি করে, কিন্তু সেটিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে যে মাত্রায় সতর্কতা গ্রহণ করা উচিত ছিল তা হয়নি৷ প্রথমতঃ ৭৮টি গাড়ীর এত বড় কনভয় দীর্ঘ সময় ধরে শ্রীনগরগামী রাস্তা জুড়ে চলেছিল৷ দ্বিতীয়তঃ কনভয় চলার সময়ে পাশ্ববর্তী জম্মুগামী রাস্তা খোলা থাকায় সেই কনভয়ের গতিবিধি , অবস্থান সম্পর্কে জঙ্গীদের মধ্যে খবরাখবরের আদান-প্রদান ও হিসেব কষে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে হামলা চালানো সহজ হয়েছিল৷ তৃতীয়তঃ যে গাড়ীটি আত্মঘাতী হামলায় ব্যবহার করা হয়েছিল, তাতে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক বোঝাই থাকায় গাড়ীটি একটি বিশালাকার বোমা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল৷ কশ্মীরের মত জঙ্গীক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রে সংবেদনশীল রাজ্যে যেখানে নিরাপত্তা বাহিনী, সেনাকর্মী ও গোয়েন্দা বাহিনী সক্রিয় থাকা সত্ত্বেও এত বেশী পরিমাণে বিস্ফোরক মজুদ করা ও নাশকতায় ব্যবহার করার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া, স্থানীয় মানুষজনের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও প্রশ্রয় ছাড়া সম্ভব নয়৷ এটিও গোয়েন্দাদের ব্যর্থতার পরিচায়ক৷ অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে জঙ্গীদের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক অত্যন্ত নিখুঁত ও শক্তিশালী---যার ফলে প্রত্যেকটি জঙ্গী হানার ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদীরা পরিকল্পনামাফিক টার্গেটে আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে৷ এমতাবস্থায় দেশের সুরক্ষার বিষয়ে আরো বেশী সর্তকতা ও গণসচেতনতা অবলম্বন করা অতীব প্রয়োজন৷
সন্ত্রাসবাদ দীর্ঘকাল থেকেই সমগ্র পৃথিবীর এক জটিল সমস্যা৷ ভারতবর্ষ, পাকিস্তান, আফগান্তিান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, মায়ানমার, প্যালেষ্টাইন, সিরিয়া ইত্যাদি দেশগুলির ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ অভিশাপ স্বরূপ৷ ইতোপূর্বে আমেরিকা, ব্রিট্রেন, ফ্রান্স প্রভৃতি উন্নত দেশগুলিও সন্ত্রাসবাদী হানার শিকার হয়েছে৷ সন্ত্রাসবাদী ক্রিয়াকলাপের কারণগুলির মধ্যে কয়েকটি হ’ল--- অর্থনৈতিক ও সামাজিক অসাম্যের কারণে দীর্ঘদিনের বঞ্চনা ও শোষণ,অশিক্ষা, কুশিক্ষা, ভাবজড়তা, কুসংস্কার, ধর্মমতান্ধতা, জাতি বা গোষ্ঠীগত গরিমা ও কৌলিন্য প্রদর্শনের প্রবণতা, ব্যষ্টিগত অহমিকা ও অন্যদের থেকে নিজেদের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-আন্তর্জাতিক ও সামরিক শক্তির ক্ষেত্রে উচ্চস্থানে প্রতিষ্ঠার মানসিকতা, রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা পূরণ ও স্বার্থরক্ষার তাগিদ ইত্যাদি৷
বৈশ্যতান্ত্রিক পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় সম্পদ বণ্টনের চরম অসাম্যের ফলে কোন জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত ও শোষিত হতে থাকলে তাদের মধ্যে যে ক্ষোভ ও হতাশা জন্ম নেয়, তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে হিংসা ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে৷ এক শ্রেণীর চতুর মানুষ, বিভেদকামী বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি ও সংঘটন ওই সব জনগোষ্ঠীর অশিক্ষা-কুশিক্ষার সুযোগ নিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে তাদের ব্যবহার করে ও বিপথে চালিত করার চক্রান্তে সামিল হয়৷ এসব ক্ষেত্রে ধর্মমতান্ধতাজনিত ভাবজড়তা, গোঁড়ামি ও কুসংস্কার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে৷ এছাড়া কোন কোন অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিধর রাষ্ট্রনায়কদের সাম্রাজ্যবাদী প্রবণতা ও প্রভুত্বের মানসিকতা সন্ত্রাসবাদকে তাদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে৷ আধুনিক পৃথিবীতে পারমানবিক শক্তির যুগে ক্ষমতাশালী যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রনায়কেরা প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অবতীর্ণ না হয়ে বিভিন্ন ভাবে ছায়াযুদ্ধের বিস্তার করে মানুষের রক্তের হোলি খেলে৷
এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে হলে আজ বিশ্বের প্রতিটি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্তরিকভাবে দৃঢ়তার সঙ্গে সরব হতে হবে---যুদ্ধ নয়, রক্ত নয়, শান্তি চাই---সন্ত্রাসবাদের বিনাশ চাই৷ শুধুমাত্র আবাজ তুললেই হবে না, এই উদ্দেশ্যে সদর্থক পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা রচনা করে একদিকে শোষণকে বন্ধ করতে হবে, অপরদিকে সুশিক্ষার বিস্তারের দ্বারা মানুষের মনের অন্ধকার দূর করতে হবে৷ তথাকথিত পুঁজিবাদ ও জড়মুখী সাম্যবাদের দ্বারা পৃথিবীর প্রভূত সর্বনাশ সংঘটিত হয়েছে৷ মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের ঘরে জমেছে সম্পদের পাহাড় ও ভোগ বিলাসের জমকালো রোশনাই আর কোটি কোটি মানুষ হয়েছে শোষণ ও বঞ্চণার শিকার৷ নূ্যনতম প্রয়োজনপূর্ত্তির সংস্থানের অভাবে তারা অনাহারে, অর্দ্ধাহারে কুকুর-বিড়ালের জীবন-যাপন করতে বাধ্য হয়েছে৷ এমতাবস্থায় মানব সমাজকে বাঁচাতে হলে ত্রিমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে৷
প্রথমতঃ জনকল্যাণমুখী অর্থনৈতিক কর্মসূচীকে বাস্তবায়িত করতে হলে ব্লকভিত্তিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা রচনা করে স্থানীয় সমস্ত উপাদান ও কৃষিজ, বনজ, জলজ, মানব সম্পদের সর্বাধিক উপযোগ গ্রহণ করতে হবে আধুনিক বিজ্ঞান ও গবেষণালব্ধ প্রযুক্তির মাধ্যমে৷ এর দ্বারা সকলের একশত শতাংশ কর্মসংস্থান ও নূ্যনতম প্রয়োজনপূর্ত্তির ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে৷ পরবর্তী পর্যায়ে সব মানুষের ক্রয়ক্ষমতা প্রগতিশীল ভাবে বৃদ্ধির জন্যে সচেষ্ট হতে হবে৷ আর সমগ্র প্রক্রিয়াকে কার্যকর রূপ দেওয়ার জন্যে সমবায় প্রথাকে (উৎপাদক সমবায়, উপভোক্তা সমবায় ইত্যাদি) কাজে লাগিয়ে পুঁজিবাদী ও সাম্যবাদী অর্থনীতির রোগগুলি নিরাময় করা সম্ভব হবে৷ এই উদ্দেশ্যে সত্যদ্রষ্টা মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার প্রবর্তন করেছেন প্রাউট দর্শন বা প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব৷ প্রাউটের নীতি অনুযায়ী, পরমপিতা পরমব্রহ্মই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত সম্পদের মালিক ও সেই সম্পদে সমগ্র সৃষ্টিরই সমান অধিকার রয়েছে৷ সকলেই এই সম্পদের যুক্তিসঙ্গত বণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে ভোগ দখলের অধিকারী৷ সামবায়িক সংস্থার সুষ্পষ্ট অনুমোদন ব্যতিরেকে এই সম্পদ কেউ সঞ্চয় করতে পারবে না, কারণ কেউ অতিরিক্ত সম্পদ সঞ্চয় করলে অন্যেরা বঞ্চনার শিকার হতে বাধ্য৷ প্রাউটের মূলনীতিকে বাস্তবায়ন ও সমাজ পরিচালনার দায়িত্বে ও নেতৃত্বে থাকবেন নীতিবাদী, আপোষহীন কঠোর চারিত্রিক গুণবিশিষ্ট আধ্যাত্মিকতায় সমুন্নত ব্যষ্টিবর্গ যাদের বলা হয় সদ্বিপ্র৷ এই সমাজ ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক, সামাজিক বা অন্য কোনওরকম শোষণ ও অবদমনের প্রচেষ্টাকে কোনওভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া হবে না৷
দ্বিতীয়তঃ জড়মুখী শিক্ষার পরিবর্তে নব্যমানবতাবাদী শিক্ষানীতি অবলম্বন করতে হবে৷ সমগ্র সৃষ্টিই পরমপিতার সৃষ্ট---তাই সকলের প্রতি সমতাভাবই নব্যমানবতাবাদের মূল নীতি৷ সমস্ত জীব-জড় উদ্ভিদের কল্যাণে উন্নত জীব মানুষকে দায়িত্ব নিতে হবে কারণ পরিবেশগত সন্তুলন ও জীবন ধারণের জন্যে মানুষকে অন্যান্য জীবজন্তু, উদ্ভিদ ও জড় পদার্থের ওপর নির্ভর করতে হয়৷ নব্যমানবতাবাদী শিক্ষা মানুষকে কোন নির্দিষ্ট সীমার গণ্ডীতে আবদ্ধ না রেখে উদার বিশ্বৈকতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল সৃষ্টির প্রতি ভালবাসা ও প্রেম জাগায়৷ বিশ্বপ্রেমের এই ভাবনাই মানুষকে শেখায়---জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে যার নাম মানুষ জাতি৷ তাই মানুষের সমাজ এক ও অবিভাজ্য৷ এখানে কোনও ভেদাভেদ চলতে পারে না৷ স্থান, পরিবেশ, জলবায়ু ভেদে মানুষের গাত্রবর্ণ, উচ্চতা, শরীরের গড়ন, পোষাক-পরিচ্ছদ, আচার-ব্যবহার, ভাষা-সংস্কৃতি ভিন্ন হলেও মূলত সকলেই এক ও মানুষের ভিন্ন ভিন্ন রূপ৷ তাই কারো মহামন্যতা বা হীনমন্যতার প্রশ্ণ নেই, সকলেই বিশ্বপিতার সন্তান-সন্ততি৷
তৃতীয়তঃ প্রতিটি মানুষের ধর্ম এক আর তা হ’ল মানব ধর্ম৷ মানুষ জাতিকে বিশেষ বিশেষ ধর্মমতের গণ্ডিতে বেঁধে বিভক্ত করার অপচেষ্টা অমানবিক, অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক ও অন্যায়৷ প্রতিটি মানুষ সুখ চায়---অনন্ত সুখ চায়, আনন্দ চায়৷ অনন্তম্ সুখম্ আনন্দম্৷ মানুষের এই অনন্ত সুখ চাওয়ার অসীম তৃষ্ণাকে তৃপ্ত করা সীমিত ভৌতিক সম্পদের পক্ষে সম্ভব নয়৷ তাই ভৌতিক সম্পদের সুষম যুক্তিসঙ্গত বণ্টনের দ্বারা মানুষের ভৌতিক প্রয়োজন মিটিয়ে তার অসীম তৃষ্ণাকে অনন্ত মানসিক ও আধ্যাত্মিক জগতে পরিচালিত করতে হবে আর একমাত্র সেই পথেই মানুষের মনে শান্তি আসবে৷ এই পথের সন্ধান দিয়েছেন মহাসম্ভূতি তারকব্রহ্ম শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী তাঁর আধ্যাত্মিক দর্শন ‘আনন্দমার্গ’-এর মাধ্যমে৷ আনন্দমার্গের সাধনা পদ্ধতি মানুষকে ক্রমশঃ বৃহতের ভাবনায় ভাবিত করে বৃহতের এষণায় এগিয়ে চলতে সাহায্য করে৷ অষ্টাঙ্গিক যোগ সাধনা---যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধির দ্বারা মানুষের মন নিয়ন্ত্রিত ও ব্রহ্মমুখী হয়৷ এর ফলে হিংসা, দ্বেষ বা ভেদ-ভাবনা মানুষের মনে স্থান পায় না৷ সমাজও ক্রমশঃ ‘শান্তির নীড়’-এ পরিণত হয়৷ তাই শুধুমাত্র শান্তির বাণী বিতরণ না করে উপর্যুক্ত ত্রিমুখী প্রচেষ্টার মাধ্যমে মানব সমাজকে শোষণমুক্ত, কুশিক্ষা-অশিক্ষার অভিশাপমুক্ত ও হিংসা, সন্ত্রাসমুক্ত মানুষের সমাজ তথা পৃথিবীতে পরিণত করার নিরলস প্রয়াস চালাতে হবে৷ আর এই উদ্দেশ্যে সকল শুভ-চেতনাসম্পন্ন মানুষকে আন্তরিক ও সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বকে হিংসা, সন্ত্রাস ও শোষণহীন করে নোতুন পৃথিবী প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসতেই হবে৷
- Log in to post comments