আমাদের দেশে এখন ‘ক্যাশ সেল’ আর ‘ক্যাশলেস সেল’ নিয়ে নানান পর্যালোচনা চলছে৷ আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠছে৷ দুটো পদ্ধতিই কম-বেশী প্রয়োগ হচ্ছে৷ এখন প্রশ্ণ এই ‘ক্যাশ সেল’ বা ক্যাশলেস সেল’-এর সুবিধা-অসুবিধাগুলি কী কী? অর্থনীতিতে এদের ব্যবহারিক প্রয়োগে কি ধরণের প্রভাব পড়ছে ও তা দেশের পক্ষে কতখানি মঙ্গলজনক?
আজ থেকে আড়াই বছর আগে ‘ক্যাশলেস সেল’ ব্যাপারটা আমাদের মধ্যে আসেনি৷ তখন ‘ক্যাশ সেল’ই ছিল দ্রব্যাদির কেনা-বেচায়৷ ‘ক্যাশ সেল’ মানে কোন দ্রব্য বা পরিষেবা নিতে গেলে টাকা দিয়ে সেই দ্রব্য বা পরিষেবার মূল্য প্রদান করতে হবে৷ অর্থাৎ বিনিময়ের মাধ্যম হ’ল ‘ক্যাশ’ বা টাকা৷ অনেক ক্ষেত্রে ‘চেক’-এর ব্যবহারও হ’ত ও হয়ে আসছে---মানে একটি কাগজের মাধ্যমে যত খুশী টাকা বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার৷
কিন্তু ‘ক্যাশলেস’ যখন প্রযোজ্য হচ্ছে যখন কাগজের টাকা বা ধাতুর মুদ্রার ব্যবহার একেবারেই বন্ধ৷ অবশ্য আবঁরিক অর্থে চেকের ব্যবহার এক ধরণের ‘ক্যাশলেস’-ই বলা চলে৷ তবে ভারতীয় ক্রয়-বিক্রয় ব্যবস্থায় যে ‘ক্যাশলেস’-এর কথা বলা হচ্ছে তা যদি সম্পূর্ণ ভাবে ব্যবহার হয় তবে ‘চেক’-এর ব্যবহারও সম্পূর্ণভাবে বন্ধ বা নিষিদ্ধ৷
আমাদের দেশে বহুযুগ ধরে চলে আসা ‘ক্যাশ’ বা ‘চেক’-এর ব্যবহার বন্ধ করে এই ‘ক্যাশলেস’-এর ব্যবহারিক প্রয়োগের কথা বলা হচ্ছে কেন? এ বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে৷
প্রথমতঃ ‘ক্যাশলেস’ ব্যাপারটা ক্রয়-বিক্রয় বা পরিষেবার বিনিময়-মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হলে যে পদ্ধতি প্রয়োগ হবে তা সম্পূর্ণ যন্ত্রের মাধ্যমে করতে হচ্ছে৷ স্মার্ট ফোন, ডেবিড কার্ড, ক্রেডিট কার্ড প্রভৃতির ব্যবহার হবে সম্পূর্ণ ইণ্টারনেটের সহায়তায়৷ এই পদ্ধতি প্রয়োগ হলে অতি ক্ষুদ্র বিনিময়ের ব্যাপারটি তথ্য হিসেবে সরকারের নথিভুক্ত হয়ে থাকছে৷ ফলে বিক্রেতা সরকার নির্ধারিত কোন দ্রব্যের মূল্য নিজের ইচ্ছামত বাড়িয়ে ক্রেতার থেকে বেশী মূল্য বিক্রেতা নিতে পারবেন না---নিলে সেটি অপরাধ বলে বিবেচিত হবে৷ আবার বিক্রীত দ্রব্যের জন্যে সরকারকে যে কর দিতে হয় বিক্রেতা সেই জায়গায় কারচুপি করে সরকারকে সেই কর ফাঁকি দিতে পারবেন না৷ এই ‘কর’-ই সরকারের একটি আয়ের উৎস যা দিয়ে সরকার দেশ পরিচালনা করে৷ আর তথ্য বলছে আমাদের দেশে যে কর ফাঁকি হয় তা দেশের পক্ষে যথেষ্ট অমঙ্গলজনক৷ সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে এই কর ফাঁকির জন্য দেশের সাধারণ মানুষের খাদ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, স্বাস্থ্য পরিষেবায় ব্যাপক বাধা আসে৷ এ বিষয়ে একটি কাল্পনিক উদাহরণ দেওয়া যাক৷ ধরা যাক ‘হিন্দুস্থান ষ্টোর’ নামে একটি বড় সংস্থা বাজারে বহু দ্রব্যাদি বিক্রয় করে৷ সেই সংস্থা তার একটি দ্রব্য---যার মূল্য ১ টাকা, সেই দ্রব্যটি ১ দিনে ১ কোটি পরিমাণ বিক্রয় করল৷ সেই সংস্থার কাছে ১ দিনে ১ কোটি টাকা হাতে এল৷ সেই ১ কোটি টাকার সরকার নির্ধারিত বিক্রয় কর যদি ১ লক্ষ টাকা হয়, আর সরকার যদি জানতে না পারেন যে ১ কোটি টাকার দ্রব্যাদি বিক্রয় হয়েছে তাহলে সেই ‘হিন্দুস্থান ষ্টোর’-এর মালিক এক দিনে সরকারকে ১ লক্ষ টাকা ফাঁকি দিল৷ অর্থাৎ বহু মানুষের কর বাবদ সরকারের সংগৃহীত অর্থ একটি সংস্থা বা একজন মাত্র মানুষের কাছে পৌঁছে গেল৷ এইভাবে প্রতিনিয়ত লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা কর ফাঁকি হওয়ার ফলে সরকারের পক্ষে দেশ পরিচালনায় দারুণ অসুবিধা সম্মুখীন হতে হচ্ছে আবার অন্য দিকে দেশের সম্পদের একমুখী প্রবাহ চলছে৷ ফলস্বরূপ সমাজের একটি অংশ যা সংখ্যায় নগন্য হলেও বিপুল অঙ্কের মালিক আর সমাজের বৃহৎ অংশ জীবন ধারণের নূ্যনতম প্রয়োজনগুলিই যোগাড় করতে ব্যর্থ হচ্ছে---বিলাস-ব্যাসন তো দূর অস্ত৷
দ্বিতীয়তঃ ‘ক্যাশলেস’ ব্যবস্থায় টাকা বা মুদ্রার প্রয়োজন না থাকার ফলে সেই টাকা বা মুদ্রা তৈরীর খরচ বাঁচে---এতে শ্রম ও সময় দুইই অনেকটা সাশ্রয় হয়৷ আর সবথেকে বড় কথা ‘কালো টাকা’-র ব্যবহারমুক্ত হওয়ার পক্ষে ‘ক্যাস লেস’ ব্যবস্থা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ৷
তৃতীয়তঃ ‘ক্যাশলেস’ ব্যবস্থায় একই স্থানে থেকে বিভিন্ন কাজ করা যেতে পারে৷ অর্থাৎ ঘরে বসে প্রয়োজনীয় অনেক দপ্তরে না গিয়েও সমস্ত কাজ করা যেতে পারে৷
মোট কথা ‘ক্যাশলেস’ ব্যবস্থায় সব কিছু সুশৃঙ্খলভাবে হলে দেশের সার্বিক উন্নতি সম্ভব৷
উপরের আলোচনায় বোঝাই যায় যে উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে ‘ক্যাশলেস’ ব্যবস্থা যথেষ্ট ইতিবাচক৷ তাহলে ‘ক্যাশলেস’ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এত শোরগোল কেন?
প্রথমতঃ এই ব্যবস্থা সম্পূর্ণ প্রযুক্তি নির্ভর৷ সামান্যতম প্রযুক্তিগত ত্রুটি হলেই এই ব্যবস্থাটি অকেজো হয়ে পড়বে৷ যার ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম নিমেষেই গতিহীন হয়ে পড়ার সম্ভাবনা৷
দ্বিতীয়তঃ সাইবার ক্রাইমকে সম্পূর্ণ মুক্ত করতে না পারলে এই ব্যবস্থা খুবই বিপজ্জনক৷ অর্থাৎ যেহেতু প্রযুক্তির দ্বারা এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সম্পন্ন হতে হবে সেহেতু এই প্রযুক্তিকে সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত হতে হবে৷ প্রত্যেক ব্যবহারকারীর গচ্ছিত টাকার সম্পূর্ণ নিরাপত্তা চাই৷ আজকাল প্রায়ই শোণা যায় ব্যাঙ্কের গচ্ছিত টাকা এটিএমের মাধ্যমে অন্য কেউ তুলে নিয়েছে৷ এই ব্যবস্থায় মুহূর্ত্তের ভুলে বা অমনোযোগিতায় কুচক্রীরা অনেককেই সর্বসান্ত করে ফেলতে পারে৷ সেই কারণে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত শিক্ষার তথা সাবধানতা প্রয়োজন৷ তাছাড়া বাস্তবক্ষেত্রে দেখা গেছে অনেক বয়স্ক ব্যষ্টিদের এই ব্যবস্থায় লেনদেন করতে গেলে কম্পিউটার, ইণ্টারনেট, স্মার্ট ফোন ইত্যাদির ব্যবহার জানতে হবে৷ বয়স্ক ব্যষ্টিদের ক্ষেত্রে এসব শেখা সবসময় সম্ভব হচ্ছে না৷
তৃতীয়তঃ ভারতের মত বিশাল জনসংখ্যার দেশে এই ‘ক্যাশলেস’ ব্যবস্থার প্রকৃত বাস্তবায়ন খুবই কষ্টকর৷ কারণ এই ব্যবস্থায় একটি স্মার্ট ফোন, অথবা কম্পিউটার অবশ্যই জরুরী৷ লেনদেনকারী বিশাল জনসাধারণের প্রত্যেকের কাছে এই ধরণের যন্ত্র না থাকলে প্রত্যেকেই এই ব্যবস্থার মধ্যে আসতে পারবেন না৷
চতুর্থতঃ ‘ক্যাশলেস’ ব্যবস্থার সুবিধা দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নানান অপশন রাখতে হবে৷ ব্যবহারকারী সুবিধাজনক অপশনটি ব্যবহার করবে৷ উদাহণ হিসেবে বলা যায় আমাদের দেশের পাতাল রেলের টিকিট কাটার কার্ডের মত অনেক দেশে এমন কার্ড আছে যে কার্ডের মাধ্যমে রেলের টিকিট, বাজার করার অর্থ প্রদান, রিক্সা বা অটো চালকের অর্থ প্রদান, বাস ট্যাক্সির ভাড়া প্রদান ইত্যাদি বিভিন্ন কাজ করা হয়৷ আমাদের দেশে এমন সুবিধা এখনও তেমনভাবে সৃষ্টি হয়নি৷ ফলে ব্যবহারকারীর ইচ্ছা থাকলেও ‘ক্যাশলেস’ ব্যবস্থা সকলের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়৷ সরকারও ‘ক্যাশলেস’কে বাধ্যতামূলক করতে পারেন না৷
পঞ্চমতঃ এই ব্যবস্থায় কখনোই ইণ্টারনেট পরিষেবা বন্ধ হওয়া ‘হ্যাং’ হওয়া চলবে না৷ ভারতে বাস্তবক্ষেত্রে এই পরিষেবা সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নয়৷
সর্বোপরি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিনিময়ের মাধ্যমের বাস্তব চিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায় উন্নত প্রযুক্তির অধিকারী, ছোট দেশগুলোতে এই ব্যবস্থা সফলভাবে কার্যকর হচ্ছে৷ উদাহরণ হিসেবে জাপান, হংকংয়ের কথা বলা যেতে পারে৷ এই দেশগুলোর লোকসংখ্যা কম ও লেনদেনকারীরা সকলেই শিক্ষিত৷ ফলে সেই সকল দেশে ‘ক্যাশলেস’ ব্যবস্থা যথেষ্ট ফলপ্রসূ৷ এছাড়াও জার্মানীর মত দেশে, যেখানে এই ব্যবস্থার সুবিধা রয়েছে সেখানেও বেশ কিছু মানুষ কিছু পরিমাণ নগদ অর্থ পকেটে রাখেন৷ জানা গেছে অনেক সময়ই ‘ক্যাশলেস ব্যবস্থা’ যান্ত্রিক বা অন্য কোনও ত্রুটির জন্য কার্যকর করা সম্ভব হয় না৷ তখন নগদ অর্থই বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়৷
এছাড়া আমাদের দেশের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী জুন ২০১৮ পর্যন্ত যত অর্থের ‘ক্যাশলেস’-এর লক্ষমাত্রা নেওয়া হয়েছিল, তার অর্ধেকও পূরণ হয়নি৷
প্রয়োগক্ষেত্রে সমস্ত বিষয় পর্যালোচনা করলে এই সিদ্ধান্তে আসাই ঠিক হবে ভারতবর্ষের মত বিশাল দেশে ‘ক্যাশলেস’ ব্যবস্থাকে বাধ্যতামূলক করলে কোটি কোটি দরিদ্র ও অশিক্ষিত জনসাধারণ খুবই অসুবিধার মধ্যে পড়বে৷ তাদের অন্যের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে---এইভাবে একটি নতুন শোষকগোষ্ঠী তৈরী হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে৷ তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত আসলে ‘ক্যাশ সেল’ ও ‘ক্যাশ লেস ব্যবস্থা’ দুইই পাশাপাশি থাকুক৷ এটাই সর্বোত্তম পন্থা৷
- Log in to post comments