‘লবণ’ শব্দের অর্থ হ’ল যে সৌন্দর্য বা লাবণ্য আনায়৷ প্রয়োজন মত লবণ শরীরে গৃহীত না হলে শরীরের সৌকুমার্য ও কমনীয়তা নষ্ট হয়ে যায়৷ এই অর্থেই লবণ শব্দটি তৈরী হয়েছে৷ ‘লবণ’ মানে লক্তপ্রাণ (রক্তপ্রাণ)৷
প্রাগৈতিহাসিক যুগে কোন প্লুটোনিক ভূমিকম্পের ফলে যখন সমুদ্র–মধ্যস্থিত ভূমি ঊর্দ্ধে উত্থিত হয়ে গেছল, সেখানে ওই ভূমির উপরিস্থিত অতি লবণাক্ত জলের স্তর ধীরে ধীরে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ওপর দিককার বালি বা বেলে মাটি বা দোঁয়াশ মাটির নীচে কঠিন ভূ–স্তরের ঊর্দ্ধে গিয়ে আটকা পড়েছিল৷ কালক্রমে সেই অতি লবণাক্ত জল জমাট বেঁধে ভূ–নিম্নস্থ নুনের পাহাড়ে পরিণত হয়৷ সিন্ধু অর্থাৎ সমুদ্রের জলের তলা থেকে এই পাহাড় উদ্ভূত হয়েছিল বলে এদের বলা হত সৈন্ধব পাহাড়৷ আর নুনকে বলা হত সৈন্ধব লবণ৷ গভীর সমুদ্রের জল থেকে প্রাপ্ত এই নুনে তাই ক্যালসিয়াম ও আয়োডিনের মাত্রা বেশী থাকাই স্বাভাবিক৷ নুনের রঙও তাই হয়ে যায় কিছুটা লাল৷
সমুদ্রের জলকে তুলে বাষ্পীভূত করে আমরা কৃত্রিম উপায়ে যে লবণ প্রস্তুত করে থাকি তাকে সাধারণতঃ কর্কচ নুন বলা হয়৷ দেশের উপকূল ভাগে প্রাচীনকাল থেকেই এই কর্কচ নুন প্রস্তুত হয়ে এসেছে৷ দক্ষিণ–চব্বিশ পরগণার স্থানীয় নোনা জল ও নোনা মাটি থেকে এক ধরনের মেটে লবণ তৈরী হত৷ তাকে বলা হত বাদার নুন৷ এই নুনের রঙ ছিল কিছুটা মেটে৷ অর্থাৎ এর সঙ্গে কিছু কিছু মৃত্তিকাজাত রাসায়নিক লবণও থাকত৷ কর্কচ নুন বলতে যা বোঝায়, এই নুন কিন্তু ঠিক তা ছিল না৷ গুণগত বিচারে সামুদ্রিক কর্কচ নুনের চেয়ে এই ক্ষাদার নুন (যদিও তা দেখতে ভাল নয়) ছিল অনেক বেশী স্বাস্থ্যপ্রদ৷ আর এই ক্ষাদার নুনের চেয়ে সৈন্ধব লবণ প্রায় আড়াই গুণ বেশি স্বাস্থ্যকর৷ সৈন্ধব লবণ ব্যবহারে শরীরের অস্থি–মজ্জা দৃঢ় হয়, আয়ুর্বেদ মতে গলক্ষত ও গলগণ্ড রোগের আক্রমণের ভয় থাকে না৷ রক্ত চলাচলের গতি বাড়িয়ে দিয়ে প্রাণশক্তি স্ফূর্ত্ত করবার গুণ সামুদ্রিক লবণ বা কর্কচ লবণের চেয়ে সৈন্ধব লবণের (সন্দক নুন–উত্তর ভারতে ‘সেন্ধা নমক’) বেশী৷
তোমরা হয়ত কখনও কখনও লক্ষ্য করেছ, গাছের ওপর বা পাঁচিলের ওপর বসে বাঁদরেরা একে অন্যের শরীর থেকে কী যেন খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে৷ আমরা ভাবি বাঁদরেরা এভাবে বুঝি উকুন–ড্যাঙ্গর–নিকি বেছে বেছে খাচ্ছে৷ আসলে কিন্তু ওরা উকুন–ড্যাঙ্গর–নিকি খাচ্ছে না–জৈব লবণ বেছে বেছে খাচ্ছে৷ বাঁদরেরা খুব বেশী লম্ফ–ঝম্প করে৷ ওদের লিমফ্যাটিক গ্ল্যান্ড অতিক্রিয় হওয়ায় জৈব লবণও তাই বেরিয়ে যায় প্রচুর৷ তাই একে অন্যের জৈব লবণ খেয়ে ওরা লাবণিক দুর্বলতার হাত থেকে বাঁচবার চেষ্টা করে৷
ঘাম ও জৈব লবণ বেরিয়ে যাওয়া ঃ ঘামে জামাকাপড় ভিজে গেলে, মানুষ মাত্রেরই একটা শারীরিক গ্লানি হয় ও তার ফলে একটা মানসিক গ্লানিরও সৃষ্টি হয়৷ তাই ঘেমে–ভিজে যাওয়া অবস্থায় বেশীক্ষণ থাকতে নেই৷ জামা পরিবর্ত্তন করে ফেলতে হয়, শরীর ধুয়ে মুছে নিতে হয়৷ অতিরিক্ত ঘামের ফলে শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়া মূল্যবান জৈব লবণ অধিকক্ষণ তরল ঘামের সংস্পর্শে থাকলে তার মধ্যে পচবার লক্ষণ দেখা দেয় যা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর৷ ওই জৈব লবণে ভেজা জামাকাপড় পরে শুকিয়ে গেলে তার ওপর লবণ ফুটে ওঠে৷ বিশেষ করে যদি জামাটি কালো রঙের (বা খাকী রঙের) বা কালোর কাছাকাছি কোন রঙের হয়৷ খুব বেশী আমিষ খাদ্য, পেঁয়াজ, রসুন বা ওই ধরনের কোন উগ্র গন্ধযুক্ত খাদ্য বেশী গ্রহণ করলে ওই জৈব লবণ অধিক মাত্রায় দুর্গন্ধ যুক্ত হয়ে ওঠে৷ যারা অতি মাত্রায় তামাক খায় তাদের ঘর্মে তামাকের বর্ণ ও গন্ধ থাকে যা অন্যের পক্ষে বিশেষ পীড়াদায়ক৷ যদি কেউ এমন বস্তু পরিধান করে যা জল–নিরোধক বা বাষ্প–নিরোধক (যেমন ছিদ্রবিহীন ঠাসবুনুনি নাইলনের জামা–মোজা) সেক্ষেত্রে ওই ঘাম বহির্গমনের বা উবে যাবার সুযোগ পায় না৷ এর ফলে স্বাভাবিক নিয়মে ওই বস্ত্রের অভ্যন্তরে ঘাম পচবার সুযোগ পায় বেশী৷ ওই ধরনের মোজা কেউ যদি পরে, সে যখন ওই মোজা খোলে, তখন দুর্গন্ধে একটা বিরাট হলঘরও দূষিত–বায়ু হয়ে যায়৷ এতে স্পষ্টতই বোঝা যায় যে এই ধরনের বস্ত্র স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকর৷
অতিরিক্ত জৈব লবণ বেরিয়ে গেলে মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে৷ সে জন্যে লবণ–জল পান করা চীনী–সহযোগে বা লবণ–বটিকা ব্যবহার করার প্রথা প্রচলিত আছে৷ জৈব লবণ রক্ত চলাচল ক্রিয়াকে বলবৎ রাখে৷ তাই শরীর ঘেমে যাওয়ায় যেমন লবণ অত্যধিক বেরিয়ে যাওয়া ভাল নয়, তেমনি শরীরে লবণ–ভাগ বেশী বেড়ে যাওয়াও ভাল নয়৷ তাতে রক্তচাপ বৃদ্ধি রোগ (arterial hypertension) দেখা দেয়৷ তাই রক্তচাপ বৃদ্ধির রোগীকে লবণের ব্যবহার কমিয়ে দিতে হয়৷ তাদের সতর্ক থাকতে হয় যাতে অতিরিক্ত ঘামতে না হয়৷ তবে স্বাভাবিক নিয়মে রক্তচাপ রোগ যাদের আছে, তারা একটু বেশী ঘামে৷ গ্রামের লোকেরা বলে–‘‘দুর্বলের ঘুম, বলিষ্ঠের ঘাম৷’’ শাকসব্জী–ফলমূলে প্রাকৃতিক নিয়মেই লবণ আছে৷ রান্না করা তরকারীতেও লবণ থাকেই, তাই একটা বয়সের পরে পাতে লবণ খাবার অভ্যাস বর্জন করাই উচিত৷
‘খণ্ডলবণ’ বলতে বোঝায় কালো নুন বা বীট–নুনকে৷ সুপ্রসিদ্ধ হজমকারক ঔষধ ‘লবণ ভাস্ক্র’ বীট নুনে তৈরী আয়ুর্বেদীয় ঔষধ৷ হেকিম সাহেবের ইউনানী চিকিৎসায় ‘নমক সুলেমানি’ এই খণ্ড লবণ সঞ্জাত৷
মরুভূমির গরম সাধারণতঃ শুকনো গরম৷ কলকাতার চেয়ে যোধপুরের গরম অনেক বেশী৷ কিন্তু কলকাতার হাওয়ায় জলীয় বাষ্পের পরিমাণ অধিক থাকায় এখানকার গরম ভ্যাপ্সা৷ এই গরমে ঘাম বেশী হয়৷ এই ঘামের সময় অল্প সময়ে ঘামের সঙ্গে বেশী লবণ বেরিয়ে যায়৷ শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে, খাটবার সামর্থ্য কমে যায়৷ কলকাতার চেয়ে পূর্ব বাংলা ও উত্তর বাংলার ভ্যাপ্সানি আরও বেশী৷ তাই পূর্বাদ্র নীতি (East and Wet) অনুযায়ী রাবের মানুষের চেয়ে পূর্ব বাংলা ও উত্তর বাংলার মানুষ কম পরিশ্রম করতে পারে৷ আবার পূর্ব বাংলা ও উত্তর বাংলার মানুষের চেয়ে অসমে ভ্যাপ্সানি আরও বেশী৷ তাই অসমের মানুষ আরও কম পরিশ্রম করতে পারে৷ যোধপুরের গরম কলকাতার চেয়ে বেশী হলেও হাওয়ায় জলীয় বাষ্প থাকে না বললেই চলে৷ তাই সেখানে ঘাম হয় কম..... ক্লেশ হয় কম..... ক্লান্তিও হয় কম৷
–শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকারের ‘দ্রব্যগুণে রোগারোগ্য’ থেকে