পূর্ব প্রকাশিতের পর,
পর্বতের গায়ে ছোট ছোট গ্রাম যেগুলি রাতের বেলায় অসময়ের দীপাবলির কথা মনে করাচ্ছিলো৷ আমার গুরুদেবের লেখা গানে মনপ্রাণ তাঁকেই আহ্বান করে গেয়ে উঠলো৷
দীপাবলী সাজায়েছি প্রভু
তোমারে করিতে বরণ৷
এসো তুমি হৃদিমাঝে নিতি নিতি নব সাজে
ধীরে ধীরে ফেলিয়া চরণ৷
এসো তুমি মনমাঝে আরো গানে আরো নাচে
মৃদু হাসি করি বিকিরণ ৷ এসো তুমি ভাবলোকে ছন্দে ও নবালোকে৷ জাগায় মোহন স্পন্দন৷
রাত যত ঘন হতে লাগলো নদীর ধারানাদ বেড়ে চলছিলো৷ চারিদিক নিঃশব্দের মাঝে একলা বয়ে চলা ও বিরতিহীনভাবে ধবনি উৎসারণ৷ তমসাবৃত অম্বরে তখন মেঘের চলাচল৷ আশপাশের দেউলগুলির আলো একে একে নিভে জানান দিচ্ছিল আবার ভোরে দেখা হবে সূর্র্যেদয়ের সময়৷
শরীর ও মন চাইছিলো না শয্যায় গিয়ে সময়ের অপব্যবহার৷ মন চাইছিলো পরমপুরুষকে৷ আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তাঁহারে রচনা করতে, অনুভব করতে৷ তাঁর বৈচিত্র্যময় প্রকাশে আপনাকে তাঁর সাথে মিলিয়ে দেবার ইচ্ছেতে৷
এক সময় উঠতেই হলো ঠাণ্ডা বাড়ছিল৷ বিশ্রামের জন্য আসতেই হলো বিছানায়৷ কোন পুণ্যবলে এ ধরায় দেখা হয়েছিল তার সাথে জানিনা৷
কিছুদিন আগেই হয়েছি মাতৃহারা৷ তার উপস্থিতির অপূর্ণতা কিছুতেই মানতে পারছিলাম না৷ সে কারণেই পুত্রের এই ব্যবস্থা৷ শুয়ে শুয়ে মায়ের সাথে নানা স্মৃতি ভেসে উঠছিল মনের পর্দায়৷ ছেলেবেলা থেকে এই ষাট বছর বয়স অবধি তার অভিভাবকত্ব৷ তার নিজস্ব জীবন ধারার যে পরিমিতিবোধ৷ প্রত্যাশাহীন দিনযাপন৷ সব ঘুরে ফিরে আসতে লাগলো৷ এই অনিশ্চিত জীবনে তার নিশ্চিত উপস্থিতি আর নেই৷ আমি মাতৃহারা হয়েছি৷ মধ্যরাতে জানলা দিয়ে দেখা গেল জলদের অলিন্দ আলিঙ্গন৷ জলধর নেমে এসেছিল হাত ছোঁয়ার দূরত্বে৷ যেন আমাদেরকেই স্বাগত অভিবাদনের উদ্দেশ্য৷ পরের দিন শুরু হলো পাহাড়ে, গিরিখাতে, নদীবক্ষে, নীল আকাশে সাদা হাল্কা মেঘের আনাগোনায়৷ বিপুল এ আয়োজনের সমারোহে অস্বচ্ছ চাদরে ঢাকা গিরিশ্রেণী৷
অনুমন তাঁরই (গুরুদেবের) রচনায় গুনগুন করে উঠলো
আকাশে আজ রঙের মেলা
মনেতে আজ আলো৷
বাতাসে আজ সুবাস ভরা
সবই লাগে ভালো৷
অজানা কার আগমনে
হৃদয় ভরা ছন্দে গানে,
প্রাণে পরশ দিয়ে সে যে
সরায় সকল কালো৷
এমন দিনে সবার সনে
প্রাণে প্রদীপ জ্বালো৷
সকালে ছাতে ওঠা হলো৷ চারিদিকে ভিন্ন দূরত্বে পর্বতের প্রাচীর৷ অসংখ্য তরুবৃন্দ প্রতিটি পাহাড় জুড়ে৷ কিন্তু হঠাৎ কোনও কোনও অংশে কেবলমাত্র ঘাসের গালিচা বিছানো৷ জানা গেল ধবস নামার কারণে এই বৃক্ষ বিলুপ্তি৷ যতদূর চোখ যায় মেঘ পাহাড়ের লুকোচুরি৷
কিন্তু একি গৃহের পিছনের দিকে অনেকটা অংশ কেন শিলশ্রেণীর? না গাছ না ঘাস? সটান খাড়া দাঁড় করানো বিশাল কয়েকটি পাথর৷ আবার প্রশ্ণ৷ এবার উত্তর ওটি যোগিনী জলপ্রপাত৷
লোকশ্রুতি ঋষি বিশ্বামিত্রের রোষে ঋষি বশিষ্ঠের পুত্রেরা নিহত হলে তিনি লোকালয় ছেড়ে এই স্থানে চলে আসেন৷ কিছুদিন সাধনা করার পরেও শোক ভুলতে না পেরে তিনি আত্মহত্যা করার মনস্থ করেন উঁচু পর্বত থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে৷ এহেন জ্ঞানী পুরুষ, যোগীর হত্যার দায় ভার নিতে রাজি হয়নি প্রকৃতি৷ তিনি নাকি লাফিয়ে পড়ার পর আহত অবধি হননি৷ এই পরিণতি তে এ হেন পাপচিন্তা ত্যাগ করে তিনি চীন দেশের দিকে রওয়ানা দেন তন্ত্র শিক্ষা প্রদানের ও গ্রহণের উদ্দেশ্যে৷
আর নদীর সম্বন্ধে জনশ্রুতি এই যে নদীতে স্নান করলে অষ্টপাশ---(মায়াবন্ধন)---ঘৃণা, লজ্জা, মান, অপমান, মোহ, দম্ভ, দ্বেষ, খলতা বা ক্ররতা থেকে মুক্ত হওয়া যায়৷ তাই নাকি এই নদীর নাম বি-পাশা (পাশ হতে বিমুক্ত অর্থে) কালক্রমে অপভ্রংশে স্থানীয় ভাষায় বিয়াস৷
নদীর ইতিকথা না হয় অন্য সময়ের জন্য তোলা রইলো৷ ফিরে আসি বর্তমানে৷ বশিষ্ঠ ছোট গ্রাম৷ অর্থনীতি মূলতঃ পর্যটক নির্ভর৷ বিবিধ মানের ও মাশুলে থাকার জায়গা পাওয়া যায় সহজেই৷ বিপণি বলতে শীতবস্ত্র, মেয়েদের সাজগোজের দ্রব্য এইসব৷ আর কিছু আছে খাওয়ার জন্য বরাদ্দ৷ অধিক সময় থাকার ব্যবস্থা হিসেবে ঘরভাড়াও লভ্য৷ কিছু মনিহারী দোকানপাটও দেখা গেল৷
উষ্ণ কুণ্ডের পাশেই বশিষ্ঠ মন্দির ও রাম মন্দির আয়তনে ও আয়োজনে ছোট পরিসরেই মধ্যে পড়ে৷ উষ্ণ কুণ্ডে পুরুষ ও মহিলাদের স্নানের আলাদা ব্যবস্থা৷ যদিও অতিমারির কারণে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে অবগাহনের সময়৷ স্থানীয়রা সম্ভবতঃ খুবই পরিশ্রমী৷ দুধের জন্য পশুপালন প্রায় সব ঘরেই হয়ে থাকে৷ প্রধানতঃ দেশী গাই ও ভেড়া৷ যেহেতু পাহাড়ি অঞ্চল তাই গৃহপালিত পশু একদম আক্ষরিক অর্থে ব্যবহৃত৷ তাদের খাদ্য অন্বেষণে মহিলা পুরুষ উভয়কেই ব্যস্ত থাকতে দেখলাম৷ তাদের অবসর মনে হয় সমতলের লোকেদের থেকে একদম আলাদা৷ ঘর লাগোয়া ছোট ছোট তরিতরকারীর বাগান করা ও পরিচর্যায় অবসর কাটাতেও দেখা গেল তাদের৷ আলয় সংলগ্ণ ধাপে ধাপে তার প্রকাশ৷ অপরিচিতদেরও দেখে ঈষৎ ঘাড় ঝুঁকিয়ে অভিবাদন সম্ভবতঃ এখানকার রীতি৷ প্রথমে মনে হলো কিভাবে চিনলো আমায়? পরে বুঝলাম ও হরি এ তো সবাই করে দেখি৷ দ্যাখা দেখি হ্যাকা নাচে৷ তাই যথাশীঘ্র রেওয়াজটি রপ্ত করে নিতে হোলো৷
- Log in to post comments