মানালী ভ্রমণ

লেখক
আশিষ দত্ত রায়

পূর্ব প্রকাশিতের পর,

পর্বতের গায়ে ছোট ছোট গ্রাম যেগুলি রাতের বেলায় অসময়ের দীপাবলির কথা মনে করাচ্ছিলো৷ আমার গুরুদেবের লেখা গানে মনপ্রাণ তাঁকেই আহ্বান করে গেয়ে উঠলো৷

দীপাবলী সাজায়েছি প্রভু

তোমারে করিতে বরণ৷

এসো তুমি হৃদিমাঝে নিতি নিতি নব সাজে

ধীরে ধীরে ফেলিয়া চরণ৷

এসো তুমি মনমাঝে আরো গানে আরো নাচে

মৃদু হাসি করি বিকিরণ ৷ এসো তুমি ভাবলোকে ছন্দে ও নবালোকে৷ জাগায় মোহন স্পন্দন৷

রাত যত ঘন হতে লাগলো  নদীর ধারানাদ বেড়ে চলছিলো৷ চারিদিক নিঃশব্দের  মাঝে একলা বয়ে চলা ও বিরতিহীনভাবে ধবনি উৎসারণ৷ তমসাবৃত অম্বরে তখন মেঘের চলাচল৷ আশপাশের দেউলগুলির আলো  একে একে নিভে জানান দিচ্ছিল আবার ভোরে দেখা হবে সূর্র্যেদয়ের সময়৷

শরীর ও মন চাইছিলো না শয্যায় গিয়ে সময়ের  অপব্যবহার৷ মন চাইছিলো পরমপুরুষকে৷ আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তাঁহারে রচনা করতে, অনুভব করতে৷ তাঁর বৈচিত্র্যময় প্রকাশে আপনাকে তাঁর সাথে মিলিয়ে দেবার ইচ্ছেতে৷

এক সময় উঠতেই হলো ঠাণ্ডা বাড়ছিল৷ বিশ্রামের জন্য আসতেই হলো বিছানায়৷ কোন পুণ্যবলে  এ ধরায় দেখা হয়েছিল তার সাথে জানিনা৷

কিছুদিন আগেই হয়েছি মাতৃহারা৷ তার উপস্থিতির অপূর্ণতা কিছুতেই মানতে পারছিলাম না৷ সে কারণেই পুত্রের এই ব্যবস্থা৷ শুয়ে  শুয়ে মায়ের সাথে নানা স্মৃতি ভেসে উঠছিল মনের পর্দায়৷ ছেলেবেলা থেকে এই ষাট বছর বয়স অবধি তার অভিভাবকত্ব৷ তার নিজস্ব জীবন ধারার যে পরিমিতিবোধ৷ প্রত্যাশাহীন দিনযাপন৷ সব ঘুরে ফিরে আসতে লাগলো৷ এই  অনিশ্চিত জীবনে তার নিশ্চিত উপস্থিতি আর নেই৷ আমি মাতৃহারা হয়েছি৷ মধ্যরাতে জানলা দিয়ে দেখা গেল জলদের অলিন্দ আলিঙ্গন৷ জলধর নেমে এসেছিল হাত ছোঁয়ার দূরত্বে৷ যেন আমাদেরকেই স্বাগত অভিবাদনের উদ্দেশ্য৷ পরের দিন শুরু হলো পাহাড়ে, গিরিখাতে, নদীবক্ষে, নীল আকাশে সাদা হাল্কা মেঘের আনাগোনায়৷ বিপুল এ আয়োজনের সমারোহে অস্বচ্ছ চাদরে ঢাকা গিরিশ্রেণী৷

অনুমন তাঁরই (গুরুদেবের) রচনায় গুনগুন করে উঠলো

 

                        আকাশে আজ রঙের মেলা

                        মনেতে আজ আলো৷

                        বাতাসে আজ সুবাস ভরা

                        সবই লাগে ভালো৷

 

                                    অজানা কার আগমনে

                                    হৃদয় ভরা ছন্দে গানে,

                                    প্রাণে পরশ দিয়ে সে যে

                                    সরায় সকল কালো৷

 

                                                            এমন দিনে সবার সনে

                                                            প্রাণে প্রদীপ জ্বালো৷

 

সকালে ছাতে ওঠা হলো৷ চারিদিকে ভিন্ন দূরত্বে পর্বতের  প্রাচীর৷ অসংখ্য তরুবৃন্দ প্রতিটি পাহাড় জুড়ে৷ কিন্তু হঠাৎ কোনও কোনও অংশে কেবলমাত্র ঘাসের গালিচা বিছানো৷ জানা গেল ধবস নামার কারণে এই বৃক্ষ বিলুপ্তি৷ যতদূর চোখ যায় মেঘ পাহাড়ের লুকোচুরি৷

কিন্তু একি গৃহের পিছনের দিকে অনেকটা অংশ কেন শিলশ্রেণীর? না গাছ না ঘাস? সটান খাড়া দাঁড় করানো বিশাল কয়েকটি পাথর৷ আবার প্রশ্ণ৷ এবার উত্তর ওটি যোগিনী জলপ্রপাত৷

লোকশ্রুতি ঋষি বিশ্বামিত্রের রোষে ঋষি বশিষ্ঠের  পুত্রেরা নিহত হলে তিনি লোকালয় ছেড়ে এই স্থানে চলে আসেন৷ কিছুদিন সাধনা করার পরেও শোক ভুলতে না পেরে তিনি আত্মহত্যা করার মনস্থ করেন উঁচু পর্বত থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে৷ এহেন জ্ঞানী পুরুষ, যোগীর হত্যার দায় ভার নিতে রাজি হয়নি প্রকৃতি৷ তিনি নাকি লাফিয়ে পড়ার পর আহত অবধি হননি৷ এই পরিণতি তে এ হেন পাপচিন্তা ত্যাগ করে তিনি চীন দেশের দিকে  রওয়ানা দেন তন্ত্র শিক্ষা প্রদানের ও গ্রহণের উদ্দেশ্যে৷

আর নদীর সম্বন্ধে জনশ্রুতি এই যে নদীতে স্নান করলে অষ্টপাশ---(মায়াবন্ধন)---ঘৃণা, লজ্জা, মান, অপমান, মোহ, দম্ভ, দ্বেষ, খলতা বা ক্ররতা থেকে মুক্ত হওয়া যায়৷ তাই নাকি এই নদীর নাম বি-পাশা (পাশ হতে বিমুক্ত অর্থে) কালক্রমে অপভ্রংশে স্থানীয় ভাষায় বিয়াস৷

নদীর ইতিকথা না হয় অন্য সময়ের জন্য তোলা রইলো৷ ফিরে  আসি বর্তমানে৷ বশিষ্ঠ ছোট গ্রাম৷ অর্থনীতি মূলতঃ পর্যটক নির্ভর৷ বিবিধ মানের ও মাশুলে থাকার জায়গা পাওয়া যায় সহজেই৷ বিপণি বলতে  শীতবস্ত্র, মেয়েদের সাজগোজের দ্রব্য এইসব৷ আর কিছু আছে খাওয়ার জন্য বরাদ্দ৷ অধিক সময় থাকার ব্যবস্থা হিসেবে ঘরভাড়াও লভ্য৷ কিছু মনিহারী দোকানপাটও দেখা গেল৷

উষ্ণ কুণ্ডের পাশেই বশিষ্ঠ মন্দির ও রাম মন্দির আয়তনে ও আয়োজনে ছোট পরিসরেই মধ্যে পড়ে৷ উষ্ণ কুণ্ডে পুরুষ ও মহিলাদের স্নানের আলাদা ব্যবস্থা৷ যদিও অতিমারির কারণে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে অবগাহনের সময়৷ স্থানীয়রা সম্ভবতঃ খুবই পরিশ্রমী৷ দুধের জন্য পশুপালন প্রায় সব ঘরেই হয়ে থাকে৷ প্রধানতঃ দেশী গাই ও ভেড়া৷ যেহেতু পাহাড়ি অঞ্চল তাই গৃহপালিত পশু একদম আক্ষরিক অর্থে ব্যবহৃত৷ তাদের  খাদ্য অন্বেষণে মহিলা পুরুষ উভয়কেই ব্যস্ত থাকতে দেখলাম৷ তাদের  অবসর মনে হয় সমতলের লোকেদের থেকে একদম আলাদা৷ ঘর লাগোয়া ছোট ছোট তরিতরকারীর বাগান করা ও পরিচর্যায় অবসর কাটাতেও দেখা গেল তাদের৷ আলয় সংলগ্ণ ধাপে  ধাপে তার প্রকাশ৷ অপরিচিতদেরও দেখে ঈষৎ ঘাড় ঝুঁকিয়ে অভিবাদন সম্ভবতঃ এখানকার রীতি৷ প্রথমে মনে হলো কিভাবে চিনলো আমায়? পরে বুঝলাম  ও হরি এ তো সবাই করে দেখি৷ দ্যাখা দেখি হ্যাকা নাচে৷ তাই যথাশীঘ্র রেওয়াজটি রপ্ত করে নিতে হোলো৷