মানব জীবনে বিজ্ঞান ও ধর্ম

লেখক
সৌমিত্র পাল

পূর্ব প্রকাশিতের পর

ধর্ম ও ধর্মমত :

বিশ্বের  সমস্ত আগুন- জল-চুম্বক প্রভৃতির যেমন এক ধর্ম তথা একই গুণ তেমনি বিশ্বের সকল প্রান্তে  মানুষের ধর্ম ও এক আর তা হল- মানব ধর্ম৷ এখানে এই যুক্তিতে সমর্থন করেই মন্তব্য করেছেন:

‘‘ধর্ম কখনো বহু হয় না ধর্ম একই আর তার কোন প্রকার নেই ৷ মত বহু হতে পারে  এমনকি  যত মানুষ তত মত হতে পারে, কিন্তু তাই বলে ধর্ম বহু হতে পারে না৷ (‘‘সত্যানুসরণ’’)

ধর্মের কোন সঠিক ইংরেজী প্রতিশব্দ Appropriate English Synounys) নাই, আরবীতে ধর্মের  সঠিক প্রতিশব্দ হল-‘ ইমান’ অন্যদিকে ইংরেজীRiligion, এর সঠিক বাংলা অর্থ ধর্মমত বা উপধর্ম৷ আরবীতে ধর্মমতকে ‘মজহব’ বলা হয়৷ ধর্মমতের সাথে ধর্মের অজস্র পার্থক্য আছে৷ ধর্মের সাথে ধর্মমতগুলিকে আমরা যেন গুলিয়ে না ফেলি৷ এদের সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা তৈরী হলে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি উন্নত হবে সমাজের প্রকৃত কল্যাণ হবে৷ ধর্মমতের ভিত্তি হল-বিশ্বাস বাSentiment, এক একজনের বিশ্বাস এক একরকমের হয়, ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাস তথাSentiment, কে কেন্দ্র করেই সমাজের বুকে বিভিন্ন ধর্মমতের জন্ম হয়েছে, হিন্দু,মুসলমান জৈন,বৌদ্ধ ক্রীষ্টান প্রভৃতি ধর্মমত৷ ধর্মমত সংখ্যায় অনেক কিন্তু ধর্ম সংখ্যায় মাত্র একটি আর তা হল মানব ধর্ম--- বৃহৎ (অসীম) কে পাবার এষনা৷

দুই: বিশ্বাস তথাSentiment কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠায়  ধর্মমত  পরিবর্তনশীল৷ কারণ বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানুষের  বিশ্বাসের পরিবর্তন হতে পারে৷ অতীতে আমরা দেখেছি বহু রাজা অভিজাত  এমনকি সাধারণ মানুষ ও হিন্দু ধর্মমত পরিত্যাগ করে বৌদ্ধ, জৈন, ক্রীষ্টান, পারসিক প্রভৃতি ধর্মমত গ্রহণ করেছিলেন৷ পরবর্তীকালে তাঁদের  অনেকেই আবার স্বধর্ম মতে ফিরেও এসেছিলেন৷ অন্যদিকে জাতি, বর্ণ সম্প্রদায় পান্ডিত মূর্খ নারী-পুরুষভেদে ধর্ম সর্বদাই অপরিবর্ত্তনশীল, কেননা সবাই অসীম তৃষ্ণা মেটানোর জন্য অসীমকেই পেতে চায় জ্ঞাতসারেই হোক কিংবা অজ্ঞাতসারে৷ এটা মানব অন্তরের শ্বাশ্বত এষনা বা ধর্ম৷

তিন: একের বিশ্বাস Sentiment) অনেক ক্ষেত্রে  অন্যের বিশ্বাসের পরিপন্থি হওয়ায় ধর্মমতে ধর্মমতে সংঘর্ষ বাধে৷ এই সংঘর্ষ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে নষ্ট করে  মানুষের মাঝে ব্যবধানের প্রাচীর তুলে দেয়৷ বিভিন্ন ধর্মমতের উগ্রSentiment’’ মানুষকে ক্ষ্যাপা কুকুরের মত অসহিষ্ণু করে তোলে৷  ফলে মানুষ পারস্পরিক ভাতৃঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে সমাজদেহে অশান্তির দাবানল জ্বালাচ্ছে৷ ---যা কখনোই কাম্য নয়৷ অন্যদিকে ‘ধর্ম’ যুগে যুগে মানুষকে ঐক্য সংহতির আদর্শ প্রচার করেছে, বিভেদ ভূলিয়ে তাকে শিখিয়েছে সহিষ্ণুতা, উদ্ধুদ্ধ করেছে মহান বিশ্বভাতৃত্বের আদর্শে সবার নিঃস্বার্থ কল্যাণে৷

চার: ধর্মমতগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে বাহ্যিক আড়ম্বরপূর্ণ হিন্দুধর্মমতে ও আমরা সাড়ম্বরে মূর্ত্তিপূজা লক্ষ্য করেছি৷ ফুল চন্দন ধূপ আলপনা প্রভৃতি উপাসনার বাহ্যিক উপকরণই এক্ষেত্রে বড় হয়ে ওঠে৷ অন্যদিকে ধর্মসাধনার জন্য কোন বাহ্যিক উপকরণ (বস্তু) এর প্রয়োজন নাই৷

প্রয়োজন আছে শুধু  অন্তরের উপকরণের --- বিশুদ্ধ ভক্তি, বৈরাগ্য আর নিষ্টাসম্মত অনুশীলন (সাধনা) এর৷ এগুলির দ্বারাই মানব মন (অনুমন)  পরম ইষ্ট ভূমামনের  আরাধনা করে যাবে৷ প্রভাত সঙ্গীতে ধর্মসাধনার স্বরূপ বাহ্যিক আড়ম্বরহীন ব্যাখায়  শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার তাই যথার্থই  মন্তব্য করেছেনঃ

‘‘ধূপ-দীপ আলপনা কিছুই লাগিবে না

মনকে ধরিতে মন করে যাবে আরাধনা৷’’

নিষ্ঠাসম্মত আরাধনার মধ্য দিয়েই মানব মন একদিন তাঁর পরম আরাধ্য ইষ্ট ভূমাতে (অনন্তে) সমাহিত হয়ে গিয়ে স্বার্থক  করে তুলবে তাঁর মনুষ্যজীবনকে৷

ধর্ম সাধনার  তাৎপর্যই হল প্রতিটি জীবকে একই অখন্ড সত্তা (শ্রষ্টা অনন্ত ব্রহ্ম)-রই ভিন্ন অভিব্যক্তি হিসাবে দেখা৷ শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন: বিশ্বপিতা (ব্রহ্ম) আর তাঁর সৃষ্টিকে ভালবাসাই আধ্যাত্ম সাধকের (ধর্মসাধকের) একমাত্র  ধর্ম৷ জাতিগত ভাষাগত কিংবা মতবাদের  ভাবপ্রবণতার দ্বারা সে যেন কখনো পরিচালিত  না হয় ও কোন ভেদবুদ্ধিকে  যেন কখনো সে সহ্য না করে৷’’ তাই দল উপদল করে মুসলমান, ব্রাহ্মণ-শুদ্র, ধনী দরিদ্র,শাদা কালোর কোন  ভেদ-বিভেদ নাই, সর্বপ্রকার ভেদ বিভেদ সরিয়ে ‘ধর্ম’ মানুষকে ‘বিশ্বভাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে---‘‘মানুষ মানুষ ভাই ভাই / উঁচু কিংবা  নীচু নাই’’  (প্রভাভ সঙ্গীত) ধর্ম মানুষের মধ্যে সমদৃষ্টি, সর্বজীবে  প্রেম-মমতা সমন্বয় গড়ে তোলে৷  ধর্ম মানুষকে ভাবতে শেখায় :

‘‘হরর্মে পিতা গৌরী মাতা স্বদেশ ভূবনত্রয়ম৷’’ 

অর্থাৎ স্রষ্টা ব্রহ্ম আমাদের সবাইকার পিতা, পরমা প্রকৃতি  আমাদের মাতা আর  এই ত্রিভূবন আমাদের সকলের বাসগৃহ (স্বদেশ,)৷ আমরা সবাই বিশ্বনাগরিক৷ সবাই একই পরিবারভূক্ত ভাই-বোন৷ তাই স্রষ্টা ও তাঁর সৃষ্টিকে ভালবাসাই প্রকৃত মানব ধর্ম৷  অন্তর্জগতে নিরন্তর নিষ্ঠাসম্মত সাধনার দ্বারা স্রষ্টা ব্রহ্মকে ভালবাসা৷ তাঁতেই স্থিত হওয়া আর বহির্জগতে অখন্ড ব্রহ্মেরেই খন্ড (ভিন্ন) অভিব্যক্তি সমগ্র জীবকূলের সামগ্রিক বিকাশ ঘটানোই ধর্মের লক্ষ্য৷ এর মাধম্যেই  মানুষ প্রাপ্ত হয় পরমশান্তি তথা আনন্দ৷  (ক্রমশঃ)