পূর্ব প্রকাশিতের পর
‘মনোময় কোষকে নিয়ন্ত্রন করে আসন ও প্রাণায়াম৷ ‘প্রাণায়াম’ কাকে বলে? ‘‘প্রাণান্ যময়তি য:স: প্রাণায়াম:’’ অর্থাৎ প্রাণশক্তিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার কৌশলই প্রাণায়াম৷ প্রাণ কী? প্রাণ ,অপান, সমান, উদ্যান ,ব্যান, নাগ, কুর্ম , কৃকর, দেবদত্ত ও ধনঞ্জয় এই দশবায়ুর সমন্বয়ে যা সৃষ্ট তাই প্রাণ৷ এই দশবায়ুকে নিয়ন্ত্রণে আনার বিজ্ঞানসম্মত কৌশলই প্রাণায়াম ৷
দশবায়ু-সম্বন্ধে কিছুকথা:
১৷ প্রাণ বায়ু : কন্ঠ থেকে নাভি পর্যন্ত যে বায়ু শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজে ব্যস্ত৷
২৷ অপান বায়ু : উদরে নাভির নিম্নাঙ্গে কাজ করে৷ এই বায়ু মলমূত্র বর্জনে সাহায্য করে৷
৩৷ সমান বায়ু : নাভিতে অবস্থান করে প্রাণ ও অপানের মধ্যে সমতা বিধান করে৷
৪৷ উদান বায়ু : কন্ঠ ও শব্দ উচ্চারণকে নিয়ন্ত্রণ করে৷
৫৷ ব্যান বায়ু : সারা দেহে রক্ত সঞ্চালনে সহায়তা করে ৷
৬৷ নাগ বায়ু : শরীরকে বিস্তারিত করতে অর্থাৎ লম্ফ-ঝম্ফ দিতে সাহায্য করে৷
৭৷ কূর্ম বায়ু : শরীরকে সংকুচিত করতে সাহায্য করে৷
৮৷ কৃকর বায়ু : জৃম্ভন অর্থাৎ হাইতোলা-কে নিয়ন্ত্রণ করে৷
৯৷ দেবদত্ত বায়ু : ক্ষুধা-তৃষ্ণা বোধ জাগায়৷
১০৷ ধনঞ্জয় বায়ু : নিদ্রা-তন্দ্রা বোধ জাগায়৷
প্রাণায়ামের গুরুত্বঃ-
১৷ প্রাণায়াম ফুসফুস থেকে দূষিত (কার্বন-ডাই-অক্সাইড যুক্ত) বায়ুকে প্রতিস্থাপিত করে প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ (অক্সিজেন যুক্ত) বায়ু সরবরাহ করে, যা প্রাণ শক্তির দ্যোতক৷ এই বিশুদ্ধ অক্সিজেন রক্তের সাথে মিশে শরীরের প্রতিটি কোষ ও কলায় Tissue) সঞ্চালিত হয়ে তাদের সুস্থ-সচল রাখে৷ দৈহিক পরিশ্রম করার শক্তির যোগান দেয় কোষস্থ অক্সিজেন৷ এই অক্সিজেন অপ্রতুল (অভাব) হলে দেহকোষের অকালমৃত্যু হয়৷ ফলে শরীর দুর্বল ও জরাগ্রস্থ হতে থাকে ও অকালবার্ধক্য নেমে আসে৷ অক্সিজেনের অভাবে নিদ্রাহীনতা Isnomia), অজীর্নতা, কোষ্ঠকাঠিন্য, মাথাধরা, শ্বাসজনিত কষ্ট, টিবি, হাঁপানি প্রভৃতি রোগ হতে পারে৷ নিয়মিত প্রাণায়াম শরীরে পর্যাপ্ত অক্সিজেনকে কোষে কোষে সরবরাহ করে৷ এতে করে স্নায়ু(Nerve) সুস্থ থাকে৷ শরীর কর্মক্ষম হয়৷ মানসিক উত্তেজনা কমে যায়৷
২৷ শ্বাসনালী ফুসফুস ও হৃদ্যন্ত্রকে সুস্থ রাখে৷ ওদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে না৷
৩৷ মহাকাশের অসংখ্য ধনাত্মক অণুজীবৎ(positive Microvita) প্রাণায়ামের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে আমাদের প্রাণশক্তি Vital enargy) বাড়ায়৷ দেহস্থ গ্রন্থি ও উপগ্রন্থিগুলোকে(Glands &Subglands) মজবুত করে৷ ফলে শরীর ব্যাধিমুক্ত হয়৷ মানসিক চাপ(Stress) হ্রাস পায়৷
৪৷ নিয়মিত প্রাণায়াম অভ্যাসের দ্বারা মনের একাগ্রতা বাড়ে৷ স্নায়ুকোষ ও স্নায়ুতন্তু সুস্থ সতেজ হয়৷ ফলে আমরা সূক্ষ্মচিন্তা আত্মস্থ করতে পারি৷ মনোময় কোষ নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় স্মৃতি শক্তি বাড়ে৷
৫৷ লিভার, কিডনি, পাকস্থলী, ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃহদন্ত্র, রক্তনালী ও স্নায়ূতন্তু সবই সুস্থ সতেজ হয়৷
দশবায়ু শরীর ও মনের মধ্যে যতদিন সন্তুলন বজায় রাখবে আমাদের জীবনপ্রবাহ ততদিন পর্য্যন্ত এগিয়ে চলবে৷ মানুষ বৃদ্ধ হয়ে গেলে বা কঠিন ব্যাধিতে ভুগলে শরীরের তরঙ্গে পরিবর্তন এসে যায় ৷ প্রাণ ও অপান দুর্বল হয়ে যায় ও সমান বায়ুর সঙ্গে একত্রিত হয়ে উদান বায়ুকে আঘাত করে৷ তখন আমরা দেখতে পাই মৃত্যু পথযাত্রীর নাভিঃশ্বাস উঠছে৷ এটাই হচ্ছে, পৃথিবী থেকে যাবার পূর্বাভাস৷
অতিমানস কোষ
ধর্মসাধনায় ধাপে ধাপে মনের বিস্তৃতি ঘটে৷ মন এগিয়ে চলে আরো সূক্ষ্মত্বের পানে৷ মনোময় কোষের আস্তরণ অতিক্রম করে ‘মন’ যখন অতিমানস কোষে অবস্থান করে তখন মন আরো সূক্ষ্মত্ব প্রাপ্ত হয়৷ মনেরwave length বেড়ে যায়, মন আরো বেশী গভীরতা লাভ করে৷ এই স্তরে দুর্লভ সম্পদ ‘প্রজ্ঞা’ Intuition) এর অবস্থান৷
এই প্রজ্ঞা কোন পঁুথির পাতা থেকে লব্ধ জ্ঞান নয়---এর দ্বারা সাধক আসলে মহাজাগতিক সংকেত সহজেই বুঝতে পারে৷ বহু মুনি-ঋষি তাদের অতিমানস কোষকে ঋদ্ধ করার মাধ্যমেই প্রকৃতির (মহাজাগতিক) ভবিষ্যৎবার্র্ত সহজেই বুঝতে পারতেন ও তার মাধ্যমে জগতের মঙ্গল করতেন৷ মনের এই স্তরকে আধ্যাত্মিক মন বা স্পিরিচুয়াল মাইণ্ডও বলা হয়৷ ঋষিকবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘প্রজ্ঞা’র দ্বারাই মহামানব ঈশ্বরের আগমনবার্র্ত বুঝতে পেরে তা জগৎবাসীকে জানান৷
ওই মহামানব আসে
দিকে দিকে রোমাঞ্চ জাগে
মর্ত্যধূলির ঘাসে ঘাসে৷
কিংবা প্রজ্ঞার সাহায্যেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার কাব্যের আগাম ভবিষ্যত বুঝতে পেরে সানন্দে লিখেছিলেন:
‘‘আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসে
আমার কবিতাখানি কৌতুহলভরে৷’’
ঋষি গৌতমবুদ্ধের ‘জাতক’-এ তার যে অতীত জীবনের নানান কাহিনী বর্ণিত আছে তা তাঁর প্রজ্ঞার ফসল বলেই অনেকে মনে করেন৷ এছাড়াও অতিমানস কোষ সঞ্চয় করে রাখে মানুষের বিগত জীবনের ‘সংস্কার’৷ ‘সংস্কার’ হল-কর্মের ফল৷ নিউটনের তৃতীয় সুত্র অনুযায়ী--- ‘To every action, there will be equal and opposite reaction’’৷ জগতের ও জীবনের সর্বক্ষেত্রে এই সূত্রটি সত্য৷ (যদি স্থান-কাল-পাত্র অপরিবর্তিত থাকে)৷ মানুষ জীবনে যা যা কর্ম করে, তার প্রতিকর্ম ‘বীজ’ আকারে অতিমানস কোষে সঞ্চিত থাকে, এই প্রতিকর্মের বীজই হল সংস্কাব--- যা পরবর্তীকালে কর্মফলে রূপায়িত হয়৷ মৃত্যুর পর বিদেহী মন সংস্কার নিয়েই মহাশূন্যে অবস্থান করে৷ ওই বিদেহী মন শরীর ছাড়া নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না৷ প্রকৃতির রজোগুণ ওই মনের প্রকাশের জন্যে তার সংস্কার অনুযায়ী দেহ খঁুজে বেড়ায়৷ মাতৃজঠরে নিত্যনতুন ভ্রূণ সৃষ্টি হয়ে চলেছে প্রকৃতির নিয়মে৷ প্রকৃতি ওই বিদেহী মনের সংস্কার অনুযায়ী উপযুক্ত ভ্রূণের (মানুষ বা যে কোনও জীবেরই হোক) সঙ্গে ওই বিদেহী মনকে সংযুক্ত করে দেয়৷ শুরু হয় নতুন জীবন৷ এইভাবে সংস্কার অনুযায়ী তার জীবনের ধারা এগিয়ে চলে৷ হীন কর্মের সংস্কার অনুযায়ী মনের অধোগতি হলে সে হয়তো পশু বা পাখীর মাতৃজঠর পেতে পারে৷ আবার শুভকর্ম ও নিষ্ঠাসম্মত ধর্র্মনুশীলনের মাধ্যমে হয়তো এক জীবনেই সমস্ত কর্মবন্ধন থেকে চিরতরে মুক্ত হতে পারে৷ একেই মুক্তি-মোক্ষ বা (বৌদ্ধধর্মমতে) ‘নির্র্বণ লাভ বলা হয়৷ সবই কর্মের উপর নির্ভরশীল৷ তবে মানব জীবনই সাধনা ও সৎকর্ম (সেবামূলক নানান কাজ) সাধনের একমাত্র মাধ্যম, যা বেশীরভাগ মানুষই অবহেলায় নষ্ট করেদেয়৷
ধর্মসাধনার বিশেষ অঙ্গ ‘প্রত্যাহারযোগ’-এর মাধ্যমে অতিমানস কোষ মজবুত হয়৷ প্রত্যাহার যোগের প্রত্যেকিিট ধাপ(Step) নিষ্ঠার সাথে অনুশীলন করা চাই৷ সাধনার শেষে ‘বণার্ঘ্য দান’ সাধককে বস্তু জগতের নানান বর্ণ (রং) থেকে দূরে রাখে ও তার মনকে ঈশ্বরমুখী করে৷ প্রকৃতির নানান তান্মাত্রিক বর্ণ সাধকের মনকে জাগতিক মোহে আসক্ত করে ও ক্রমান্বয়ে বহির্মুখী ‘ভোগে’ নিমগ্ণ’ করে৷ প্রত্যাহার যোগাভ্যাস সাধকের ‘মন’কে জাগতিক মোহ থেকে মুক্ত করে পর্র্যয়ক্রমে অর্ন্তমূখী...... ঈশ্বরমূখী করে, তাঁর অন্তরের অন্তঃস্থলে ‘প্রজ্ঞা’কে জাগ্রত করে৷
বিজ্ঞানময় কোষ
এই স্তরে ‘বিবেক ও বৈরাগ্যের অবস্থান৷ বিজ্ঞানময় কোষ উন্নত হলে ‘বিবেক’ জাগ্রত হয়৷ তখন অন্যায়-দুর্নীতি প্রভৃতি সর্ম্পকে মন সদা সচেতন হয়৷ একজন বিবেকবান ব্যক্তি কোনভাবেই অন্যায় বা দুর্নীতির সাথে আপোষ করবেন না৷ সুভাষচন্দ্র বসু, বাঘা যতীন, মানবেন্দ্রনাথ রায় প্রমুখ বিপ্লবীরা আধ্যাত্মিক, সাধনা করতেন৷ ‘গীতা’ (ধর্মগ্রন্থ) স্পর্শ করে বৈপ্লবীক জীবনের দৃঢ় শপথ নিতেন৷ এঁরা নিজেদের ব্যষ্টিজীবন ও কর্মজীবনে কোন অন্যায় পাপাচারের কাছে মাথা নত করেননি৷ তাইতো এঁরা চিরস্মরণীয় বরণীয়৷ ‘বিবেক’ Conscience) পূর্ণরূপে জাগ্রত হলেই মনে বৈরাগ্যের Non-attachment) সূত্রপাত হয়৷ ‘বৈরাগ্য’ হ’ল---মনকে বস্তুজগতের প্রতি অনুরক্ত (আসক্ত) না করা৷ বৈরাগ্যের দ্বারা পরিচালিত হলে সাধকের অন্তরে বস্তুজগতের রং কোন ছাপ ফেলে না---শুধু সে মানুষ হিসাবে তার ‘কর্তব্য’ করার মহানব্রত পালন করে চলে৷ অনাসক্ত সাধক বৈরাগ্যের কারণেই অপরের কষ্টে ব্যথিত হন৷
রাজকুমার গৌতম ‘বিবেক’ Conscience) বৃত্তির তাড়নায় অপরের কষ্টে প্রায়ই কাতর হতেন৷ একদিন তিনি রাস্তায় লক্ষ্য করলেন যে একটি মৃত দেহকে কাঁধে নিয়ে সকলেই শশ্মানের উদ্দেশ্যে চলেছে৷ এই দৃশ্য দেখে সারথীকে গৌতম জিজ্ঞাসা করলেন ‘‘মৃত্যু কেন হয়?’’ উত্তরে সারথী বললেন, জরা-মৃত্যু প্রকৃতির এক স্বাভাবিক নিয়ম, কুমার৷ সকলকেই একদিন মৃত্যুর পথে পাড়ি দিতে হবে৷ প্রকৃতির এই নিয়মকে লঙ্ঘন করার কোন উপায় নেই৷ কুমারের মনের মাঝে উঠল ‘মৃত্যু সম্পর্কে নানান কৌতুহলের ঝড়৷ সত্যিই কী মৃত্যুকে জয় করা যায় না৷ এই ভাবনাই তাঁর মনে বৈরাগ্যের জন্ম দিল৷ এই বৈরাগ্য জাগলে মানুষ বিনাশশীল (আপেক্ষিক) জগৎ সংসারের প্রতি অনাসক্ত হয়ে পড়েন৷ তখন সে উপলব্ধি করে যে জগৎ সংসারের সব কিছুই বিনাশশীল, যশ-খ্যাতি, মালা (অর্ঘ্য) মূল্যবান মানব জীবনে কোনকিছুই চিরস্থায়ী নয়৷ মহাকালের নিয়মে সবকিছু ফেলে সংসারের উজান বেয়ে একদিন মৃত্যুর পথে সকলকে পাড়ি দিতে হবে৷ কবির কথায় :
‘‘মালা বটে শুকিয়ে মরে
যে জন মালা পরে
সেও তো নয় অমর
তবে দু:খ কীসের তরে?
.......থাকবে না ভাই থাকবে না ভাই
থাকবে না ভাই কিছু
এই আনন্দে যাওরে চলে কালের পিছু পিছু৷’’
তাই জগৎ সংসারের প্রতি অনুরক্ত না হয়ে শুধুমাত্র নিজের কর্তব্য করে চলা আর অন্তর্জগতে পরম চৈতন্যের পানে এগিয়ে চলাই তখন তার একমাত্র লক্ষ্য হয়ে যায়৷ মানবজীবনের একমাত্র আরাধ্য-অমৃত স্বরূপ চৈতন্য (ব্রহ্ম)৷ তাঁতে মন পূর্ণরূপে সমাহিত হলেই মৃত্যুর বন্ধন চিরতরে পেরিয়ে অমৃতে প্রতিষ্ঠিত হয় সাধক৷ ধর্মসাধনা মানব অন্তরে বৈরাগ্যবোধ জাগ্রত করে যা ক্রমাম্বয়ে তাঁকে অন্ধকার (অভাব) থেকে আলোর (পূর্ণতার) পানে মৃত্যু থেকে অমৃতের পানে .... বন্ধন থেকে চিরমুক্তির পানে নিয়ে যায়৷ উপনিষদে মনের অন্তরের কথা তাইতো ব্যক্ত হয়েছে:
‘‘অসতো মা সদগময়ো/তমসো মা জ্যোতির্গময়ো
মৃর্ত্যুমামৃতম গময়ো / আবিরাবির্ময়ৈধি৷’’
বৈরাগ্যের দ্বারা পরিচালিত হয়েই রাজকুমার গৌতম ঋষি গৌতম (বুদ্ধে) পরিণত হন ও জগৎকে অমৃতের পথ তথা নির্র্বনের পথ দেখিয়েছিলেন৷ বৈরাগ্য বোধ মানুষকে ক্ষুদ্র স্বার্থের গণ্ডি থেকে মুক্ত করে বৃহত্তর স্বার্থে... সমগ্র জীবজগতের কল্যাণ করতে শেখায়৷ মঙ্গলসময় পরম চৈতন্যের এটাই ইচ্ছা৷ কোন শিশুকে ভালবাসলে যেমন তার পিতা-মাতা খুশী হন, ঠিক তেমনি বিশ্বপিতা পরম চৈতন্যের নিজ সৃষ্ট জীবজন্তু-গাছপালা-মানুষজনকে যত ভালবাসা যাবে, তাদের কল্যাণে নিজেকে নিযুক্ত করা যাবে ততই বিশ্বপিতা আনন্দিত হবেন কেননা সৃষ্ট বিশ্বের ‘সীমার মাঝেই অসীম’ হয়ে আছেন যে তিনি৷ দর্শনের ভাষায় তাইতো তিনি ‘পুরুষ সত্তা’--- ‘‘পুরে শেতে য:স: পুরুষ’’৷ এই স্রষ্টা পুরুষ চৈতন্যময় ব্রহ্মের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে তাঁরই সৃষ্টির কল্যাণে এগিয়ে এসেছেন যুগে যুগে বহু ‘অবতার’ ঋষিগণ৷ তাঁর আমন্ত্রণকে উপেক্ষা করে নিজ ঘর আঁকড়ে বসে থাকবে এমন সাধ্য আছে কার?
‘‘....তুমি যে ডেকেছো আমায়
আজ যে ঘরে থাকা দায়
কী যাদু আছে তব রাগ-রাগিনীতে
বুঝিতে নাহি পারা যায়
...আজ যে ঘরে থাকা দায়৷’’
তিনি যাকে ভালবেসে দায়িত্ব তুলেদেন, তাঁকে দিয়েই তাঁর (পরম চৈতন্যর) অভীষ্ট কাজ করিয়ে নেন৷ করুণাময় চৈতন্যময় ব্রহ্মের অপার করুণা ছাড়া মনে ‘বৈরাগ্য’ আসে না৷.... অন্যথায় জাগতিক বাসনার অশান্তির দাবানলেই নিমজ্জিত থাকতে হয়৷ এই বৈরাগ্যের টানেই যুগে যুগে সৃষ্টির বিকাশে সমাজের কল্যাণে এসেছেন--- বুদ্ধ -যীশু -নানক-কবীর-মহম্মদ চৈতন্য বিবেকানন্দ প্রমুখ মহাত্মাগণ৷ এই কল্যাণযজ্ঞে উৎসর্গ করার মাঝে নেই কোন তাপের জ্বালা... কিংবা বিষাদের গ্লানি, আছে শুধু শান্তির প্রলেপ৷
বিজ্ঞানময় কোষ উন্নত হলে সাধকের অন্তরে (মনে) বস্তুজগতের প্রতি অনাসক্তি তৈরী হয়৷ তখন ঘৃণা কিংবা বিভেদ তার-- মধ্যে থাকতেই পারে না৷ এই জন্যেই মাতৃসাধক ব্যামাক্ষাপা কুকুরের সঙ্গে একপাতে পরমতৃপ্তিতে খাবার খেতে পারতেন৷ কিংবা মহাপ্রভু চৈতন্যদেব ও ‘মুচি-মেথর-শূদ্র-চণ্ডাল’ প্রমুখ তথাকথিত অচ্ছুতদের হরিজ্ঞানে (ব্রহ্মজ্ঞানে) আলিঙ্গন করতেন৷ বিজ্ঞানময় কোষকে সমৃদ্ধ করতে পারলে (জাগ্রত করলে) সাধকের মনের Wave -length এত বেড়ে যায় যে তিনি সর্বজীবে সমদর্শী হয়ে ওঠেন৷.... তিনি শুধু সর্বত্রই দেখতে পান যে পরমব্রহ্মই বহুরূপে তাঁর সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছেন৷--- ‘একো ব্রহ্মো দ্বিতীয় নাস্তি’... সবাই ‘ব্রহ্ম’, ব্রহ্মময় জগৎ, এছাড়া কোন দ্বিতীয় সত্তা নেই৷ এটা কোন মানসিক ভ্রম Hallucination) নয়--- বরং উচ্চস্তরের মনোবিজ্ঞান যেখানে মন সবার কল্যাণ ভাবনার মধ্য দিয়ে ব্রহ্মের সেবা করতে চায়৷ একেই বিবেকানন্দ শিবজ্ঞানে (ব্রহ্মজ্ঞানে) জীবসেবা বলেছেন৷ মনকে এই স্তরে উন্নীত করতে পারলে সর্বজীবের মাঝে ব্রহ্মস্বরূপ উপলব্ধি হয়৷ অন্যথায় জীবের সেবার আড়ালে পরোক্ষে শোষণ কিংবা আত্মপ্রচারটাই লক্ষ্য হয়ে যায়৷
ধর্মসাধনার অন্যতম অঙ্গ ---‘ধারণার’ মাধ্যমে বিজ্ঞানময় কোষ, সমুন্নত হয়৷ মনে বিবেক-বৈরাগ্য, সর্বজীবে সমদৃষ্টি- মমতা প্রভৃতি সুমহান গুণাবলীর বিকাশ ঘটে৷ (ক্রমশঃ)
- Log in to post comments