মানবতার মুক্তিমন্ত্র প্রাউট

লেখক
প্রাউটিষ্ট

প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব, ইংরাজীতে প্রোগ্রেসিভ ইউটিলাইজেশন থিয়োরী, সংক্ষেপে প্রাউট ত্নব্জপ্সব্ভব্ধগ্গ৷ এই তত্ত্বের প্রবক্তা আধুনিক যুগের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক শ্রীপ্রভাত রঞ্জন সরকার৷

প্রাউট বা প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্বের মূল কথা হ’ল ‘উপযোগ’, ‘উপযোগ’ কথাটি এসেছে ‘উপযোগিতা’ কথা থেকে৷ অর্থনীতিতে ‘উপযোগিতা’ মানে হ’ল, কোন বস্তুতে মানুষের অভাব পূরণের ক্ষমতা৷ যেমন, জলের আছে, তৃষ্ণা মেটানোর ক্ষমতা, ইলেকট্রিসিটি উৎপাদনের ক্ষমতা, সেচের মাধ্যমে কৃষিতে সাহায্য করবার ক্ষমতা, নৌবহনের দ্বারা মালপত্র সরবরাহ করার ক্ষমতা ইত্যাদি৷ এমনি বিশ্বে রয়েছে অগণিত বস্তু, প্রত্যেকেরই রয়েছে কিছু না কিছু ‘উপযোগিতা’ যার অতি নগন্য অংশই মানুষ কাজে লাগতে পেরেছে৷ পৃথিবীর বিভিন্ন মানুষের মধ্যে যে কত সুপ্ত সম্ভাবনা রয়েছে, তার কতটুকুই বা স্ফূরণ হচ্ছে এ সবের সম্যক বিকাশসাধন ও ব্যবহারই ‘উপযোগ’৷

এই ‘উপযোগ’ হবে প্রগতিশীল৷ ‘প্রগতি’ কথাটির অর্থ হ’ল প্রকৃষ্ট–গতি৷ প্রগতির ইংরাজী প্রতিশব্দ ‘প্রোগ্রেস’, এর মানে, সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া৷ সমাজ–জীবনের প্রকৃষ্ট–গতি বা প্রগতি হ’ল মানুষের সার্বিক কল্যাণ সাধনের মাধ্যমে ‘‘বিশ্বমানবতার’’ প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে চলা৷

তাই প্রউতে রয়েছে, বিশ্বের যাবতীয় সৃষ্টবস্তুর ‘উপযোগ’কে মানুষের সমাজের সার্বিক কল্যাণমুখী করার পরিকল্পনা৷

সমাজ

প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব বা প্রাউট হ’ল একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক তত্ত্ব৷ সমাজ কি সমাজ কথাটার অর্থ হ’ল, ‘সমানম্ এজতে ইতি’ অর্থাৎ একসাথে চলা, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে মিলিত ভাবে জীবন সাধনার পথে এগিয়ে চলা৷ শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর ‘‘মানুষের সমাজ’’ পুস্তকে লিখেছেন, ‘‘ব্যষ্টি জীবনের চলার ছন্দ যেখানে সমষ্টি জীবনের চলার ছন্দকে বিড়ম্বিত করে দেয় না, সেখানে এই বহু ব্যষ্টির মিলিত চলার মধ্যেই থেকে যায় সমাজ সৃষ্টির সম্ভাবনা৷’’

‘‘মানুষের একটা দিক আছে যেখানে বিষয়বুদ্ধি নিয়ে সে আপন সিদ্ধি খোঁজে,....সেখানে সে জীবরূপে বাঁচতে চায়৷ কিন্তু, মানুষের আর একটা দিক আছে যা এই ব্যক্তিগত বৈষয়িকতার বাইরে৷.... সেখানে আপন স্বতন্ত্র জীবনের যে বড়ো জীবন সেই জীবনে মানুষ বাঁচতে চায়৷.... একটা তার জীবভাব আর একটা বিশ্বভাব৷’’ –রবীন্দ্রনাথ৷

এই ‘জীবকে’ পেরিয়ে যে সত্তা, সে আছে আদর্শ নিয়ে–সে বিশ্বমানবত্ব প্রতিষ্ঠার আদর্শ৷ এই সত্তাই সতত মানুষকে প্রকৃত ‘‘মানুষের সমাজ’’–গড়ার প্রেরণা যোগাচ্ছে৷ প্রকৃত ‘মানুষের সমাজ’ গড়ার গোড়ার কথা হ’ল নীতিবাদ৷ ‘নীতি’ অর্থাৎ ‘‘যা মানুষকে কল্যাণের পথে নিয়ে যায়’’৷ এই নীতিবাদ মানুষের সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে প্রকৃত ‘মানুষের সমাজ’ হয় না৷ সব মানুষ সমান ভাবে নীতিবাদে প্রতিষ্ঠিত হতে না পারলেও ক্রমাগত নীতিবাদের শিক্ষা, ব্যবহারিক মনশুদ্ধির সাধনা, সেবা ও ত্যাগের মধ্য দিয়েই মানুষকে নীতিবাদে প্রতিষ্ঠিত করবার প্রয়াস করতে হবে৷

মানুষের সমাজ গড়ার উপাদান

সার্থক সমাজ রচনার উপাদান ছয়টি ঃ–

(এক) আধ্যাত্মিক দর্শন–মানুষ কোথা থেকে এসেছে, কেন এসেছে, কোথায় সে যাবে, কী তার জীবনের লক্ষ্য–এই সব জীবন–জিজ্ঞাসার উত্তর দেবে এই আধ্যাত্মিক দর্শন৷ তা ছাড়া দেবে মানুষের চলার পথের শত সহস্র সমস্যার সঠিক সমাধান, হতাশার মুহূর্তে দেবে সাত্ব্ন্না, আর জোগাবে জীবনের চরম লক্ষ্যে পৌঁছবার প্রেরণা৷

(দুই) আধ্যাত্মিক সাধনা–দর্শন দেবে পথনির্দেশ, সাধনা ব্যবহারিক জীবনে এর পূর্ণ রূপায়ণ ঘটাবে৷ এই সাধনাই মানুষের দৈহিক, মানসিক, ও আধ্যাত্মিক বিকাশ ঘটিয়ে মানুষকে নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান করে তুলবে৷ এই সাধনাই মানুষের সুপ্ত সম্ভাবনার পূর্ণ জাগরণ ঘটিয়ে তাকে মহামানবত্বে উন্নীত করবে৷

(তিন) সামাজিক চেতনা–আদর্শ মানব–সমাজ গড়তে, চাই অধিক সংখ্যক মানুষের মধ্যে একটা অতি উচ্চ ধরণের সামাজিক চেতনা৷ এই সমাজে প্রতিটি মানুষ তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন থাকবে৷ এ পৃথিবীর মানুষকে বুঝে নিতে হবে, এই বিশ্ব একটি বৃহৎ একান্নবর্তী পরিবার৷ প্রত্যেক মানুষই এই বিশ্ব পরিবারের সদস্য৷ এই জাগ্রত চেতনার দ্বারাই মানুষ জাতিভেদ, সম্প্রদায় ভেদ, বর্ণভেদ, শোষণ, অনাচার, অবিচার নির্মূল করতে পারবে৷ কেবল আইন দ্বারা এ সব সম্ভব নয়৷ এই চেতনার ফলেই গড়ে উঠবে বিশ্বভ্রাতৃত্ব৷

(চার) সামাজিক ও অর্থনৈতিক তত্ত্ব–আদর্শ সমাজ ব্যবস্থায় একটা সুস্থ সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো থাকতেই হবে৷ মানুষের জীবনের বিকাশ ত্রিমুখী–অস্তি, ভাতি, আনন্দম্৷ মানুষ প্রথম চায় তার অস্তিত্ব রক্ষা করতে৷ এই সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো বিশ্বের প্রতিটি মানুষকে তার অস্তিত্ব রক্ষার উপকরণ জোগানোর গ্যারান্টি অতি অবশ্যই দেবে৷ এ সম্পর্কে প্রাউট নির্দেশিত সিদ্ধান্ত পরে আলোচিত হয়েছে৷

(পাঁচ) সমাজ–শাস্ত্র–সমাজের সব–সময় সামগ্রিক ভাবে সুনীতি ও কুনীতির মধ্যে সংঘর্ষ চলছেই৷ এটা মানুষের মধ্যের বিদ্যা–বিদ্যার সংঘর্ষেরই প্রতিফলন৷ আদর্শ–সমাজ ব্যবস্থায় কুনীতিকে দমিত ও সংযত করা এবং সুনীতিতে উৎসাহিত করার জন্য একটা যুগোপযোগী সামাজিক বিধি–নিষেধ থাকবে৷

(ছয়) আধ্যাত্মিক নেতা–তিনি হবেন অমিত শক্তিশালী অধ্যাত্ম–পুরুষ, যিনি উপরোক্ত পাঁচটি উপাদানের সমন্বয় ঘটিয়ে সমাজের বুকে এক আলোড়ন সৃষ্টি করে, এক নতুন সমাজের সুদৃঢ় বুনিয়াদ গড়ে তুলতে সক্ষম, যিনি ব্যক্তি ও সমষ্টি জীবনকে সামগ্রিকভাবে কল্যাণের পথে পরিচালনা করতে সমর্থ৷ সমাজের চরম সংকটময় মুহূর্তে যুগসন্ধিক্ষণে আবির্ভূত হয় সেই নেতৃত্ব যিনি একাধারে আধ্যাত্মিক গুরু, দার্শনিক ও নতুন সমাজ ব্যবস্থার প্রবক্তা৷

আজ আর কোন আদর্শই সমাজের এই চরম সংকটে কোন সমাধান দিতে পারছে না, তার কারণ এগুলিতে সমাজ–গড়ার ছয়টি উপাদান নাই৷ প্রউতেই এই ছয়টি উপাদানের সমন্বয় ঘটেছে৷