মানুষ যেদিন নিয়মের শাসন মেনে চলবে

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

পৃথিবী আজ অসুস্থ, না পৃথিবী নয়, পৃথিবীর মানুষ আজ অসুস্থ৷ তবু প্রকৃতির নিয়ম মেনে বাঙলার দুয়ারে  শরৎ এসেছে তার  চিরপরিচিত শোভা নিয়ে৷ নীল আকাশে শাদা মেঘের ভেলা, শিউলি-সুবাসে ভরা সকাল, ক্ষেতে ক্ষেতে সোনালী ধানের শীষ, নদীর পাড়ে ক্ষেতের আলে কাশের নাচন, বাতাসে বাঙালীর প্রিয় উৎসবের সুর৷ প্রকৃতি তার নিয়মের বাইরে কোন এক মুহূর্ত্তের জন্যেও নয়৷ তাই পৃথিবীর অসুখ প্রকৃতিকে নয়, গ্রাস করেছে মানুষকে৷ মানুষই এই ব্যধিকে ডেকে এনেছে৷ মানুষের বেহিসেবী বিশৃঙ্খল জীবন-যাপন, সীমাহীন লোভ-লালসা, আত্মম্ভরিতা পৃথিবীর  অসুস্থতার কারণ৷

মহাবিশ্বের সব কিছুই প্রকৃতির অমোঘ অটল নিয়মে বাঁধা৷ চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা, সাগর,নদী, বাতাস, জোয়ার-ভাটা এমনকি পশু-পাখী-কীট-পতঙ্গ তরু-লতা প্রকৃতির আশ্রিত কেউই মুহূর্তের  জন্যেও তার নিয়ম লঙ্ঘন করে না, করতে পারে না৷  শুধু মানুষ তার বুদ্ধি ও শক্তির অব্যবহার করে আপন স্পর্ধায় প্রকৃতির ওপর খবরদারী করতে  গিয়ে নিজেই বিনাশের কারণ হয়েছে৷ জীবনের  পরতে পরতে উচ্ছৃঙ্খলতা,সংযমহীনতা সামঞ্জস্যহীনতা বহে আনে মহাসংক্রমণ মারণব্যাধি, আর্থিক বিপর্যয়, সামাজিক অশুচিতা৷ মানুষের  সীমাহীন স্বার্থলোভ রোপণ করে চলেছে ভেদ-বিদ্বেষ-বিভেদের বীজ, দূষিত করে চলেছে তারই পরম আশ্রয়  প্রকৃতির পরিবেশকে৷  ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, সাধারণ চোখে অদৃশ্য এক অণুজীবত মানুষের জীবনযাত্রা স্তব্ধ করে দিয়েছে৷ মারণ ব্যাধির আতঙ্কে অতি প্রিয়জনের কাছ থেকেও দুরে সরে থাকতে হচ্ছে৷ বাইরে কর্মরতা মহিলা ঘরে ফিরে দুধের শিশুটিকে বুকে তুলে নেবার সাহস পায় না৷ অবুঝ শিশুর চোখে-মুখে মায়ের কোলে ওঠার আকুলতা, নিরুপায় মা ঝাপসা চোখে দুর থেকেই মুখ ফিরিয়ে নেয়৷ বিপর্যস্ত অর্থনীতি, বিপন্ন সামাজিক সম্পর্ক, থমকে গেছে শৈশব, বাল্য কৈশর৷

‘‘রবীন্দ্রনাথ বলেছেন---‘‘আমরা যখন কেবল নিজেরটি নিয়েই থাকি৷ তখন আমরা আমাদের বড় আত্মাটির প্রতি বিমুখ হই তাতে কেবলই আমাদের সত্যহানি হতে থাকে বলেই তার দ্বারা  আমাদের  বিকৃতি ঘটে৷ তাই স্বার্থের জীবন ভোগের জীবন কেবলই মলিনতা দিয়ে আমাদের লিপ্ত করতে থাকে---’’

আজ মানুষের ভোগ সর্বস্ব সৃষ্টিছাড়া জীবন জীবনের পরমলক্ষ্য ভুলে গেছে৷ স্বার্থ সর্বস্ব জীবন শুধু নিজেকে নিয়েই মগ্ণ থাকে৷ ভোগের আকাঙ্খা তাকে ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে অর্নিদিষ্ট অনাসৃষ্টির পথে৷ প্রকৃতির সব সম্পদ গ্রাস করেও ভোগের আকাঙ্খার  অবসান হয় না৷ মানুষ তার স্বার্থ-বুদ্ধি দিয়ে বিশ্ব প্রকৃতিকে শুধু নিজের জন্যে নিজের মতো করেই পেতে চায়৷ পাশের মানুষটির কথাও ভাবতে চায় না৷ মানুষের এই বেপরোয়া স্বার্থপর ভোগের আকাঙ্খাই তাকে লিপ্ত  করেছে রাশিকৃত গ্লানি আর মলিনতায়, লোভ রিপুর তাড়নায় সে ছুটে চলেছে হিতহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে৷ তাইতো ব্যষ্টি ও সমষ্টির জীবনে নেই কোনো সামঞ্জস্য, নেই কোন শৃঙ্খলা, নেই কোন নিয়মের  শাসন৷

মানুষের এই বেপরোয়া বিশৃঙ্খল জীবনের ফাঁক দিয়েই ধেয়ে আসছে মারন বাইরাস বুবোনিক প্লেগ, স্প্যানিশ ফ্লু---ইনফ্লুয়েঞ্জা, কোভিড-১৯---করোনা, বিজ্ঞানের দর্পচুর্ণ করে কেড়ে নিচ্ছে কোটি কোটি মানুষের  প্রাণ ৷ অসহায় মানুষ আত্মরক্ষার খোঁজে  প্রতিষেধক  বীজের মধ্যে, প্রতিরোধের  পথ পায় না৷ প্রতিষেধক ঔষধ একটা থেকে রেহাই দেয় তো আর একটা ধেয়ে আসে৷ বিজ্ঞানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ৪০০ বছর ধরে এই ভাবেই চলছে৷ ইতিমধ্যে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা করোনাকে করায়ত্ব করার আগেই আরও  বড় বাইরাস বিপর্যয়ের আগাম বার্র্ত দিয়ে দিয়েছে৷

দৈবদুর্বিপাকের  দোহাই দিয়ে এই বিপর্যয়ের দায় এড়ান যায়, কিন্তু বিপর্যয় থেকে রেহাই পাওয়া যায় না৷ মহাবিশ্বের সমস্ত প্রাণীন-অপ্রাণীন সত্তাই প্রকৃতির আশ্রয়ে প্রকৃতির অটল নিয়মে বাঁধা৷ এই নিয়মের লেশমাত্র শিথিল হবার উপায় নেই৷ তাই ঝড়, ভূমিকম্প, বন্যা, মারণ বাইরাস  যতবড় প্রলয় আসুক--- প্রকৃতি স্থির -শান্ত নির্লিপ্ত তার নিয়মের রাজ্যে কোন হেরফের হয় না৷ সূর্য-চন্দ্র-গ্রহ-নক্ষত্র সবাই সেই একের নিয়মে বাঁধা৷

শুধু মানুষই ব্যতিক্রম, সে নিজেকে কোন নিয়মের শাসনে বাঁধতে চায় না৷ প্রকৃতিকে সে নিজের সুবিধামত করে পেতে চায় নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করার একমাত্র অবলম্বন করে৷

এই পাওয়ার আকাঙ্খা পূর্তির জন্যে মানুষ বেছে নেয় বেপরোয়া বেহিসেবী বিশৃঙ্খল জীবন৷ হারিয়ে ফেলে তাইতো জীবনের ধর্ম মানুষের জীবন মলিনতা লিপ্ত, গ্লানিময়৷ সেই মলিনতা আর গ্লানিময় জীবনের ফাঁক দিয়েই প্রবেশ করে মারণ বাইরাস৷

মানুষ যেদিন বুঝবে প্রকৃতির নিয়মের রাজ্যে সেও নিয়মের  বাইরে নয়৷ যেদিন সে বুঝবে প্রকৃতির সম্পদে তার ততটুকুই অধিকার যতটুকু তার পঞ্চভৌতিক দেহের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে প্রয়োজন৷ এর বাইরে  তার জীবন সাধনার জন্যে ,বৃহৎ আত্মাকে জানার সাধনা, জীবনের পরমলক্ষ্যে উপনীত হওয়ার  সাধনা, পরম সত্যে লীন হওয়ার সাধনা৷ সেদিনই সে নিজেকে নিয়মের শাসনে ধরা দেবে৷ বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া শুধু কতকগুলো সংকীর্ণ আচার পালনই সে নিয়ম নয়, অন্তর থেকে যখন নিজেকে জানার এষণা জাগবে বৃহৎ আতঙ্কে উপলদ্ধি করতে পারবে, সেদিনই সে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মতন্ত্রে ধরা দেবে৷ তখনই তার নিষ্কলঙ্ক পবিত্র জীবনে কোন মারন-বাইরাস, কোন মলিনতা প্রবেশের দ্বার পাবে না৷ সুনির্মল শান্তিময় শুচিতায় জীবন প্রজ্বলিত হয়ে উঠবে৷