পূর্ব প্রকাশিতের পর,
দীর্ঘকাল ধরে একটা নির্দিষ্ট ভৌগোলিক তথা প্রাকৃতিক অঞ্চলে বহু পুরুষের অনুক্রমে বাস করতে করতে চলা, বলা, অর্থনৈতিক কাজকর্মে, নিত্যকর্মে রত মানুষের ভাবপ্রকাশে একটা আলাদা ধরণ তৈরী হয়ে যায়৷ একে এক কথায় বলে কৃষ্টি, আর এর সূক্ষ্ম পরিশীলিত রূপটাকে বলে সংস্কৃতি৷ অর্থাৎ মানুষের সামুহিক অভিপ্রকাশকে এক কথায় বলে সংস্কৃতি৷ পৃথিবীর জীব প্রজাতি (স্পেসিস্) হিসেবে মানুষের সংস্কৃতি একটাই৷ কেননা সব দেশের মানুষই খায়, কথা বলে, পোষাক পরে, নাচে, গান গায়, লেখে পড়ে, ছবি আঁকে, সাহিত্য রচনা করে, আচার-বিচার করে ইত্যাদি নানা মাধ্যমে ভিতরের ভাবকে প্রকাশ করে৷ কিন্তু ভৌগোলিক অঞ্চল ভেদে প্রাকৃতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ -ধর্মবিশ্বাস প্রভৃতির বৈচিত্র্যে তা আলাদা রূপ ও ধরণ হয়ে থাকে৷ তাই পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে ভারতীয় সংস্কৃতি আলাদা, আবার ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে অন্যান্য অঞ্চলের থেকে বাঙলা ও বাঙালীর সংস্কৃতি আলাদা৷ এই কৃষ্টি-সংস্কৃতির চেতনায় গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের পরস্পরের মধ্যে আত্মিক বন্ধন বা যোগসূত্র অনুভব করে৷ অর্থাৎ সংস্কৃতি মানুষকে একছাতার তলায় এনে দাঁড় করিয়ে দেয়৷
ভাষা মানুষের অন্তরের ভাবপ্রকাশের এক শক্তিশালী মাধ্যম৷ মানুষ মাত্ররই সকল আন্তর ভাবের শাব্দিক অভিপ্রকাশই হচ্ছে ভাষা৷ এই ভাষার প্রকাশ ঘটে বা আমরা শুনতে পাই বিশেষ বিশেষ ধবনির মাধ্যমে৷ এই ধবনির উৎপত্তি হয় ফুসফুস থেকে ঠেলে দেওয়া নিঃশ্বাস বায়ু থেকে৷ এই নিঃশ্বাস-বায়ু শ্বাসনালীর মধ্য দিয়ে এসে কন্ঠনালীতে পড়ে ও সেখান থেকে গলা ও নাকের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসে৷ এই বেরিয়ে আসা ধবনি আমরা শুনতে পাই৷ মানুষের এই বাঙনিষ্পত্তি ঘটে ছটি স্তরে৷ যথা ১) পরা, ২) পশ্যন্তী,৩) মধ্যমা,৪) দ্যোতমানা,৫) বৈখারী, ও ৬) শ্রুতিগোচরা৷ ভাষা হল ভাবপ্রকাশের একটা বাহন মাত্র৷ মানুষ যা কিছু বলছে, বলে বা বলবে, সেই বলার সম্ভাবনা শুধু যে প্রাণশক্তি হিসেবে মানুষের মধ্যে ছিল তাই-ই নয়৷ বাক্যের যে স্ফূরণ হবে সেই বাক্যটিও বীজ রূপে ব্যষ্টি-মানুষের নিহিত ছিল৷ সমস্ত অভিব্যক্তির বীজ যেখানে নিহিত রয়েছে, বীজকে ভাষায় রূপান্তরিত করা হয়নি---সেটাই হচ্ছে ‘পরা’---পরাশক্তি৷ মানবদেহে মূলাধার চক্রে এর অবস্থিতি৷
এই বীজাত্মক শক্তিকে ভাবজগতে যখন কল্পনার ভাব রূপ দেয়া হয় তখনও তা কল্পলোকেই রয়ে যায়৷ ধবনিশক্তির সেই অবস্থাকে বলা হয় ‘পশ্যন্তি শক্তি’৷ স্বাধীষ্ঠান চক্রে ঘটে এই পশ্যন্তি পর্ব--- মানে মানুষ কী বলতে চায় সেটা তার মনে দেখতে পাচ্ছে এই পশ্যন্তী যখন মণিপুরচক্রে এসে প্রথম জড়শক্তির বা প্রাণশক্তির সাহায্য পায় তখন বলা হয় ‘মধ্যমা শক্তি’৷ মণিপুর চক্রে ‘মধ্যমা’ স্তরে ভাব এলে ভাবকে ভাষায় রূপান্তরিত করবার একটা আকুতি দেখা যায়৷ অনেক সময় কিছু ভুলে গেলে বাংলায় আমরা বলি---‘কথাটা পেটে আসছে মুখে আসছে না৷ অর্থাৎ ভাবটা মণিপুরে এসে গেছে, কিন্তু তাকে ভাষায় রূপ দেয়া যাচ্ছে না৷ স্মৃতিভ্রংশের দরুণ স্মৃতিটা একটুখানি পুরোনো হয়ে গেছে৷ তাই অস্পষ্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবটাকে ভাষায় রূপ দেয়া যাচ্ছে না৷ এইটাই হচ্ছে---পেটে আসছে, মুখে আসছে না৷ এই মধ্যমার পরের ধাপটা হচ্ছে ‘দ্যোতমানা’৷ অর্থাৎ এবার ভাব ভাষায় রূপান্তরিত হচ্ছে৷ দ্যোতমানা---মানে সে কাঁপছে, ভাইব্রেশন দ্যোনমানতা দেখা দিয়েছে---তাই দ্যোতমানা৷ তারপরে দ্যোতমানা যখন কন্ঠে আসছে, বোক্যাল কর্ডে আসছে, তখন সে স্থূল ভাষায় রূপ হচ্ছে৷ সেটাকে বলা হয়, বৈখরী শক্তি৷
বৈখরী শক্তি হল যেখানে ভাবের ভাষায় রূপান্তর হয়ে যাচ্ছে৷ আর শেষে হচ্ছে শ্রুতিগোচরা৷ এখন জীব, আলজীব ও দাঁতের সাহায্য নিয়ে সেই বৈখরী শক্তি বাইরে ভাষারূপে ব্যক্ত হয়ে যাচ্ছে৷ এই ছ’টা হচ্ছে ভাষার অভিব্যক্তির স্তর৷ পৃথিবীর সব ভাষারই প্রথম স্তর পরা, দ্বিতীয় স্তর পশ্যন্তী, তৃতীয় স্তর মধ্যমা, চতুর্থ স্তর দ্যোতমানা একই৷ কিন্তু পঞ্চম স্তর বৈখরী ও ষষ্ঠ স্তর শ্রুতিগোচরা কেবল এই দুটো স্তর আলাদা৷ অর্থাৎ বৈখরী ও শ্রুতিগোচরা স্তরে ভৌগোলিক অঞ্চল ভেদে মানুষে মানুষে ভাষাটা আলাদা হয়, বাকীগুলো পৃথিবীর সব মানুষের এক৷ বস্তুতঃ শেষ দুটো স্তরের ভিন্নতার জন্যেই বিভিন্ন দেশের মানুষ বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে৷
পৃথিবীতে ভৌগোলিক---প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের কারণে আবার সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন জাতি, তাই সৃষ্টি হয়েছে তাদের বিভিন্ন প্রকারের ভাষা৷ বিভিন্ন দেহ-সংরচনার পার্থক্যের জন্যেও ভাষাগত এই পার্থক্য৷ সাধারণতঃ দেহ-সংরচনার পার্থক্য ছ’টি বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভরশীল৷ আর তা হল---রক্ত, নাসিকা, চক্ষু, কেশ, ত্বক, ও দৈর্ঘ্য৷ এই ছটা অঙ্গের পার্থক্য অনুসারে পৃথিবীতে বিভিন্ন রেস্ race) রয়েছে৷ তাই ভাষার বৈচিত্র্যের মূল কারণ হল রেসিও কালচালার ইনফ্লুয়েন্স্৷ (সূত্র---প্রভাতরঞ্জনের ব্যাকরণ বিজ্ঞান)৷ কার্যতঃ---বাস্তব পরিপ্রেক্ষিত হল মানুষের অবয়ব, জলবায়ু, পরিবেশ ও জনগোষ্ঠীগত বৈচিত্র্য হেতু বিভিন্নভাবে ভাষার অভিব্যক্তি ঘটে৷ তাই বহিরাঙ্গিক বিশ্বে ভাষাগত বিভিন্নতা৷ বাকপতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বললেন---‘‘মানুষের বাগযন্ত্র যদিও সব জাতের মধ্যে একই ছাঁদের তবু তাদের চেহারার তফাৎ আছে৷... বাগযন্ত্রের একটা সূক্ষ্ম ভেদ আছে৷ তাতেই উচ্চারণের গড়ন বদলে যায়৷ ভিন্ন জাতের মুখে স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণের মিশ্রণ ঘটাবার তফাৎ দেখতে পাওয়া যায় তারপরে তাদের চিন্তায় আছে ভিন্ন ভিন্ন ছাঁচ, তাতে শব্দ জোড়বার ধরণ ও ভাষার প্রকৃতি আলাদা করে দেয়৷
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ভাষার অভিব্যক্তির স্তর বিন্যাসের দুটো ভাগ---একটা অন্তরাঙ্গিক, অপরটা বহিরাঙ্গিক৷ আর এই দুই দিক থেকে দুটো বিষয় পরিষ্কার ---১) প্রতিটি ভাষার অন্তরাঙ্গিক ভাগের চারটি স্তর মানুষের অখণ্ড মানব সত্তার পরিচয় বহন করে, আর ভাষার বহরাঙ্গিক দুটি স্তর মানুষের পার্থিব জগতের আইডেন্টিটি বা ভৌমিক পরিচয় (সাকিমী পরিচয়) বহন করে, জগতে টিকে থাকতে বেঁচে থাকতে ইন্ধন যোগায়৷ ভাষা মানুষের ও সমাজের অস্তিত্বে ও উদ্বর্তনায় নিত্যসঙ্গী৷ তাই প্রতিটি ভাষায় সমান গুরুত্ব, সমান মর্যাদা৷ স্মরণীয়, ভাষার নির্ণায়ক শক্তির তুলনা মেলা ভার৷ কোন জনগোষ্ঠীকে একসূত্রে গাঁথতে ও তার বাসভূমির সীমারেখা নির্ণয়ে ভাষারও একটা বড় ভূমিকা থাকে৷ প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ডঃ নীহারঞ্জন রায় বলেছেন---‘ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক সীমা প্রধানত নির্ণীত হয় ভূ-প্রকৃতিগত সীমারেখা দ্বারা, ও তাহা সাধারণত অপরিবর্তনীয়৷ দ্বিতীয়তঃ এক জনত্ব দ্বারা, তৃতীয়তঃ ভাষার একত্ব দ্বারা৷ সাধারণতঃ দেখা যায়, বিভিন্ন প্রাকৃতিক সীমার আবেষ্টনীর মধ্যেই জাত ও ভাষার একত্ব-বৈশিষ্ট্য গড়িয়া ওঠে৷ (ক্রমশঃ)
- Log in to post comments