মানুষকে বিশ্বমানব হয়ে উঠতে হবে

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

সম্প্রতি এক রাজনৈতিক নেত্রীর ধর্মীয় উস্কানিমূলক মন্তব্য দেশ ও দেশের বাইরে ভারত সরকারকে যথেষ্ট বিব্রত হতে হয়েছে৷ এমন নয়, এই নেতারা বেআক্কেলের মতো এমন মন্তব্য করেছে৷ তারা জেনে বুঝে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে ও কর্মীদের চাঙ্গা করতে কখনো ও কখনোও রাজনৈতিক নেতাদের এই ধরণের মন্তব্য করতে হয়৷ আদর্শহীন ও আত্মকেন্দ্রিক রাজনীতির এটাই ধারা৷

কিছু মানুষও এই ধরণের মন্তব্য শোণার জন্যে ওতপ্রোতভাবে বসে থাকে৷ সুযোগ পেলেই হা-বের করে ঝাঁপিয়ে পড়ে৷ সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী তাঁর মার ১০০তম জন্মদিনে আববাস নামে এক বাল্য বন্ধুর কাহিনী শুনিয়েছেন৷ যদিও এই ঘটনার সত্যতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ণ তুলেছেন৷ তবু প্রধানমন্ত্রীর কথা বিশ্বাস করেই  বলতে হচ্ছে এই ঘটনা সেই কথাই প্রমাণ করে ভারতে সাম্প্রদায়িক বিভেদের মূলে রাজনৈতিক স্বার্থ, ধর্মীয় উন্মাদনা নয়৷ ধর্মীয় উন্মাদনাকে হাতিয়ার করে রাজনৈতিক নেতারা ব্যষ্টি ও দলের স্বার্থসিদ্ধি করে৷ ব্রিটিশ শাসক দেশছাড়ার আগে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক দলগুলিকে সাম্প্রদায়িকতার এই কৌশল শিখিয়ে গেছে৷ তারা ৭৫ বছর ধরে সেই কৌশলকে হাতিয়ার করেই দেশ শাসন করে চলেছে৷ সাম্প্রদায়িকতার ক্ষতে মলম দেবার কোন প্রয়াস আজ পর্যন্ত করেনি৷ কিন্তু প্রশ্ণ মানুষের শুভবুদ্ধির উদয় কবে হবে! 

এই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের কারণে ভারত পাকিস্তান দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে রাষ্ট্রীয় আয়ের  এক বড় অংশ সীমান্ত রক্ষায় খরচ করতে হচ্ছে দেশের সার্বিক উন্নয়নকে ব্যাহত করে৷ রাষ্ট্রনায়কদের অবশ্য এ নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই৷

ধর্মমতের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কোনোপ্রকার  ঘৃণা হিংসা-দ্বেষকে কোন শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়৷  আবার ওই সমস্ত ধর্মমতের অনুসারীদের মধ্যে যাঁরা  শুভ চিন্তার মানুষ তারাও কোনোভাবেই এই সমস্ত অযৌক্তিক উদ্ভট ভাবজড়তার সঙ্গে একমত হবেন না৷ মানব সমাজের ঐক্যের ভিতকে সুদৃঢ় করতে হলে প্রথমেই সমাজের  প্রতিটি ধর্মমতের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে৷ এটা হ’ল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রাথমিক ধাপ৷

সম্পূর্ণ যুক্তি বিবর্জিত এক ধরণের অন্ধ বিশ্বাসই হ’ল ডগ্‌মা অর্র্থৎ ভাবজড়তা৷ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দ্বিতীয় ধাপে এই অন্ধবিশ্বাস ও ভাবজড়তার বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করতে হবে৷ তাকে বোঝাতে হবে মনের যথার্থ ধর্মই হ’ল যুক্তি বিচারের পথ ধরে এগিয়ে চলা৷ অন্ধবিশ্বাস ও ভাবজড়তায় আচ্ছন্ন হয়ে আত্মকলহে মগ্ণ হলে এই অগ্রগতি ব্যাহত হবে ও মানুষ জড়ত্বে পর্যবসিত হবে৷ কবি বলেছেন,‘‘যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে / সহস্র শৈবাল দাম বাঁধে আসি তারে৷’’

সমাজরূপ নদী সে অবস্থায় তার গতি  হারিয়ে ফেলে, বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হবে৷ আর তা অজস্র  রোগের  ডিপো হয়ে উঠবে৷ তা মরণফাঁদ হয়ে উঠবে৷ যেকোনো যুক্তিবাদী  মানুষকে এটা বুঝতে হবে, অন্যকে বোঝাতে হবে৷

বর্তমানে এমনি বিভিন্ন ধরণের অযৌক্তিক ডগ্‌মা নিয়ে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধর্মমত৷ ধর্মমত বলতে আমি বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক ধর্মমতের কথাই বলছি৷ মানবধর্মের  কথা বলছি না৷ মানব ধর্ম যুক্তি ও বিজ্ঞানভিত্তিক --- সমস্ত মানুষের তা এক ও অভিন্ন৷ সেখানে মানুষের মধ্যে কোনো ভেদ নেই৷ ঈশ্বর এক অনাদি অনন্ত চৈতন্যসত্তা৷ এই মানবধর্ম প্রকৃতপক্ষে সমস্ত মানবের মিলনসূত্র---যা বিশ্বের সমস্ত মানবগোষ্ঠীকে এক সূত্রে গাঁথবার কথা বলে৷ আর সে সূত্র  হ’ল প্রেমের সূত্র, সবাইকে  আপন ভাবাবার ‘একাত্মতার সূত্র’৷ কারণ সবাই তো  এক পরমপিতার সন্তান৷ বিশ্বভ্রাতৃত্বই এর আদর্শ৷ 

এর আর এক নাম নব্যমানবতাবাদ, তার ভিত্তি হল, অন্তর্জগতে এক চৈতন্যময় পরমপুরুষের সঙ্গে নিজের মনকে মিলিয়ে দেওয়ার আন্তরিক প্রয়াস, আর বহির্জগতে সমস্ত মানুষ, পশু-পাখী-তরুলতা সবাইকে সেই এক পরমচৈতন্যের প্রকাশ রূপে ভেবে সবাইকে ভালবাসা, সবার সেবায় আত্মনিয়োগ করা৷ এটাই মানবধর্মের সারকথা৷ আনন্দমার্গ দর্শনের প্রবক্তা তাঁর প্রবর্তিত আনন্দমার্গ দর্শনে এই মানবধর্মের কথাই বলেছেন ও তাঁর রচিত গানের মধ্যেও শুণিয়েছেন---‘‘মানুষ যেন মানুষের তরে সব কিছু করে যায়, একথাও যেন মনে রাখে পশুপাখী তার পর নয়, তরুও বাঁচিতে চায়’’৷

তাই আজকের সাম্প্রদায়িকতার বিষে জর্জরিত মানব সমাজকে বাঁচাতে হলে প্রতিটি মানুষের উচিত, সমস্ত প্রকার ডগমাকে বর্জন করে,সেই এক উদার মানবধর্মের নির্মল আলোকে সবকিছুকে  দেখা, সেই  শক্ত ভিতের ওপর  মানবসমাজকে দাঁড় করানো৷ এরই মধ্যে রয়েছে সমস্ত প্রকার সামাজিক, অর্থনৈতিক রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান৷ একমাত্র এই পথেই আসবে বিশ্ব শান্তি৷ আজকে সমস্ত  প্রকার সংকীর্ণ অন্ধবিশ্বাস বা ধর্মমতের ঊধের্ব উঠে মানুষকে বিশ্বমানব হয়ে উঠতে হবে৷ এছাড়া মানবসমাজের বাঁচবার আর অন্য কোনো পথ নেই৷