মার্গগুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী সব ভাষা জানতেন

লেখক
আচার্য মন্ত্রেশ্বরানন্দ অবধূত

শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী (বাবা) যে পৃথিবীর সব ভাষাই জানেন এ বিষয়ে আনন্দমার্গীদের কোনও সন্দেহই ছিল না৷ কেননা ভ্রমণের সময়, জেনারেল দর্শনে ও মার্গীদের সঙ্গে কথা বলার সময় মাঝে মধ্যে বাবা বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন শব্দ, তার ব্যুৎপত্তি প্রভৃতি বিষয়ে অনর্গল বলে যেতেন৷ এমনকি ভাষাগুলির উৎপত্তি, ধ্বনিগত পরিবর্ত্তন প্রভৃতি সম্বন্ধে সহজ করে’ মার্গীদের বলতেন৷ বাবা বলতেন–সংস্কৃত ভাষা অন্যতম সমৃদ্ধ ভাষা৷ এর শব্দ ভাণ্ডার পাঁচ লক্ষেরও বেশী৷ ইংরাজীর শব্দভাণ্ডার সংস্কৃতের থেকে কম৷ ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার সবচেয়ে বেশী৷ এতে এক                                                                              লক্ষ পঁচিশ হাজারের বেশী শব্দ রয়েছে৷

সেটা ষাটের দশক৷ মুম্বাইতে সুভাষ নায়েক নামে একজন যুবক সবেমাত্র সাধনা শিখেছেন৷ তিনি পুরোনো মার্গীদের কাছে শুণলেন যে বাবা পৃথিবীর সব ভাষাই জানেন৷ মার্গীদের এই কথা তিনি বিশ্বাস করতে পারলেন না৷ তিনি ভাবলেন–এটা বড় জোর এমন হতে পারে যে বাবা কিছু ভাষা হয়তো জানেন, কিন্তু সব ভাষা জানবেন এটা অসম্ভব কথা৷ মার্গীরা নিশ্চয়ই বাড়িয়ে বাড়িয়ে এসব প্রচার করে’ থাকেন৷

একদিন তাঁর সুযোগ হয়ে গেল জামালপুরে গিয়ে বাবার দর্শন করার৷ সুভাষ ভেবেছিলেন যে বাবা নিশ্চয়ই সংস্কৃতে বিরাট পণ্ডিত৷ উত্তর ও পূর্ব ভারতের ভাষাগুলি যেহেতু সংস্কৃতের সঙ্গে গভীর সম্বন্ধযুক্ত সেহেতু হয়তো বাবা সেই ভাষাগুলিই জানেন৷ তিনি ভাবলেন তামিল ভাষায় সংস্কৃতের কোনও প্রভাব নেই বললেই চলে৷ সুতরাং তিনি যদি কিছু তামিল শব্দ ও বাক্য শিখে নেন তাহলে বাবাকে পরীক্ষা করা যাবে৷ সুভাষের পাশের বাড়িতেই একটা তামিল পরিবার থাকতেন৷ সুভাষ অনেক সাধ্য–সাধনা করে তাঁদের কাছ থেকে বেশ কিছু তামিল বাক্য ও শব্দ শিখে নিলেন৷

সৌভাগ্যক্রমে সেদিন বাবা ভাষাতত্ত্বের ওপরেই প্রবচন দিচ্ছিলেন৷ তিনি গ্রীক, ল্যাটিন ও সংস্কৃত ভাষার তুলনামূলক আলোচনা করেছিলেন৷ সেই সঙ্গে ভারতীয়  ও বৈদেশিক ভাষা সমূহের বিস্তারিত আলোচনা করছিলেন৷ রাশিয়ান ভাষা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বাবা বললেন যে, এর সঙ্গে সংস্কৃতের নিবিড় যোগ রয়েছে৷ বাবার আলোচনা শুণে সুভাষ ভাবলেন–এখানে তো কেউ রাশিয়ান ভাষা জানেন না৷ সুতরাং বাবার কথা যে ঠিক তা’ কী ভাবে জানা যাবে৷ সঙ্গে সঙ্গে বাবা সুভাষের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন–‘তোমরা অনেক জানো, আর তোমাদের বাবা কিছুই জানেন না৷ এই যে তরুণ মুম্বাই থেকে এসেছে সে শিক্ষিত ও বিরাট পণ্ডিত৷ ও অনেক ভাষা জানে এমনকি তামিল ভাষাও জানে৷’

বাবার কথা শুণতেই সুভাষের মনে হ’ল কেউ যেন এক কলসী জল তাঁর মাথার ওপরে ঢেলে দিলেন৷ সুভাষের মনে তীব্র গ্লানি এল৷ তিনি মনে মনে বাবার চরণে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে দিলেন৷ আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়েই তাঁর মানসিক গ্লানি ও উদ্বেগ দূর হয়ে গেল৷

বাবা মানসিক বিকাশের জন্যে তথা ভক্তের জ্ঞানের পরিধি বাড়ানোর জন্যে বিভিন্ন বিষয়ে মনোরম আলোচনা করতেন৷

একবার অখৌরী হিমাচল প্রসাদের জীবনে অদ্ভূত অভিজ্ঞতা হয়েছিল৷ তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বললেন–

‘‘একদিন আমি ট্রেনে করে’ বাবার সঙ্গে জামালপুর থেকে পটনা যাচ্ছিলুম৷ বাবা বিভিন্ন ভাষার ওপর আলোচনা করতে শুরু করে দিলেন৷ তিনি প্রথম আলোচনা শুরু করলেন উত্তর–পূর্ব ভারতের ভাষাগুলি নিয়ে৷ সে প্রসঙ্গে তিনি অসমীয়া ভাষার সঙ্গে অন্যান্য ভাষার কেমন সাদৃশ্য রয়েছে সে সম্বন্ধে অনেক উদাহরণ দিলেন৷ অসমীয়া ভাষার বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধেও বাবা অনেক কথা বললেন৷ এরপর তিনি চট্টগ্রাম জেলার বাংলা ভাষার আলোচনা প্রসঙ্গে এতে বার্মার ভাষার প্রভাব কতটা রয়েছে সে সম্বন্ধে বললেন৷ তারপর বাংলা ভাষার বিভিন্ন উপভাষা সম্বন্ধে উদাহরণ দিয়ে দিয়ে ব্যাখ্যা করলেন৷ বাবা এত সুন্দর ও সাবলীল ভাবে বলছিলেন যে সময়টা যে কী করে পার হয়ে যাচ্ছিল সেদিকে খেয়ালই ছিল না৷ এবার বাবা বিহারে প্রবেশ করলেন৷ বিহারের ভাষাগুলি আলোচনা করতে গিয়ে বাবা বললেন–সাধারণতঃ লোকে মনে করে যে বিহার ও উত্তর ভারতের ভাষাগুলি হিন্দী ভাষার উপভাষা৷ আর এই মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে জোর করে ওসব অঞ্চলের ভাষাভাষীদের ওপর হিন্দী ভাষা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ আসলে একটা ভাষা হবার জন্যে যে গুণাবলি থাকা দরকার সেই সব গুণই বিহারের ভাষাগুলি ও উত্তর ভারতের ভাষাগুলির মধ্যে রয়েছে৷ এদের উপর হিন্দীকে চাপিয়ে দেওয়া একটা জঘন্য পাপ৷ বাবা প্রসঙ্গ ক্রমে ভাষা ও উপভাষার পার্থক্য আলোচনা করে ভাষা হবার জন্যে যে শর্তগুলি থাকা দরকার তা ব্যাখ্যা করলেন৷ সেদিক থেকে বিচার করলে বিহারের তথাকথিত উপভাষা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, জম্মু–কশ্মীরের ভাষাগুলিকে কোনমতেই উপভাষা বলা যাবে না৷ তিনি এক এক করে বিভিন্ন ভাষার বাক্য বলতে লাগলেন ও পাশ্ববর্ত্তী ভাষার সঙ্গে সাদৃশ্য দেখাতে লাগলেন৷ এমন কি স্থানের পরিবর্ত্তনে কি ভাবে ভাষার পরিবর্ত্তন হচ্ছে তাও উদাহরণ দিয়ে বলতে লাগলেন৷ আমি অবাক হয়ে গেলুম যে বাবা কত সহজে সাবলীল ভাবে বিভিন্ন ভাষা সম্বন্ধে উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করে চলেছেন৷

এরপর বাবা মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা, পঞ্জাব, রাজস্থান, পাকিস্থানের ভাষাগুলি নিয়ে আলোচনা করলেন৷ সবচেয়ে বেশী আমি মুগ্ধ হয়ে গেলুম যখন বাবা পশতু ভাষা নিয়ে আলোচনা করলেন৷ পশতু পাকিস্তানের একটা বিশেষ অংশ ও আফগানিস্থানের বিরাট অংশের লোকের ভাষা৷ আমি অল্প অল্প পশতু ভাষা জানতুম৷ ভারত স্বাধীন হবার আগে বেতারে পশতু ভাষায় খবর পড়া হতো৷ আমি তা মন দিয়ে শুণতুম৷ বাবার পশতু উচ্চারণ খবর পড়া পশতু ভাষার চেয়ে আরও বেশী সুন্দর লাগতে লাগলো৷

এরপর বাবা ইয়ূরোপের ভাষাগুলি নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন৷ ভাষাগুলির উৎস হচ্ছে ল্যাটিন ভাষা৷ সে প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বাবা ফরাসী, স্প্যানিশ, জার্মান ভাষা সম্বন্ধে বললেন৷ জার্মান ভাষা সম্বন্ধেও আমার সামান্য ধারণা ছিল৷ সেই ভাষার খবর শোণারও আমার বিশেষ আগ্রহ ছিল৷ বাবার জার্মান ভাষা শুণে কেউই বলতে পারবেন না যে, একজন অ–জার্মান ভাষী এত সুন্দর জার্মান ভাষা বলে চলেছেন৷ বাবার আলোচনায় আমরা সব মোহিত হয়ে গেলুম৷ আলোচনা শুণতে শুণতে আমাদের খেয়ালই হয়নি যে আমাদের ট্রেন ইতোমধ্যে পটনা ষ্টেশনে এসে পৌঁছেছে৷ ভাষার আলোচনাও যে এমন উৎসাহব্যঞ্জক ও আকর্ষণীয় হতে পারে বাবার কাছে না শুণলে তা বোঝা যায় না৷ ভাষার আলোচনাও তিনি সরস গল্পের মতো করে আকর্ষণীয় করে তুলতেন৷’’

গুরু হিসাবে বাবার নজর থাকতো সব দিকে৷ অন্যদিকে বাবা হিসাবে তিনি সবার সঙ্গে এমনভাবে মিশতেন, কথা বলতেন যে সহজেই ভক্তগণের বাবার সঙ্গে এক গভীর সম্বন্ধ তৈরী হয়ে যেত৷

‘‘একদিন রামবাহাদূর বাবার সঙ্গে সান্ধ্যভ্রমণে গেছলেন৷ তিনি বাবার সঙ্গে খুব কাছের লোকের মতই অন্তরঙ্গভাবে কথা বলতেন৷ কখনোই কোন সঙ্কোচ বোধ করতেন না৷ বাবার সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে রামবাহাদূর বাবাকে একটা অনুরোধ করলেন–‘‘বাবা তুমি দয়া করে কি আমার আধ্যাত্মিক জীবনের ক্ষেত্রে একটা ছোট্ট ধাক্কা লাগাবে’’? বাবা বললেন ‘‘তুমি এ ব্যাপারে কী বলতে চাইছ?’’

রামবাহাদুর বললেন–‘‘বাবা আমরা জড়জাগতিক বিক্ষুব্ধ সাংসারিক জীবনের মধ্যে থাকি তো তাই আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে উচ্চস্তরীয় কোন অনুভূতি ঠিক হয় না৷ কিন্তু তুমি যদি একটা দয়া করে ছোট্ট ধাক্কা লাগিয়ে দাও তাহলেই সাধনায় আমি উচ্চস্তরীয় অনুভূতি লাভ করতে পারবো৷’’

বাবা একটু হেসে বললেন–‘‘দেখ রামবাহাদুর এই ধরণের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা কঠোর সাধনার মধ্য দিয়েই লাভ করতে হয়৷ এর জন্যে আমার বিশেষ সম্প্রেষণের দরকার নেই৷ আমি সব সময় তোমাদের সঙ্গে থেকে বড় ধরণের বাধাকে সরিয়ে দিচ্ছি যাতে তোমাদের আধ্যাত্মিক প্রগতির কোন বাধা না হয়৷ যদি তুমি শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে যথার্থভাবে তৈরী না হও আর আমি যদি কোন প্রকারের অনুভূতি দিই তবে তুমি তা সহ্য করতে পারবে না৷’’

রামবাহাদুর তবুও বার বার বাবাকে অনুরোধ করতে লাগলেন৷ ইতোমধ্যে তাঁরা বাঘের কবরে পৌঁছে গেলেন৷ কবরের ওপর বসে বাবা রামবাহাদুরের মাথার পেছনে একটা আলতো স্পর্শ করলেন৷ সহসা রামবাহাদূর অনুভব করলেন যে কয়েক হাজার সূর্য যেন তার চোখের সামনে এসে হাজির হয়েছে, তাকে সহ্য করা অসম্ভব৷ রামবাহাদুর চোখ বন্ধ কবে ফেললেন৷ সেই অবস্থাতেই সেই সূর্যের আলো দেখতে লাগলেন৷ রামবাহাদুর এই অভিজ্ঞতা থেকে রক্ষা পেতে বাবার কাছে কাতর বিনতি জানালেন৷ বাবা আবার রামবাহাদুরের মাথার পেছনের দিকে স্পর্শ করলেন৷ সঙ্গে সঙ্গে সেই দিগন্ত প্লাবিত সূর্যালোক মিলিয়ে গেল৷ কিন্তু রামবাহাদুর এক আনন্দসরোবরে ডুবে গেলেন৷ অনির্বচনীয় সেই অনুভূতি রামবাহাদূরের জীবনে বেশ কয়েকদিন স্থায়ী হয়েছিল৷’’