মাতৃভাষায় জ্ঞান ও রসভান্ডার নির্মাণ

লেখক
আকাশ তরঙ্গ

নিত্যদিন এই বাগানের পথ দিয়ে এই বাড়িটায় (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিল্ডিং) ঢোকার সময়ে মাঝেসাঝেই আমার মনে পড়ে তিন শিক্ষকের কথা৷ পঞ্চাশের দশকে তিনজনেই এখানে কর্মরত ছিলেন, দুজন অল্প কিছুকাল, একজন আজীবন৷ মেইন স্টাফরুমে ভারি বার্মাসেগুনের চেয়ারগুলোয় বসে আড্ডা দিয়েছেন, হয়তো একসঙ্গে বেরিয়ে ওয়েলিংটন থেকে ট্রাম ধরেছেন কলেজ স্ট্রিটের৷

একুশে ফেব্রুয়ারি আমার বার বার মনে পড়ছিল এঁদের কথা৷ আমার মনে পড়ছিল প্রায় প্রতি বছর কোনো না কোনো ক্লাসে আমার নেপালি ভাষী, কিংবা সাঁওতাল মুন্ডা ওঁরাও ছাত্রছাত্রীদের কথাও৷ এবছর এম এ ক্লাসে একজন চিনা (ক্যান্টনিজ) ছাত্র আছে, এত বছরে আমার দেখা এই প্রথম৷ এঁদের কারোরই এই বাড়িটায় মাতৃভাষায় পঠনপাঠন তো দূর, কথা বলারও সুযোগ নেই৷ আমাদের স্টাফরুম লাগোয়া ক্যান্টিনে চা জলখাবার বানান যে দিদি, তিনি হিন্দি-মেশানো ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথা বলেন৷ আমি অবশ্য জানি দিদি তরাইয়ের নেপালিভাষী, মাঝেসাঝে আমি দিদির সঙ্গে আমার জংধরা নেপালিতে বাক্যালাপ চালিয়ে দুজনে খুব মজা পাই৷ সেদিন কথাচ্ছলে জানলাম দিদিকে রান্নায় সাহায্য করেন ওঁর যে ভাতৃবধু, তাঁর মায়ের ভাষা মৈথিলী৷ দেশের বাড়ি গেলে তিনি মায়ের সঙ্গে কী বুলিতে কথা বলেন, শোনালেন একটু৷

এসব নিয়ে আমরা হাসি গল্প করছি, এসে ঢুকলেন আমাদের এক সংস্কৃতের অধ্যাপক, হিন্দিভাষী৷ ‘তোমার মাতৃভাষা কী?’ আমি জানতে চাইলাম৷ তিনি কিছু না ভেবেই বললেন, ‘কেন, হিন্দি?’

‘হিন্দি কোনো মাতৃভাষা নয়,’ আমি ওঁর বিপুল পেটে তর্জনির খোঁচা মেরে বললাম৷ ‘ঠিক করে বলো!’

তিনি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, ‘‘আমার মায়ের মাতৃভাষা অঙ্গিকা৷ আমার বাবার মাতৃভাষাও অঙ্গিকা৷’’

জানা গেল, অঙ্গিকা একদা অঙ্গ অঞ্চলের ভাষা৷ তিনিও শোনালেন মায়ের মুখে শোনা কিছু বুলি৷ জানালেন, তাঁর সন্তানেরা স্বাভাবিকভাবেই এই ভাষা বোঝে না৷ দিদির ভাতৃবধুর সন্তানেরাও মৈথিলী জানে না৷ দিদিও তাঁর কলকাতার বাসায় নেপালি বলেন না, তাঁর স্বামী হিন্দিভাষী৷ দিদির মায়ের ভাষা কি আদতেই নেপালি, নাকি লিম্বু, তামাং কিংবা... দিদি জানেন না৷

আমাদের চিনা ছাত্রের চার পুরুষ ভারতে বাস৷ সে ক্যান্টনিজ জানে না, জানে তার মা৷ উনি ট্যাংরায় গ্রেস লিং লিয়াং স্কুলে পড়েছেন৷ দিন কয়েক আগে চিনা নববর্ষে ছেলের হাত দিয়ে মা-ফা নামে ওঁদের ঘরে বানানো সুস্বাদু নববর্ষের খাবার পাঠিয়েছিলেন৷ আমার অসংখ্য জনজাতি ছাত্রছাত্রী বন্ধু সতীর্থ, যাঁরা কেউ কেউ সংরক্ষণের সুযোগ পেয়ে কিংবা অন্য কোনোভাবে পরিযায়ী হয়েছেন, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, তাঁরা তাঁদের মাতৃভাষার শেষ প্রতিনিধি৷

এঁদের সকলেরই একটি করে একুশে ফেব্রুয়ারি থাকতে পারত৷ থাকেনি, থাকে না৷ মাতৃভাষা আত্মপরিচয়ের অস্ত্র হয়ে ওঠে, অস্মিতার দাউ দাউ আগুন হয়ে ওঠে, কোনো কোনো বিরল ঐতিহাসিক মুহূর্তে৷ যেমন বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে হয়েছে, যেমন আমাদের এই রাজ্যেই নেপালি ভাষার ক্ষেত্রে হয়েছে, ভারতবর্ষে সম্ভবত সবচেয়ে পুরোনো ভাষা অস্মিতার আন্দোলন সেটি৷ তা বাদে মাতৃভাষারা মরে নিঃশব্দে পাখির মতো৷ কখন যে আধিপত্যবাদের চাপে আর কখন যে নির্জীব নিস্ক্রিয়তায়, কখন যে হত্যাকারীকে আলিঙ্গন করে হত, সে পরিমাপ করা বড় কঠিন৷ একুশে ফেব্রুয়ারির আগের দিনই একটি সমস্যা নিয়ে অধ্যক্ষের সঙ্গে মিটিংয়ে বসেছিলাম আমরা, ইংরেজি বিভাগের শিক্ষকেরা৷ বিষয়টি পুরোনো, তবে নতুন রূপে এসেছে আবার৷ নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির চার বছরের স্নাতক পাঠ্যক্রমে সকল বিষয়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রথম দুটো সেমেস্টার ইংরেজি ভাষার দুটি পেপার বাধ্যতামূলক৷ পরের দুটি সেমেস্টারে কোনো আধুনিক ভারতীয় ভাষা Modern Indian Language– MIL) নিতে হবে, যে ভাষাটি সে বারো ক্লাস অব্দি পড়েছে৷ ধরে নেওয়া যায় সেটি হবে তার মাতৃভাষা, তবে অন্য কোনো ভাষাও হতে পারে৷ সেই ভাষাটি পড়ানোর মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যদি কোনো বিভাগ না থাকে, তাহলে অগত্যা বিকল্প হিসেবে তাকে ইংরেজি, অর্থাৎAlternative English দিতে হবে৷

আমাদের কলেজ কলকাতা শহরে একটি বিরল প্রতিষ্ঠান যেখানে ছটি ভাষার বিভাগ আছে৷ অথচ দেখা যাচ্ছে অসংখ্য ছাত্রছাত্রীMIL না নিয়েAlternative English নিতে চাইছে৷ একটি কলেজের সব বিভাগ মিলিয়ে বিপুল সংখ্যক পড়ুয়া চারটি সেমেস্টার ধরে একটিই ভাষা পড়বে, এটা শুধু একটি বিভাগের পক্ষে বিপুল চাপের নয়, শিক্ষানীতির ভাষাভাবনারও পরিপন্থী৷ সেই নিয়েই ছিল মিটিং, এবং খোঁজ নিয়ে দেখা গেল যেসব ছেলেমেয়েMIL না নিয়ে ইংরেজি নিতে চাইছে তারা সকলেই বাংলাভাষী, বারো ক্লাস পর্যন্ত দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলা পড়েছে৷ ভাবছিলাম, একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের কোন আবেগের যুক্তি দিয়ে এদের বাংলা ভাষার পঠনপাঠনে ফেরানো যাবে? আত্মপরিচয়ের অস্মিতা? সেটা ঠিক কী ভাষায় কীভাবে বলে তাদের হৃদয়ে পৌঁছনো যাবে? ১৭-১৮ বছর বয়সী একদল তরুণ, বেশিরভাগই উচ্চশিক্ষিত নাগরিক পরিবারের, বেশিরভাগই ইংরেজি মাধ্যম ইস্কুলে পড়েছে, তারা ইংরেজি অনুবাদে ফেলুদা পড়ে, এক বিচিত্র অশুদ্ধ বাংলায় কথা বলে, তারা তাদের নিজেদের ভবিষ্যতকে দেখে এ রাজ্যের সীমানার বাইরে, তাদের কাছে মাতৃভাষা যে এক প্রাদেশিক সংযোগের থেকেও বেশি কিছু সেটা কীভাবে বোঝানো যাবে? ভাবছিলাম৷

ভাবছিলাম এই প্রতিষ্ঠানের সেই তিন শিক্ষকের কথা৷ একজন ইংরেজি সাহিত্য পড়াতেন, যদিও আজীবন বাংলা ভাষায় লিখে গিয়েছেন৷ অন্য দুজন ইতিহাসের, এখানে কিছুদিন পড়িয়ে বিদেশে গিয়েছেন, আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেছেন৷ আজীবন লেখালিখি সবই করেছেন ইংরেজিতে৷ তারপর একজন আশি আরেকজন নববইয়ের কোঠায় পৌঁছে মাতৃভাষায় বই লিখতে শুরু করেছেন৷ বাংলায় ফিরেছেন---এভাবে বলা যাবে? নাকি, বাংলাটাকে সঙ্গে নিয়েই বিশ্বজয় করতে গিয়েছিলেন? শেষ জীবনে গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো করলেন?

মাতৃভাষা তো নিছক সংযোগের মাধ্যম নয়, আত্মপরিচয়ের অস্মিতাও নয় সর্বত্র, মাতৃভাষায় সঞ্চিত থাকে অনেক প্রজন্মের অর্জিত অন্তরঙ্গ জ্ঞান, এক অনন্য বীক্ষাও৷

সেটা কীরকম? এই যেমন শুনেছি ইনুইট ভাষায় নাকি ৩২ রকম তুষারের প্রতিশব্দ রয়েছে, লেপচা ভাষায় রয়েছে জলের ১৮ রকম ছাঁদের৷ সেদিন এক নিকট আত্মীয়া, এক বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে কলকাতার নগরায়নে জলবায়ুর প্রভাবের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছেন, হোয়াটস্যাপে জানতে চাইলেন ‘হাবড়’ জিনিসটা ঠিক কী? ‘হাতি হাবড়ে পড়েছে’ ---ছোটবেলায় তিনি শোনেননি৷ জানা গেল, তাঁর গবেষণার অনেক মূল্যবান প্রাথমিক উৎস ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন অপ্রচলিত বাংলা ছড়ায়, বুলিতে, লোককাহিনীতে৷ এরকম জ্ঞানচর্চার সব শাখাতেই আছে, আলিবাবার গুপ্তভান্ডার, যার চিচিং-ফাঁকটি কিন্তু রয়েছে মাতৃভাষায়৷

একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই আমরা যে নিয়ম করে একালের আংলা-বাংলাদের নিয়ে তামাশা করি, ভবানীপ্রসাদের ছড়া আওড়াই, কিংবা বাংলাচর্চার আসন্ন মৃত্যুর শোকগাথা গাই, এটা কিন্তু নতুন কিছু নয়৷ উনিশ শতকের মাঝামাঝিও ইংরেজি ভাষার আধিপত্যে হ্যাট-ক্যাট-ম্যাট হুতোমি প্রজন্মের উদ্ভব ঘটেছিল, সুকুমারী বকচ্ছপ ট্যাঁশগরু, বাংলা ভাষার গেল গেল রব উঠেছিল৷ কিন্তু যায়নি৷ তার কারণ একদল উজ্জ্বল পরিশ্রমী বাঙালি কোমর বেঁধে মাতৃভাষায় জ্ঞান ও রস নির্মাণের কাজে নেমেছিলেন৷ ফলে ইংরেজি ভাষার আধিপত্যবাদের ধর্ষণটা বদলে যায় প্রেমালিঙ্গনে৷ সেই প্রেমের টানেই বাংলার প্রথম আধুনিক কবি ও নভেল লেখক প্রথমে ইংরেজিতে লিখতে শুরু করে বাংলায় ফিরলেন৷

সেই ধারা বজায় রেখেই আমার কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক বিষ্ণু দে আজীবন বাংলায় লিখবেন, এবং দুই প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী ও রণজিৎ গুহ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বাংলায় লিখতে শুরু করবেন৷ এসবই কিন্তু সম্ভব হয়েছে মাতৃভাষায় জ্ঞান ও রসভান্ডার নির্মাণের সেই আশ্চর্য প্রকল্পের জন্য৷

আর আজ? ছবিটা ঠিক কী? থাক, সে অন্য প্রসঙ্গ৷ ---লেখক- শ্রী পরিমল ভট্টাচার্য৷