মহা সংকল্প দিবস

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

মানবতা যখন এক অত্যন্ত বেদনাদায়ক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে, ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা, বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতি অর্থনীতি রাষ্ট্রনীতি-সমাজ জীবনের সর্বস্তরে যখন গ্লানি দেখা দেয়, সর্বস্তরেই অধর্মের প্রার্দুভাব দেখা দেয়, সেই অধর্মের হাত থেকে গ্লানির হাত থেকে  পরিত্রাণ পাওয়া মানুষের সাধ্যের বাইরে, তখনই পরমপুরুষকে অবতীর্ণ হতে হয় ধরাধামে অধর্মের হাত থেকে অশুভ শক্তির হাত থেকে সমাজকে পরিত্রাণ করতে৷

সমাজের সর্বস্তরে যখন অশুভ শক্তির প্রাদুর্ভাব, ধর্মের  গ্লাণি ও অধর্মের অভুৎত্থানে মানুষ যখন অতিষ্ঠ, শাসনে শোষণে জর্জরিত তখনই সেই অশুভ শক্তির হাত থেকে  মানুষকে, মানুষের সমাজকে পরিত্রাণ দিতে ১৯২১ সালের  বৈশাখী পূর্ণিমার শুভলগ্ণে ধরাধামে অবতীর্ণ হলেন পরমপুরুষ পাঞ্চভৌতিক আধারে আনন্দমূর্ত্তিরূপে৷

তিনি চিরকালই ছিলেন, আছেন ও থাকবেন৷ তিনি তো শাশ্বত চৈতন্য কিন্তু আমরা তো চর্মচক্ষে তাঁকে দেখতে পাচ্ছি না৷ তাই তিনি যে আছেন–এ বিশ্বাসটাই আমরা সম্পূর্ণ হারিয়ে বসেছিলুম৷ ভাবছিলুম এই অন্ধকারটাই চিরসত্য৷ আলো বলে কিছু নেই৷ তিনি নেই, কখনো ছিলেনও না, থাকবেনও না৷ অন্ধকারের জীবেরা তাদের পিশাচ–নৃত্য চালিয়ে যাচ্ছে ও অনন্তকাল ধরে তা চালিয়ে যাবে৷ এই পিশাচ–নৃত্য চিরন্তন সত্য৷ এর থেকে পরিত্রাণের কোনও পথ মানুষের জানা নেই৷ তাই নিপীড়িত মানবতার দীর্ঘশ্বাসে আকাশ বাতাস ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল৷ আমরা যারা তাঁর সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্য লাভ করেছিলুম, হঠাৎ আমাদের ঘুম ভেঙ্গে গেল৷ আমরা অবাক বিস্ময়ে তাঁর সুস্মিত আননের পানে তাকিয়ে রইলুম৷ হতাশার কালো মেঘ কেটে গেল৷ না, তিনি তাহলে আছেন৷ অন্ধকারে পরপারে রয়েছে আলোর প্লাবন৷ না অন্ধকারের পরপারেই বা বলছি কেন, তিনি যে ‘জ্ঞানাঞ্জন শলাকা দিয়ে আমাদের চক্ষু উন্মিলিত’ করে দিয়েছেন তাই আমরা দেখতে পেলুম, যাকে আমরা অন্ধকার বলছি, এরই মাঝে রয়েছে আলোর নর্তন৷ আমাদের চোখ এতদিন ঢ়াকা ছিল অন্ধকারের আবরণে৷ তিনি সেই আবরণ উন্মোচন করেছেন৷ দেখলুম, অমানিশার ঘনায়মান অন্ধকারের বুক চিরেই ফুটে উঠল আলোর শুভ্রজ্যোতি৷ দেখলুম, দুঃখের অকুল পাথারের জগদ্দল পাষাণ সরিয়ে আনন্দমূর্ত্তি রূপে তিনি আমাদের সম্মুখে বিরাজমান৷

এমনিভাবেই যুগে যুগে তিনি আসেন৷ এবারও ক্ষণকালের জন্য চারিদিকে বিদ্যুৎ–ঝলক ছড়িয়ে দিয়ে আবার তিনি অদৃশ্য হয়ে গেছেন৷

কিন্তু আমাদের হাতে তিনি তুলে দিয়ে গেছেন একটা অভিনব স্পর্শমণি৷ কবি কল্পনার স্পর্শমণি যেমন সব কিছুকেই সোণায় পরিণত করে দেয়, আনন্দমার্গের দর্শনও ঠিক তেমনি যে সমস্যার ওপরই প্রয়োগ করা হোক না কেন, ন্যায়–ধর্ম সম্মত সদুত্তর সে অবশ্যই বের করে দেবে৷ অন্ধকারে আলোর পথের নিশানা আমরা খুঁজে পাবই পাব৷

মহাসম্ভূতি শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী পার্থিব দেহের মহাপ্রয়াণ দিবস তাই প্রকৃতপক্ষে মহাসংকল্প দিবস৷ তাঁর সর্বানূ্যসূ্যত দর্শনকে হাতিয়ার করে আজ সমাজের সর্বস্তরে যে শোষণ ও সমস্যা–দানবের পিশাচ–নৃত্য চলেছে সেই দানবের কবল থেকে আমরা মানব সমাজকে মুক্ত করবই করব৷ মহাপ্রয়াণ দিবস তাই মহাসংকল্প গ্রহণের দিবস৷ অতীতের সমস্ত ভুল–ভ্রান্তি–গ্লানি–ক আবর্জনাকে প্রবল বেগে দূরে নিক্ষেপ করে আমরা আমাদের জীবনকে ও জগৎকে অত্যুজ্জ্বল আলোকের আদর্শে গড়ে তুলবই তুলব৷ প্রভাতের অরুণ আলোয় বিশ্বভূবনকে উদ্ভাসিত করবই করব৷ তিনি আশ্বাসও দিয়েছেন এই সুমহান কাজে পরমপুরুষের বরাভয় হস্তের কৃপা সর্বদাই আমাদের সঙ্গে রয়েছে৷ আমাদের এই মহাসংকল্প বাস্তবায়িত হবেই হবে৷