মীরজাফরদের চীনে  নিতে বাঙলা কি ভুলই করে যাবে?

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

মানবজাতির ইতিহাস সাক্ষ্য বহন করে চলেছে যে, আমাদের পৃথিবীর বুকে, যে কয়েকটি স্থানকে ঘিরে প্রথমে মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল,তাদের মধ্যে রাঢ়ভূমিতে সর্বপ্রথম মানব সন্তান ভূমিষ্ট হয়েছিল৷ প্রাউট দর্শনের প্রবক্তা মহান দার্শনিক এ প্রসঙ্গে আলোচনায় উল্ল্যেখ করেছেন যে, রাঢ়ের পূর্বে পৃথিবীর অন্যকোথাও মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল বলে এখনও অব্দি এমন কোন নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি৷ দ্বিতীয়ত প্রাউট প্রবক্তা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার, তাঁর রচিত ‘সভ্যতার আদি বিন্দু রাঢ়’ বইতে প্রামাণ্য তথ্য-প্রমাণাদি সহই সুষ্পষ্টভাষাকে উল্ল্যেখ করেছেন যে, রাঢ়ের লালমাটিতেই পৃথিবীতে মানব-সভ্যতারও সূত্রপাত ঘটেছিল৷ এর কিছু প্রমাণ অবশ্য আমাদের  হাতের কাছেই মজুত রয়েছে, যেমন পৃথিবীর প্রথম দার্শনিক কপিল মুনি ছিলেন রাঢ়ের সন্তান৷ রাঢ়ের মানুষরাই কৃষির আবিষ্কর্তা৷ রাঢ়ের যাঁরা আদি সন্তান তাঁদেরকে বলা হয়েছে,‘অষ্ট্রিক গোষ্ঠীর মানুষ’৷ তাঁরা যে ভাষায় কথা বলতেন তার নামও ছিল অষ্ট্রিক ভাষা৷ অষ্ট্রিক ভাষারই শব্দ রাঢ়, যার বাংলায়  মানে হয়--- ‘লাল মাটির দেশ’ বিশ্বকবি ওই রাঢ়ের  বীরভূমের  বোলপুরের লালমাটি  দেখেই বোধ হয় কবিতা রচনা  করেছিলেন---‘‘গ্রামছাড়া ওই রাঙামাটির পথ আমার মন ভোলায় রে৷’’ বাঙলার প্রখ্যাত কবি ও ছন্দের জাদুগর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখনীতে প্রাণের আকুতি ফুটে উঠেছে---

‘‘গঙ্গা---রাঢ় পালরাজার বীর্য গরিমা/ চণ্ডীদাস জয়দেবের ছন্দমহিমা/ ঢেউ তাদের দেয় মোদের চিত্তে নববল?

সুতরাং বলতে দ্বিধা নেই যে, নিজেদের আত্মপরিচয় ও মাতা পিতার-পরিচয় বা পূর্ব-পুরুষদের  পরিচিতি---প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে গেলেই বাঙলার কথা মুখে চলে আসে আবার বাঙলার কথা বলতে গেলেও রাঢ়ের কথাটাই সর্বাগ্রে মানসপটে একেবারেই সবার উপরের ভেসে ওঠে৷ এটা তো কিছুতেই মুছে ফেলা যায় না--- এযে আমাদের নাড়ীর গভীর টান শিরা--- ধমনীতেও প্রবহমান স্রোতস্বিনী৷ এ যে আমাদের জন্ম-জন্মান্তরের মাটির টান,ভাষার টান, রক্তের টান, প্রাণের টান৷ ভাবতে গেলেই বিমূর্ত্ত অতীত এসে সামনে মূর্তিমান হয়ে দাঁড়ায়৷ কারণ?

কারণ তো অবশ্যই রয়েছে বৈকি! কেননা, অতীতে ‘ভারতবর্ষ’ নামের দেশটারও যখন অস্তিত্ব ছিল না তখন বাঙালীর পূর্বপুরুষ রাঢ়ের অধিবাসী অষ্ট্রিক-গোষ্ঠীর মানুষদের পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করা হয়ে গিয়েছিল৷ আর্যরাও ভারত ভূখণ্ডে প্রবেশ করার বহুপূর্ব থেকে রাঢ়বাসীদের তন্ত্রভিত্তিক ও কৃষি নির্ভর সভ্যতার পত্তন ঘটে গিয়েছিল৷ পরবর্তী সময়ে অষ্ট্রিক রক্তের সঙ্গে নিগ্রোয়েড রক্তের মিশ্রণে আবির্ভাব ঘটল দ্রাবিড় গোষ্ঠীর৷ আরও পরে অষ্ট্রিক--- দ্রাবিড় ---মঙ্গোলীয়---আর্য---রক্তের সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছিল আজকের বাঙালী জনগোষ্ঠী৷ এথেকে স্পষ্ট যে পৃথিবীর  চারটে প্রধান নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীদের রক্তের বিমিশ্রিত ধারা বইছে আধুনিক বাঙালীর শিরা ধমনীতে৷ দ্বিতীয়তঃ বাঙালী সভ্যতা কিংবা সংসৃকতিও গড়ে উঠেছে বিমিশ্রণ প্রক্রিয়ায়৷ রাঢ়ীয়, ব্রহ্মপুত্র আর গাঙ্গেয় বদ্বীপীয়--- তিন তিনটে  সভ্যতার বিমিশ্রিত  এক জটিল সভ্যতা হচ্ছে বর্তমান বাঙালী সভ্যতা৷ সুতরাং জনগোষ্ঠী হিসেবে যেমন শংকরজাতি হিসেবে বাঙালীর কোন তুলনা নেই৷ সারা বিশ্বে তদ্রূপ প্রাচীন  ও উৎকৃষ্ট সভ্যতারও পৃথিবীতে বাঙালী সভ্যতার তুলনা মিলছে না৷ তদুপরি বাঙালী কালচার বা সংসৃকতিও হচ্ছে সম্পূর্ণস্বকীয়তার বৈশিষ্ট্যে অত্যুজ্জ্বল, যে জন্যে পৃথিবীর প্রাজ্ঞবানদের দৃষ্টিতেই বলা রয়েছে---অ্যান ইন্টিগ্রেটেড্‌ বেঙ্গলী কাল্‌চার৷

সুতরাং, দেখা যাচ্ছে বাঙালীর জাতিগত উৎস কিংবা জনগোষ্ঠীটার প্রাচীন ঐতিহ্য ও ইতিহাস খুঁজতে বলতে আমরা অনায়াসেই দেখতে পাচ্ছি যে--- আর্য- অনার্য- দ্রাবিড় -চীন- মঙ্গোলীয়-নিগ্রো ও তৎপর কালে  কালে শক---হুন- খিলজি-তুর্কী, পাঠান-মোগল-ইউরোপীয় ইত্যাদি বহু জনগোষ্ঠীদের রক্তের ধারা যেমন এসে মিশেছে, তেমনি তাদের ভাষা- কৃষ্টি- সংসৃকতি- স্থাপত্য- ভাস্কর্য এ সবেরও মিলন ঘটেছে যুগ-যুগান্তরের প্রবাহে৷ তাই, বাঙালী জনগোষ্ঠীটার রক্তের আর সভ্যতার- সংসৃকতিতে নানান-মিশ্রণের মত মানসিকতার ক্ষেত্রেও সেই বৈচিত্র্যপূর্ণ ধারার সংমিশ্রণ ঘটে গেছে--- এটাও কিন্তু ধ্রুব-সত্য৷ তাই তো দেখি --- বাঙালীদের মধ্যে হীনবৃত্তিসম্পন্ন দুষ্ট প্রকৃতির লোকেরা যেমন রয়েছে, তেমনি পৃথিবীর সেরা দার্শনিক ,কবি, লেখক, বিজ্ঞানী, তার্কিক, রাজনীতিক, পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, জ্যোতির্বিদ কারোরই কোন ঘাটতি নেই৷ আজ ‘গণতন্ত্র’ নিয়ে যাঁরাই  বড়াই করছেন তাঁরা নিশ্চয়ই জানবেন যে বাঙলার মানুষই প্রথমে পালবংশের রাজা গোপালকে ‘‘নৃপতি’’ বলে নির্বাচিত করেছিলেন৷ ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে আজ যাঁরা কমিউনিজম নিয়ে বড়াই করছেন তাঁদেরও নিশ্চয়ই অজানা নেই যে, রাশিয়া থেকে ভারতে কম্যুনিজম আমদানী করেছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়৷

আজকের  ভারতে যারাই হম্বি-তম্বি করছেনবাঙালীকে জব্দ করার জন্যে একটার পর একটা চক্রান্তের জাল বুনছেনযাঁদের পূর্বপুরুষগণ ভারতের স্বাধীনতার নামে বাঙলা বিভাজন করিয়ে বাঙালীদের উদ্বাস্তু বানিয়েছিলেন, সেই তাঁরাই বাঙালীদের এখন অনুপ্রবেশকারী বা ঘুষপেটিয়া, বিদেশী, উদ্বাস্তু বা রিফ্যুজি, ছারপোকা, মশক, ডি-বোটার ইত্যাদি বলে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করে চলেছেন, তাঁদের এতটাই৷ নিষ্ঠুরতা বা বর্বরতা প্রদর্শন কি আদৌ সভ্যতার কিংবা সুশিক্ষার পরিচায়ক? আপনারা কেন ভুলে যাচ্ছেন, ভারত তথা তামাম দুনিয়ার কায়েমী স্বার্থবাদীরা যেক্ষেত্রে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে ‘‘যুদ্ধপরাধী’’ বলে ঘোষিত করেছিলেন তাদের বাদ রেখে সমগ্র পৃথিবীবাসীর দৃষ্টিতে নেতাজী তখনও আর আজও পৌরুষের বজ্রকৌস্তভ, বিপ্লবের জলন্ত অগ্ণিশিখা, দেশপ্রেমের  অত্যুচ্চ শিখর আর আত্মত্যাগের অজেয় বীর সেনানী নেতাজী কিন্তু পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় কেউ নেই, যেমনটা নেই দ্বিতীয় কেউ স্বামীজী, কিংবা বিশ্বকবি, কিংবা মহাপ্রভু, দেশবন্ধু, পরমহংস, মহানায়ক ইত্যাদি নামের৷ তবে হ্যাঁ, শুধু একপেশে কথা কেন বলব? একচোখা হয়েই বা কেন দুনিয়া দেখতে চাইব? বাঙলায় দস্যু-তস্কর- চোর-ডাকাত, খুনী-বদমায়েস, গোরুচোর, নারী-চোর, শিশুচোর,  মানুষের অঙ্গ-প্রতঙ্গ-চোর, বাজেট-চোর, বোট-চোর, জুয়াচোর, খেতাব-চোর, পুকুর চোর, সাগর চোর, সিঁধেল চোর, টাইটেল-চোর, জমি-চোর, দলিল-চোর, কাম-চোর, ও নাম-চোর ইত্যাদি৷ চোরদের অভাব কোনকালেই ছিল না তা নয় আর আজ নেই তাও বলছি না৷ তবে এসব চোর -বাটপার-বজ্জাত-হারামজাদাদেরও মুখে কালিমা লাগিয়ে বাঙলার তথা সমগ্র ভারতের এমনকি সম্ভবতঃ বিশ্বের ইতিহাসের পৃষ্ঠাকেও চিরকালের মতই কালিমালিপ্ত করে রেখেছে একাই---বাঙলার  কুখ্যাত ও অবিস্মরণীয় নাম সেই মীরজাফর--- যিনি আজ কিংবদন্তি হয়ে আজকের পড়ুয়াদের পাঠ্যপুস্তকের পৃষ্ঠায় কিংবা কথায় কথায় ও মানুষের মুখে মুখে বেঁচে রয়েছেন৷ সবচেয়ে তাজ্জব ব্যাপার হল, সন্ত্রাসবাদী ও স্বৈরাচারীরা যেমন অতীত যুগের অ্যাপোলো থেকে শুরু  করে যুগে যুগে  দুর্র্যেধন, দুঃশাসন রাবণ, এটিলা, চেঙ্গিজ খান, মুহম্মদ ঘোরী, তারপর এযুগে হিটলার, পট্যালিন ইয়াহিয়া খান প্রমুখরা বংশানুক্রমেই তাঁদের বংশধারাগত ঐতিহ্য বজায় রেখে চলেছেন, সেই একই রকমভাবে ধারা বজায় রেখে যুগের পর যুগ ধরে ঐতিহ্য অটুটু রেখেই চলেছেন বিশ্বাসঘাতকেরাও আর এদের বংশবৃদ্ধি  হচ্ছে বর্তমান পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের যুগে এসে দ্রুতগতিতে৷

বর্তমান বাঙলার তথা বাঙালীদের বিশেষ করে নিম্নবিত্ত ও অসহায়  বিপন্ন দরিদ্র শ্রেণীর বাঙালীদের জীবন থেকে উৎসব-পার্বণে আনন্দ আর রাতের ঘুম উবে গেছে এযুগের  মীরজাফরদের কাণ্ড-কারখানা দেখে দেখে৷ তাই আজ ভুক্তভোগী বাঙালী সমাজে একটাই  প্রশ্ণ মুখে মুখে একটা কথাই ঘোরা ফেরা করছে--- মীরজাফরদের চিনে নিতে বাঙলা কি ভুলই করে যাবে?

এবার তাহলে আজকের মীরজাফরদের নিয়েই খানিকটা বলে নিচ্ছি৷ আমরা এযুগের নবপ্রজন্মদের বাদ রেখে অধিকাংশরাই জানি যে,স্বাধীন বাঙলার শেষ নবাব সিরাজ-উদ্‌-দৌল্লা শাসন বিষয়ক ক্ষেত্রে আশানুরূপ কর্মতদপর  কিংবা বিচক্ষণ ছিলেন না৷ তবে তিনি মাতৃভূমি বাঙলাকে ভালবাসতেন তিনি দেশগ্রোহী ছিলেন বা দেশকে অবজ্ঞার চোখে দেখতেন, এমন কোন অভিযোগ ছিল বলে জানা নেই৷ তাহলে স্বভাবতঃই প্রশ্ণ উঠে আসে, সেই সিরাজ নবাবের সিংহাসন থেকে সরাবার প্রয়োজন পড়েছিল কেন? নবাবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ কেন গড়ে উঠেছিল? আরও প্রশ্ণ বিদ্রোহ যদি নাই ছিল, তবে ষড়যন্ত্র রচিত হয়েছিল কেন?

ইতিহাস পাঠ থেকে যতদূর যুক্তি মেলে তা থেকেই বোঝা যায় যে, সেই সময় গোটা বাঙলার ওপর কু-নজর পড়েছিল দুরাগত বিদেশী ও ঔপনিবেশিক তথা সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের৷ লুন্ঠনবৃত্তির পুঁজি নিয়ে ওরা বণিকের ছদ্মবেশে বাঙলায় এসে হাণা দিয়েছিল ব্যবসা করবে বলে আর মনের গুহায় পোষণ করেছিল গোটা বাঙলাকে জয় করবে বলে৷ তাই ওরা বরশিতে মাছ লাগাবার টোপ ফেলেছিল৷ আর এদিকে অজগর বৃত্তি মনের গোপণে পোষণ করে  বাঙলার মসনদ হাসিল করে ‘নবাবী’ করার খোয়াব দেখেছিলেন জনাব সেনাপতি মীরজাফর৷ অর্থাৎ বিদেশী তস্করদের সঙ্গে সহজেই হাত মেলাবার মত্তকা পেয়ে গিয়েছিলেন বাঙলারই জল-হাওয়ায় ও ভাতে-কাপড়ে বড় হয়ে ওঠা, পরিপুষ্ট হওয়া বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর৷ ফল যা  হবার তাই ফলেছিল৷ কিন্তু মহা-মহা সর্বনাশ ঘটে গিয়েছিল সেদিনই পলাশীর প্রান্তরে, যার কুফল আজও বাঙালীজাতি বংশ পরম্পরাক্রমে ভুগছে৷

তদ্রূপ, আজও আবার বাঙলা অর্থাৎ পঃবঙ্গ তথা হিন্দী সাম্রাজ্যবাদী লুঠেরাদের ভাষায় যাকে ‘‘বঙ্গাল’’ বলা হয়ে থাকে, তাদের মাছ-ধরবার বড়শিতে টোপ গেলবার জন্যে সেই রাজ্যটির -পুঁটি-চুনোপুঁটি থেকে আঙ্গর-মাগুর বা দুয়েকটা রাঘব বোয়াল লাফালাফি শুরু করেছে৷ আর দু-চারজন কই-শিঙ্গি হিন্দী-বলয়ের  বরশীতে লেগে গেলেও মনে হচ্ছে  রুই-কাৎলা -মৃগেল-সিলবার কাপ জাতের হয়তো বরশীর টোপ গিলবে না৷ দেখাই যাক না কী ঘটতে যাচ্ছে৷

তবে খানিকটা আশংকাও না দেখিয়ে পারছি না৷ ইতিহাস বলছে, অতীতে মুহম্মদ ঘোরীর মত সেয়ানা ক্ষমতা -পাগল নাকি হিন্দুদের যুদ্ধে হারাবার উদ্দেশ্যেই তার পদাতিক সেনাবাহিনীর শাসনে রেখে দিয়েছিলেন গোরুর পাল৷  তাই আশংকার কারণ দেখা দিয়েছে এখনকার পশ্চিমবাঙলা দখলে বোট-যুদ্ধে হিন্দীবলয়ের সাম্রাজ্যবাদীরা আবার ভেড়ার পাল সামনে রেখে দেয় কিনা! তাই আজ বড় প্রশ্ণঃ---মীরজাফরদের চিনে নিতে বাঙলা কি ভুলই করে যাবে?