মানুষ মন প্রধান জীব৷ আগে ভাবে, তারপর সেই অনুসারে মানুষ কাজ করে৷ সেদিক থেকে দেখতে মনটাই আসল কর্তা, শরীরটা হল কাজের হাতিয়ার৷ হাতিয়ারকে যেমন ভাবে ব্যবহার করা হবে, তেমনিভাব কাজ হবে৷
এখন মনের সংকীর্ণতা হল মানব সমাজের অধিকাংশ সমস্যারই মূল কারণ৷ মন সংকীর্ণ হলে মানুষের সঙ্গে মানুষের দেখা দেয় স্বার্থের লড়াই৷ আপনজনের সঙ্গেও লড়াই াধে৷ মনের যতই বিস্তার হয়, ততই মনুষ্যত্বের বিকাশ হয়, সমাজে ততই দেখা দেয় সহমর্মিতা, সহযোগিতা ও শান্তি৷
আর মনের ক্রমবিস্তারটাই স্বাভাবিক৷ কিন্তু এই ক্রমবিস্তারের পথে কিছু কিছু প্রাচীর আছে--- যে প্রাচীরে মনের বিস্তার বাধাপ্রাপ্ত হয়৷ এই বাধাটা হল কিছু সেন্টিমেন্ট--- যুক্তিহীন কিছু ভাবাবেগ৷ মানুষ যে স্থানে বাস করে--- যে স্থানে জন্মেছে--- বড় হয়েছে --- স্বাভাবিকভাবেই সেই স্থানের প্রতি একটা আকর্ষণ থেকে যায়৷ সেই আকর্ষণ থেকে মানুষ সেই এলাকার উন্নতির জন্যে সচেষ্ট হবে৷ সেটা তো ভাল কথা৷
কিন্তু একটা কথা মনে রাখা দরকার৷ আমার যেমন এইটা মাতৃভূমি৷ আমার কাছে আমার মাতৃভূমি যেমন প্রিয়, অন্যের কাছে তারও মাতৃভূমি তেমনি প্রিয়৷ কিন্তু আমি যদি ভেবে নিই, আমার মাতৃভূমি এই পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা, আমার মাতৃভূমি উৎকৃষ্ট, অন্য ভূমিগুলি নিকৃষ্ট৷ অন্য ভূমিকে শোষণ করে আমার মাতৃভূমিকে পুষ্ট করব৷ তাহলে তো তা যুক্তিপূর্ণ হল না৷ ওই ভূমিটিও যার মাতৃভূমি সেও যদি তাই ভাবে , তাহলে এই দুই এলাকার মানুষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধবে৷ সহযোগিতার বদলে একে অন্যের সর্বনাশ চাইবে৷ তাতে তো বৃহত্তর সমাজের উন্নতি ও শান্তি --- উভয়ই ব্যাহত হবে৷
এই যে একটা বিশেষ ভূমির জন্যে বিশেষ ভাবাবেগ বা সেন্টিমেন্ট, এর নাম ভৌম ভাবাবেগ বা জিও-সেন্টিমেন্ট ৷ এই জিও-সেন্টিমেন্ট মানুষের মনের বিস্তারকে একটা সীমিত গণ্ডীর মধ্যে আটকে রাখতে চায়৷ এইভাবে মনের গতিকে রুদ্ধ করে দিতে চায়৷ নদীর গতি যদি বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয় সেই বদ্ধ জলাশয়ের জলে পচন ধরে৷ তা অস্বাস্থ্যকর৷ তাই জিও সেন্টিমেন্টও মানবসমাজের বৃহত্তর কল্যাণের পথে াধা হয়ে দাঁড়ায়৷
এই জিও-সেন্টিমেন্ট থেকে জন্ম নেয় জিও-পলিটিক্স, জিও-ইকনমিক্স, জিও-রিলিজিয়ন প্রভৃতি৷ জিও-পলিটিক্স কেমন? অন্যের এলাকা আক্রমণ করে আমি আমার দেশের সীমানা বাড়াব৷ এরই নাম হোল সাম্রাজ্যবাদ৷ এই সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব নিয়ে ইয়ূরোপের বিভিন্ন দেশের শাসকগোষ্ঠী একসময় গোটা পৃথিবীতে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করে অন্যান্য দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেছিল ও যথেচ্ছভাবে শোষণ করেছিল৷ হিটলারও এই করতে চেয়েছিল৷ একে কেন্দ্র করেই তো ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধ ঘটে গেল--- লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহাণি হ’ল৷
তাই আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা পেছনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আর কোনো জিও-সেন্টিমেন্টকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে পারি না৷ বিশ্বৈকতাবাদকেই আজকের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে৷
এখানে একটা প্রশ্ণ উঠতে পারে৷ তাহলে কি মানুষ তার নিজ মাতৃভূমির উন্নতির জন্যে সচেষ্ট হবে না? অবশ্যই হবে৷ এব্যাপারে আদর্শ হবে ‘‘আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির পথ ধরে বিশ্বৈকতাবাদের প্রতিষ্ঠা’৷ যে যার অঞ্চলের সর্বাত্মক বিকাশ ঘটাতে ও তার নিজ নিজ অঞ্চলকে সমস্ত প্রকার শোষণ থেকে মুক্ত করতে অবশ্যই চেষ্টাশীল হবে৷ সমস্ত অঞ্চলকে নিয়ে পৃথিবী৷ বিভিন্ন অঞ্চল যদি উন্নত ও শোষণমুক্ত না হয় তাহলে বিশ্বশান্তি কখনোই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না৷
কথা হচ্ছে, আমার এলাকার উন্নতি করাটা অন্যায় হতে পারে না, কিন্তু অন্য এলাকাকে শোষণ করে আমার এলাকার উন্নতি ঘটাব--- তাও যুক্তিযুক্ত নয়৷ আমার স্বার্থসিদ্ধির জন্যে আমি অন্যের ওপর অন্যায় করতে পারি না৷
অনেক ফুল নিয়ে একটি মালাা তৈরী হয়৷ ফুলগুলি যদি সুন্দর না হয় তাহলে মালাখানি সুন্দর হবে কী করে? মালার সৌন্দর্য ফুলের সৌন্দর্যের ওপর নির্ভরশীল৷ তাই বিভিন্ন অঞ্চলের উন্নতিকে উপেক্ষা করে বিশ্বের উন্নতি হতে পারে না৷
জিও-রিলিজিয়নও সমর্থনীয় নয়৷ রিলিজিয়ন তো ঈশ্বর সম্পর্কীয় ব্যাপার৷ ঈশ্বর সমগ্র বিশ্বের স্রষ্টা সমগ্র বিশ্বের পালক আরও কত কী! তাই এক এক স্থানের জন্যে পৃথক পৃথক ঈশ্বরের ধারণাও মোটেই যুক্তিযুক্ত নয়৷ জিও-রিলিজিয়নকে কেন্দ্র করে বর্তমানে সমাজে নানান্ কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস রয়েছে৷ কোনো বিশেষ দেশের নদীর জল একমাত্র পবিত্র , আর অন্য দেশের নদীর জল অপবিত্র---এই ধারণা কেবল কুসংস্কার থেকেই জন্ম নিতে পারে৷ ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান৷ সর্বত্র বিরাজিত এই অনন্ত ঈশ্বরকে নিয়ে খণ্ড খণ্ড ভাবনা ভিত্তিক অন্ধবিশ্বাসকেও তাই মানা যায় না৷
ভৌম ভাবাবেগ বা জিও-সেন্টিমেন্ট যেমন বিশেষ ভূমিকে কেন্দ্র করে অযৌক্তিক সেন্টিমেন্ট, তেমনি কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে কোনও অযৌক্তিক সেন্টিমেন্টকে (সোসিও-সেন্টিমেন্ট) প্রশ্রয় দিয়ে ও অবশিষ্ট মানব সমাজের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাওয়া মোটেই সমর্থনীয় নয়৷
ইতিহাস সাক্ষী, গোষ্ঠীকেন্দ্রিক ভাবাবেগকে (সোসিও সেন্টিমেন্ট) ভিত্তি করে ইতোপূর্বে জাতপাতের লড়াই, জাতিদাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মাধ্যমে বহু রক্তস্রোত বয়ে গেছে৷
শ্রদ্ধেয় শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকার তাই সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘মানব সমাজ এক ও অবিভাজ্য’৷ তিনি বলেছেন,‘পরমপুরুষ আমার পিতা, পরমা প্রকৃতি আমার মাতা, আর ত্রিভূবন আমার স্বদেশ৷ আমরা সবাই বিশ্বনাগরিক’৷ এটাই সবার আদর্শ হওয়া উচিত৷
তাই ভৌম ভাবাবেগ বা জিও সেন্টিমেন্ট-এর মতো ‘গোষ্ঠীকেন্দ্রিক ভাবাবেগ বা সোসিও সেন্টিমেন্ট’ মানব সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের ও বিশ্বশান্তির অন্তরায়৷
অনেকে মনে করেন, আমি কোনো আঞ্চলিক সেন্টিমেন্টকে প্রশ্রয় দিই না, কোনো গোষ্ঠীকেন্দ্রিক সেন্টিমেন্টকে প্রশ্রয় দিই না, জাত-পাত -সম্প্রদায়ভেদ মানি না, আমি একমাত্র মানবতাকে মানি৷
বর্তমানে মানবতাকে তথা মানবতাবাদভিত্তিক আন্তর্জাতিকতাবাদকে মানব সমাজের পক্ষে কল্যাণকর সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে৷
কিন্তু মহান্ দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার দেখিয়েছেন, এই মানবতাবাদও ত্রুটিপূর্ণ৷ কারণ, প্রথমতঃ এই মানবতাবাদের পেছনে কোনো অফুরন্ত প্রেরণার উৎস Constant and perinnial source of inspriation) নেই৷ তাই এই মানবতাবাদ যতটা লোক দেখানো ততটা আন্তরিক নয়৷ দেখা যায়, মুখে মানবতার কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু ভেতরে আত্মস্বার্থের ভাবনা টনটনে৷ সুযোগ পেলেই ভেতরে সংকীর্ণ ভাবনার বহিঃপ্রকাশও ঘটে৷ বিশ্বরাজনীতির ক্ষেত্রেও আমরা তাই দেখি মুখে বিশ্বশান্তির কথা, নিরস্ত্রীকরণের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু ভেতরে নিজেদের অস্ত্রভান্ডার বৃদ্ধি করা হচ্ছে৷ এইটাই হয়, এইটাই হচ্ছে৷
তথাকথিত মানবতাবাদের দ্বিতীয় ত্রুটি হচ্ছে, এতে সমস্ত মানুষের স্বার্থের কথা হয়তো ভাবা হচ্ছে, কিন্তু এই পৃথিবীতে মানুষ ছাড়াও অন্যান্য জীব রয়েছে, পশুপক্ষী-তরুলতা রয়েছে, তাদের কথা ভাবা হচ্ছে না৷ মানুষ তার স্বার্থে যে যথেচ্ছভাবে পশুপক্ষী হত্যা করছে, বনজঙ্গল ধবংস করছে, তার ফলে বিশ্ব সমাজের ভারসাম্য নষ্ট-হচ্ছে, বিশ্ব পরিবেশ দূষিত হচ্ছে--- এর প্রতিকারের কথা ভাবা হচ্ছে না৷ মানবতাবাদ কেবল মানুষকে ভালবাসার কথা বলছে, কিন্তু-মানুষ ছাড়া অন্যান্য জীবকে ভালবাসার কথা বলছে না--- এটাই মানবতাবাদের মূলগত ত্রুটি৷
তাই মহান্ দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন, ‘নব্যমানবতা’ই মানুষের যথার্থ আদর্শ হওয়া উচিত৷ এই নব্যমানবতাবাদের মধ্যে রয়েছে সকল সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠি৷ নব্যমানবতাবাদের মূল বৈশিষ্ট্য হ’ল এখানে মানবতাবাদের যে মাধুর্য--- সবাইকে ভালবাসা--- সবার জন্যে ভাবা---এই মাধুর্য্যকে এই বিশ্বচরাচারের সমস্ত জীব--- সমস্ত উদ্ভিদ এমনকি অচেতন পদার্থের মধ্যেও ছড়িয়ে দেওয়া৷ আর এটা বাস্তবে সম্ভব হবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বজীবে--- সর্বসত্তায় পরিব্যপ্ত ঈশ্বরের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত হওয়ার আকুতির মাধ্যমে৷ এজন্যে চাই, ঈশ্বরের সঙ্গে একীভূত হওয়ার নিত্য-অভ্যাস৷
এইভাবে আধ্যাত্মিক নিত্যাভ্যাসই মানুষের মনে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বসত্তার প্রতি আন্তরিক ভালবাসা জাগিয়ে তুলবে ও ধীরে ধীরে অন্তর থেকে বিশ্বের সমস্ত মানুষ, পশুপক্ষী, তরুলতার প্রতি মমত্ববোধ ও দায়িত্ববোধ জেগে উঠবে৷ এইটাই হ’ল নব্যমানবতাবাদের বাস্তববায়ন৷
নব্যমানবতাবাদের প্রবক্তা তাঁর প্রভাতসঙ্গীতের তাই গেয়েছেন---
মানুষ যেন মানুষের তরে সবকিছু করে যায়৷
একথাও যেন মনে রাখে পশু-পাখী তার পর নয়, তরুও বাঁচিতে চায়৷
অন্ধকারে পথ হারাইয়া কেন বা মানুষ মরিবে কাঁদিয়া
আমাদের আশা যত ভালবাসা কাছে টেনে নেবে তায়
অনশনে অশিক্ষাতে দগ্দভালের বহ্ণিজ্বালাতে
সবারে নিয়ে আশ্রয় দিয়ে রচিব এ অলকায়৷
- Log in to post comments