মনের বিস্তার--- নব্যমানবতাবাদ

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

মানুষ মন প্রধান জীব৷ আগে ভাবে, তারপর সেই অনুসারে  মানুষ কাজ করে৷  সেদিক থেকে দেখতে  মনটাই আসল কর্তা, শরীরটা হল কাজের হাতিয়ার৷ হাতিয়ারকে যেমন ভাবে ব্যবহার করা হবে, তেমনিভাব কাজ হবে৷

এখন মনের সংকীর্ণতা হল মানব সমাজের  অধিকাংশ সমস্যারই মূল কারণ৷ মন সংকীর্ণ হলে মানুষের সঙ্গে মানুষের  দেখা দেয় স্বার্থের লড়াই৷ আপনজনের  সঙ্গেও লড়াই াধে৷ মনের যতই বিস্তার হয়, ততই মনুষ্যত্বের বিকাশ হয়, সমাজে  ততই  দেখা দেয় সহমর্মিতা, সহযোগিতা  ও শান্তি৷

আর মনের ক্রমবিস্তারটাই  স্বাভাবিক৷ কিন্তু  এই  ক্রমবিস্তারের পথে কিছু কিছু প্রাচীর আছে--- যে প্রাচীরে মনের বিস্তার বাধাপ্রাপ্ত হয়৷ এই বাধাটা হল  কিছু সেন্টিমেন্ট--- যুক্তিহীন কিছু ভাবাবেগ৷  মানুষ  যে স্থানে  বাস করে--- যে স্থানে  জন্মেছে--- বড় হয়েছে --- স্বাভাবিকভাবেই সেই স্থানের  প্রতি একটা আকর্ষণ থেকে যায়৷ সেই আকর্ষণ থেকে  মানুষ সেই এলাকার  উন্নতির  জন্যে সচেষ্ট হবে৷ সেটা তো ভাল কথা৷

কিন্তু একটা কথা মনে রাখা  দরকার৷ আমার যেমন এইটা  মাতৃভূমি৷  আমার কাছে  আমার মাতৃভূমি  যেমন প্রিয়, অন্যের  কাছে  তারও মাতৃভূমি তেমনি প্রিয়৷ কিন্তু আমি যদি  ভেবে নিই, আমার মাতৃভূমি  এই পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা,  আমার মাতৃভূমি  উৎকৃষ্ট, অন্য ভূমিগুলি  নিকৃষ্ট৷ অন্য ভূমিকে  শোষণ  করে আমার মাতৃভূমিকে পুষ্ট  করব৷ তাহলে  তো তা যুক্তিপূর্ণ হল না৷ ওই ভূমিটিও যার  মাতৃভূমি  সেও যদি তাই ভাবে  , তাহলে  এই দুই এলাকার  মানুষের  মধ্যে  সংঘর্ষ বাধবে৷ সহযোগিতার বদলে একে  অন্যের  সর্বনাশ  চাইবে৷ তাতে তো  বৃহত্তর  সমাজের  উন্নতি  ও শান্তি --- উভয়ই ব্যাহত হবে৷

এই যে  একটা  বিশেষ ভূমির জন্যে বিশেষ ভাবাবেগ  বা সেন্টিমেন্ট, এর নাম ভৌম ভাবাবেগ বা জিও-সেন্টিমেন্ট ৷ এই  জিও-সেন্টিমেন্ট মানুষের  মনের বিস্তারকে  একটা সীমিত গণ্ডীর মধ্যে  আটকে  রাখতে চায়৷ এইভাবে  মনের গতিকে  রুদ্ধ করে  দিতে চায়৷ নদীর  গতি  যদি  বদ্ধ জলাশয়ে  পরিণত হয় সেই বদ্ধ জলাশয়ের জলে পচন ধরে৷ তা  অস্বাস্থ্যকর৷ তাই জিও সেন্টিমেন্টও মানবসমাজের  বৃহত্তর কল্যাণের  পথে াধা হয়ে দাঁড়ায়৷

এই জিও-সেন্টিমেন্ট থেকে  জন্ম নেয় জিও-পলিটিক্স, জিও-ইকনমিক্স, জিও-রিলিজিয়ন প্রভৃতি৷ জিও-পলিটিক্স কেমন? অন্যের  এলাকা আক্রমণ করে আমি  আমার দেশের  সীমানা বাড়াব৷ এরই নাম হোল সাম্রাজ্যবাদ৷  এই সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব নিয়ে ইয়ূরোপের  বিভিন্ন দেশের  শাসকগোষ্ঠী একসময়  গোটা পৃথিবীতে  তাদের  সাম্রাজ্য বিস্তার  করে অন্যান্য দেশকে  পরাধীনতার  শৃঙ্খলে  আবদ্ধ করেছিল  ও যথেচ্ছভাবে  শোষণ করেছিল৷ হিটলারও এই করতে  চেয়েছিল৷ একে কেন্দ্র করেই  তো ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধ ঘটে গেল--- লক্ষ লক্ষ মানুষের  প্রাণহাণি হ’ল৷

তাই আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা  পেছনের  অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে  আর কোনো জিও-সেন্টিমেন্টকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে পারি না৷ বিশ্বৈকতাবাদকেই আজকের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ  করতে হবে৷

এখানে একটা প্রশ্ণ উঠতে  পারে৷ তাহলে  কি মানুষ তার নিজ মাতৃভূমির  উন্নতির  জন্যে সচেষ্ট হবে না?  অবশ্যই  হবে৷ এব্যাপারে আদর্শ হবে ‘‘আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির  পথ ধরে বিশ্বৈকতাবাদের  প্রতিষ্ঠা’৷ যে যার অঞ্চলের সর্বাত্মক  বিকাশ ঘটাতে  ও তার  নিজ নিজ অঞ্চলকে  সমস্ত  প্রকার  শোষণ থেকে  মুক্ত করতে  অবশ্যই  চেষ্টাশীল হবে৷ সমস্ত  অঞ্চলকে  নিয়ে  পৃথিবী৷ বিভিন্ন অঞ্চল যদি  উন্নত ও শোষণমুক্ত না হয় তাহলে বিশ্বশান্তি  কখনোই প্রতিষ্ঠিত  হতে পারে না৷

কথা হচ্ছে, আমার এলাকার উন্নতি করাটা অন্যায় হতে পারে না, কিন্তু  অন্য  এলাকাকে  শোষণ করে আমার  এলাকার  উন্নতি ঘটাব--- তাও যুক্তিযুক্ত নয়৷  আমার  স্বার্থসিদ্ধির  জন্যে আমি  অন্যের  ওপর  অন্যায়  করতে পারি না৷

অনেক ফুল  নিয়ে একটি মালাা তৈরী  হয়৷ ফুলগুলি  যদি সুন্দর  না হয়  তাহলে  মালাখানি সুন্দর হবে কী করে? মালার  সৌন্দর্য ফুলের  সৌন্দর্যের  ওপর নির্ভরশীল৷ তাই বিভিন্ন  অঞ্চলের উন্নতিকে  উপেক্ষা করে বিশ্বের উন্নতি হতে পারে না৷

জিও-রিলিজিয়নও সমর্থনীয়  নয়৷ রিলিজিয়ন তো ঈশ্বর সম্পর্কীয় ব্যাপার৷  ঈশ্বর সমগ্র বিশ্বের স্রষ্টা সমগ্র  বিশ্বের পালক আরও কত কী! তাই  এক এক  স্থানের  জন্যে পৃথক পৃথক  ঈশ্বরের  ধারণাও মোটেই  যুক্তিযুক্ত  নয়৷ জিও-রিলিজিয়নকে  কেন্দ্র  করে বর্তমানে  সমাজে  নানান্ কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস রয়েছে৷ কোনো  বিশেষ  দেশের  নদীর জল  একমাত্র  পবিত্র , আর অন্য দেশের  নদীর  জল অপবিত্র---এই ধারণা কেবল কুসংস্কার থেকেই  জন্ম নিতে পারে৷ ঈশ্বর  সর্বত্র বিরাজমান৷ সর্বত্র  বিরাজিত এই অনন্ত  ঈশ্বরকে নিয়ে  খণ্ড খণ্ড ভাবনা ভিত্তিক  অন্ধবিশ্বাসকেও তাই মানা যায় না৷

 ভৌম ভাবাবেগ  বা জিও-সেন্টিমেন্ট  যেমন বিশেষ  ভূমিকে  কেন্দ্র  করে অযৌক্তিক সেন্টিমেন্ট,  তেমনি  কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে কোনও অযৌক্তিক  সেন্টিমেন্টকে  (সোসিও-সেন্টিমেন্ট) প্রশ্রয় দিয়ে ও অবশিষ্ট মানব সমাজের  স্বার্থের  বিরুদ্ধে  যাওয়া মোটেই  সমর্থনীয়  নয়৷

ইতিহাস সাক্ষী, গোষ্ঠীকেন্দ্রিক ভাবাবেগকে (সোসিও সেন্টিমেন্ট) ভিত্তি  করে ইতোপূর্বে  জাতপাতের  লড়াই, জাতিদাঙ্গা ও  সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার  মাধ্যমে বহু রক্তস্রোত বয়ে গেছে৷

শ্রদ্ধেয় শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকার  তাই সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘মানব সমাজ এক ও অবিভাজ্য’৷  তিনি  বলেছেন,‘পরমপুরুষ আমার  পিতা, পরমা  প্রকৃতি  আমার মাতা, আর ত্রিভূবন আমার স্বদেশ৷  আমরা  সবাই বিশ্বনাগরিক’৷  এটাই  সবার আদর্শ হওয়া উচিত৷

তাই ভৌম ভাবাবেগ বা জিও সেন্টিমেন্ট-এর  মতো  ‘গোষ্ঠীকেন্দ্রিক  ভাবাবেগ বা সোসিও সেন্টিমেন্ট’  মানব সমাজের  বৃহত্তর  কল্যাণের ও বিশ্বশান্তির  অন্তরায়৷

অনেকে মনে করেন, আমি কোনো আঞ্চলিক  সেন্টিমেন্টকে প্রশ্রয় দিই না, কোনো গোষ্ঠীকেন্দ্রিক  সেন্টিমেন্টকে  প্রশ্রয় দিই না, জাত-পাত -সম্প্রদায়ভেদ মানি না,  আমি একমাত্র  মানবতাকে  মানি৷

বর্তমানে মানবতাকে  তথা মানবতাবাদভিত্তিক  আন্তর্জাতিকতাবাদকে মানব সমাজের  পক্ষে  কল্যাণকর  সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ হিসেবে  গণ্য করা হয়ে থাকে৷

কিন্তু  মহান্ দার্শনিক  শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার দেখিয়েছেন, এই মানবতাবাদও ত্রুটিপূর্ণ৷ কারণ, প্রথমতঃ এই মানবতাবাদের  পেছনে  কোনো অফুরন্ত প্রেরণার উৎস Constant and perinnial  source of  inspriation) নেই৷  তাই  এই মানবতাবাদ  যতটা লোক দেখানো ততটা  আন্তরিক নয়৷ দেখা যায়,  মুখে মানবতার  কথা বলা  হচ্ছে, কিন্তু  ভেতরে আত্মস্বার্থের  ভাবনা  টনটনে৷  সুযোগ  পেলেই  ভেতরে  সংকীর্ণ  ভাবনার  বহিঃপ্রকাশও ঘটে৷ বিশ্বরাজনীতির  ক্ষেত্রেও আমরা তাই  দেখি  মুখে  বিশ্বশান্তির কথা,  নিরস্ত্রীকরণের  কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু  ভেতরে  নিজেদের  অস্ত্রভান্ডার বৃদ্ধি  করা হচ্ছে৷  এইটাই  হয়,  এইটাই হচ্ছে৷

তথাকথিত  মানবতাবাদের  দ্বিতীয়  ত্রুটি  হচ্ছে, এতে  সমস্ত  মানুষের  স্বার্থের  কথা হয়তো  ভাবা হচ্ছে, কিন্তু  এই পৃথিবীতে  মানুষ ছাড়াও অন্যান্য জীব  রয়েছে, পশুপক্ষী-তরুলতা রয়েছে, তাদের  কথা ভাবা হচ্ছে না৷  মানুষ তার স্বার্থে যে যথেচ্ছভাবে পশুপক্ষী হত্যা  করছে, বনজঙ্গল  ধবংস করছে,  তার  ফলে  বিশ্ব সমাজের  ভারসাম্য নষ্ট-হচ্ছে,  বিশ্ব পরিবেশ  দূষিত হচ্ছে--- এর  প্রতিকারের কথা ভাবা হচ্ছে না৷ মানবতাবাদ কেবল  মানুষকে ভালবাসার  কথা বলছে, কিন্তু-মানুষ ছাড়া   অন্যান্য জীবকে  ভালবাসার  কথা বলছে না---  এটাই মানবতাবাদের  মূলগত ত্রুটি৷

তাই  মহান্ দার্শনিক  শ্রী প্রভাতরঞ্জন  সরকার  বলেছেন, ‘নব্যমানবতা’ই  মানুষের  যথার্থ আদর্শ হওয়া উচিত৷  এই নব্যমানবতাবাদের মধ্যে রয়েছে সকল সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠি৷ নব্যমানবতাবাদের মূল বৈশিষ্ট্য হ’ল এখানে মানবতাবাদের  যে মাধুর্য--- সবাইকে  ভালবাসা--- সবার জন্যে ভাবা---এই মাধুর্য্যকে  এই বিশ্বচরাচারের সমস্ত জীব---  সমস্ত উদ্ভিদ এমনকি  অচেতন  পদার্থের  মধ্যেও ছড়িয়ে দেওয়া৷  আর এটা বাস্তবে  সম্ভব হবে  বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের  সর্বজীবে--- সর্বসত্তায় পরিব্যপ্ত ঈশ্বরের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত হওয়ার আকুতির মাধ্যমে৷ এজন্যে চাই, ঈশ্বরের সঙ্গে  একীভূত হওয়ার নিত্য-অভ্যাস৷

এইভাবে  আধ্যাত্মিক নিত্যাভ্যাসই মানুষের মনে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের  সর্বসত্তার  প্রতি আন্তরিক ভালবাসা  জাগিয়ে  তুলবে ও ধীরে ধীরে  অন্তর থেকে বিশ্বের সমস্ত মানুষ, পশুপক্ষী, তরুলতার প্রতি মমত্ববোধ ও দায়িত্ববোধ  জেগে উঠবে৷ এইটাই হ’ল নব্যমানবতাবাদের  বাস্তববায়ন৷

নব্যমানবতাবাদের  প্রবক্তা তাঁর  প্রভাতসঙ্গীতের  তাই গেয়েছেন---

মানুষ যেন মানুষের  তরে  সবকিছু  করে যায়৷

একথাও যেন  মনে রাখে পশু-পাখী তার পর নয়,  তরুও বাঁচিতে  চায়৷

অন্ধকারে পথ  হারাইয়া কেন বা মানুষ  মরিবে কাঁদিয়া

আমাদের আশা যত ভালবাসা কাছে টেনে নেবে তায়

অনশনে অশিক্ষাতে দগ্দভালের বহ্ণিজ্বালাতে

সবারে  নিয়ে আশ্রয় দিয়ে রচিব এ অলকায়৷