মুখ্যমন্ত্রীর আশংকা অমূলক নয়

১৮৭২ সালে এদেশের ব্রিটিশ সরকার পূর্ণ বাংলার যে মানচিত্র প্রকাশ করেছিল তাতে বাংলার আয়তন ছিল ২ লক্ষ ৪৮ হাজার ২৩১ বর্গমাইল (৫ লক্ষ ৩৫ হাজার ৪৭১ কি.মি.৷ বাংলা, বিহার, ওড়িষ্যা, ছোটনাগপুর ও অসম নিয়ে ছিল ‘বঙ্গপ্রদেশ’৷ মুঘল আমলে এর নাম ছিল সুবা বাংলা–যা পশ্চিমে বারাণসী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল৷ তার পশ্চিমে ছিল ‘হিন্দোস্তান’ সুবা৷ আর তারপর ছিল পঞ্জাব সুবা৷ ব্রিটিশরা ১৮৭৪ সালে তাদের শাসনকার্যের সুবিধার অজুহাতে অসমকে (৪৩,৪৭৩ বর্গমাইল) বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে৷ ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বাংলাকে মধুমতী–পদ্মা সীমানা বরাবর দু’ভাগ করতে চায়৷ পূর্বাংশ নিয়ে পূর্ববঙ্গ–সম প্রদেশ, যার রাজধানী হবে ‘ঢ়াকা’, আর বাংলার পশ্চিমাংশ, বিহার, ওড়িষ্যা ও ছোটনাগপুর নিয়ে করতে চায় বঙ্গপ্রদেশ৷ ব্রিটিশের এই বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সারা বাংলা জুড়ে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে, যা বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন নামে খ্যাত৷ প্রকৃতপক্ষে এই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনই ব্যাপকভাবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয়৷ বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বাঙালী নেতৃবৃন্দের তীব্র আন্দোলনের মুখে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়৷ কিন্তু ১৯১১ সালে সুচতুর ব্রিটিশ শাসক পশ্চিমের খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ বাংলা ভাষাভাষী এলাকাগুলিকে বিহার ও ওড়িষ্যার সঙ্গে যুক্ত করে বিহার ও ওড়িষ্যা নামে দুটি স্বতন্ত্র প্রদেশ তৈরী করে৷ অন্যদিকে বাংলার বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ অঞ্চলকে অসমের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়৷ স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত কংগ্রেস নেতৃত্ব বলে আসছিল, বাংলাকে তার হূত অঞ্চল ফিরিয়ে দেওয়া হবে৷ ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট বাংলাকে রাজনৈতিক ভাবে দু’ভাগ করা হ’ল–পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গ, পরে পূর্ববঙ্গ হয় পূর্ব পাকিস্তান৷ ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয় তা হ’ল বাংলাদেশ৷ আর পশ্চিমবঙ্গের ভাগ্যে পড়ল মাত্র ৭৮ হাজার বর্গ কি.মি. অর্থাৎ আগেকার বাংলার প্রায় ৭ ভাগের ১ ভাগ৷

এই খণ্ডিত বাংলা পশ্চিমবঙ্গকেও বিভক্ত করার জন্যে বিভিন্ন সময় নানান্ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দেখা দিচ্ছে৷ বহু মনীষীর দেশ এই বাংলা–সারা বিশ্বকে উদার সর্বজনীন মানবতাবাদ তথা বিশ্বৈকতাবাদের বাণী শুনিয়ে এসেছে৷

বাংলাকে সমস্ত বিশ্বের কাছে অনেক কিছু দেওয়ার আছে, বিশ্বমানবতার প্রতিষ্ঠায় বাংলা ও বাঙালীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিশ্বমানবতাকে রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে৷

অথচ, সুমহান বাংলার যে আদর্শটুকু বুকে ধরে আজকের এই পশ্চিমবঙ্গ পথ চলছে, এই পশ্চিমবঙ্গের বুকেও ছুরিকাঘাত করার অপপ্রচেষ্টা বিভিন্ন সময়ে আমরা প্রত্যক্ষ করছি৷ আজও চলছে৷

সম্প্রতি রাজ্যের পুরসভার চেয়ারম্যান পঞ্চায়েত প্রধান,প্রশাসনিক আধিকারিকদের সঙ্গে নবান্নে এক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী আশংকা প্রকাশ করেছেন– রাজ্যে বাংলায় কথা বলার লোক পাওয়া যাবে না৷ ভিন্ন রাজ্যের থেকে আশা মানুষজনদের অবৈধভাবে জমি দখল করে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ রাজ্যের শাসকদল ও প্রশাসনের কিছু ব্যষ্টি এই অনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত৷ মুখ্যমন্ত্রীর আশংকা অমূলক নয়৷ তবে এই অবৈধ অনৈতিক কাজ স্বাধীনতার পর মুহূর্ত্ত থেকেই শুরু হয়েছে৷ স্বাধীনতার জন্মলগ্ণে খণ্ডিত বাঙলা যখন পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদেরভারে সমস্যা জর্জরিত তখন থেকেই ভিন্ন রাজ্যের মানুষজনেরা বাঙলার ব্যবসা ও জমি দখল অত্যন্ত সু–কৌশল করে আসছে৷ কেন্দ্রের স্বাধীন পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী সরকারের সীমাহীন বঞ্চনার শুরুও সেই মধ্যরাতের মসীলিপ্ত স্বাধীনতার জন্মলগ্ণ থেকেই৷ কিছু সাংবাদিক লেখক সাহিত্যিক প্রতিবাদে কলম ধরলেও কোন মুখ্যমন্ত্রী এদিকে নজর দেন নি দিল্লির কুনজরে পড়ার ভয়ে৷ আমরা বাঙালী সংঘটন প্রতিবাদে পথে নামলেও শাসক শোষক মিলিতভাবে দমন পীড়ন করে তার কন্ঠরোধ করার চেষ্টা করে আসছে৷

তবে এই প্রথম রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মুখ খুলেছেন৷ তিনি নিজ দলের নেতা মন্ত্রীদের দিকেও আঙুল তুলেছেন৷ মুখ্যমন্ত্রীর আন্তরিকতার অভাব নেই৷ তবে দুর্নীতির মূলচ্ছেদ ও অবৈধভাবে দখল জমি কতটা উদ্ধার হবে সংশয় থেকেই যায় মুখ্যমন্ত্রীর সর্বভারতীয় রাজনীতির দায়বদ্ধতার কারণে৷ তবু মুখ তিনি খুলেছেন–কাজে কতটা হয় সেটাই দেখার!