নামের উৎপত্তি--বেহালা

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

পণ্ডিত পদ্মনাথ ঘোষাল বলেছেন---‘‘অতি প্রাচীনকাল হইতেই কলিকাতা সর্ব সাধারণে পরিচিত৷ প্রাচীনকালের মানুষ এই স্থানকে কালীক্ষেত্র বলিতেন৷ তৎকালের এই কালীক্ষেত্র বহুলা হইতে দক্ষিণেশ্বর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল৷ অনেকে এই বহুলাকে ‘বেহালা’ বলিয়া অনুমান করেন৷

নিগম কল্লের পীঠমালায় বর্ণিত আছে---

দক্ষিনৈশ্বরমারত্য যাবচ্চ বহুলাপুরী৷

ধনুরাকার ক্ষেত্রঞ্চ যোজনদ্বয় সংখ্যকং৷৷

অর্থাৎ দক্ষিণেশ্বর থেকে বহুলা পর্যন্ত দুই যোজন মানে২৪ মাইল বিস্তৃত স্থান কালীক্ষেত্র৷ কালীঘাটের দক্ষিণে এই বহুলাই বর্তমান বেহালা৷

যশোহরকে সুরক্ষিত ও শক্তিশালী করবার জন্য প্রতাপাদিত্য সাত জায়গায় সাতটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন৷  সেই সাতটি জায়গার অন্যতম হলো বেহালা৷ বাকী জায়গায়গুলোর নাম--- মাতলা, রায়গড়  (বর্তমান গার্ডেনরিচ), টানা, সালকিয়া, চিৎপুর, আটপুর (মূলাজোড়)৷

অনেকে বলেন, বেহালা গ্রামে প্রতাপাদিত্যের খুল্লতাত  বসন্ত  রায়ের অনেক কীর্তি আজো বিদ্যমান৷ তাদের মতে বেহালার রায় দীঘি সরশুনা কয়েকটি বড় দীঘি বসন্ত রায় খনন করেছিলেন৷ বসন্ত রায়ের  শুধু কচু রায় বা রাঘব বহুদিন বেহালায় বসবাস করেছিলেন৷

১৮০০ খ্রীষ্টাব্দে বেহালার নস্করপুর নিবাসী গোবিন্দচন্দ্র দাস মণ্ডল কালীঘাটের  বায়ু কোণে মনসাতলা পাথর দিয়ে নির্মাণ করেছিলেন৷

সাবর্ণ চৌধুরীদের এই জমিদার ছিল এই ‘বেহালা’ বড়িশাতেই৷ উত্তরে দক্ষিণেশ্বর আর দক্ষিণে বেহালা--- এই ক্ষেত্রজুড়েই সাবর্ণদের জমিদারি ছিল ত্রিকোণাকৃতি৷ বেহালা বড়িশার সাবর্ণদের চৌধুরীরা বাদশাহ জাহাঙ্গীরের আমল থেকে  এই জমিদারি প্রাপ্ত হন৷

সিরাজদৌল্লা যখন কোলকাতা আক্রমণ করেন তখন রাজা মানিকচাঁদ ইংরেজদের অনেক ক্ষতিসাধন করেন৷ কোলকাতার  কাছে বেহালা গ্রামে এই মানিক চাঁদের একখানা বাগান ছিল৷

সেকালের কোলকাতার উচ্চ অবস্থাপন্ন পীতাম্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাসাদ সদৃশ বাড়িতে দোল রাস প্রভৃতি উৎসবে ভবানীপুর কালীঘাটের মতো বেহালার ব্রাহ্মণরা ও আমন্ত্রিত হতেন৷

স্বণামধন্য হরচন্দ্র ঘোষের পুত্র জজ প্রতাপ চন্দ্রঘোষ--- এঁদের আদি নিবাস ছিল বেহালা৷ সীতারাম ঘোষ স্ট্রীটের সীতারাম ছিলেন বেহালা বড়িশার ঘোষ পরিবারের আদি পুরুষ৷

কোলকাতায় বেহালার গুরুত্ব কম নয়৷ কারণ কোলকাতার ডায়মণ্ডহারবার রোড খিদিরপুর থেকে আরম্ভ করে আলিপুর,মোমিনপুর, দুর্গাপুর বেহালা, বড়িশা, ঠাকুর পুকুরের মধ্য দিয়ে  আমতলা ও রাজারহাট হয়ে সোজা ডায়মণ্ডহারবারে মিশেছে৷ তাহলে বেহালার সাথে  আদি কোলকাতার একটা বিশাল অংশের যোগ রয়েছে৷

বেহালার নামকরণের উৎস জানাতে গিয়ে সুকুমার সেন  বলেছেন, ‘‘যে গ্রামের অবস্থা ভালো নয়?’’ অর্থাৎ বেহাল দশার জন্য গ্রামটির নাম হয়েছে বেহালা৷ কিন্তু কোলকাতার ইতিহাস ঘেটে বেহালার প্রাচীন ঐতিহ্য যা জানা যায় তাতে তার বেহাল দশা কোনকালেই ছিল না৷ তাই বেহালা আর বেহালের মধ্যে শাব্দিক মিল থাকলে ও তাঁর বক্তব্য মানা কঠিন৷ যদিও তাঁর উক্তিতে প্রশ্ণবোধক চিহ্ণ আছে৷ অতএব তিনি তাঁর নিজের বক্তব্যেও সন্দিহান৷