নারী নির্যাতন ও একটি বিজ্ঞানসম্মত সমীক্ষা

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

দেশে মহিলাদের ওপর পাশবিক অত্যাচার কেন বাড়ছে? কেন মেয়েদের ওপর বলাৎকার করে নৃশংস খুনের ঘটনা বেড়েই চলেছে? দিল্লীর নির্ভয়া কাণ্ডের পর মহিলাদের ওপর পাশবিক অত্যাচার ও খুনের অপরাধে কঠিন সাজার আইন পাশ করা হয়েছে, ওই অপরাধে ফাঁসীর সাজাও হয়েছে, তবুও তো এধরনের অপরাধের হার কমছে না বরং বেড়েই  চলেছে৷ উত্তরপ্রদেশের হাথরাশের ঘটনায় যে কোনো সভ্য মানুষ বিস্মিত, হতভম্ব৷ ওখানে তো প্রশাসনও অপরাধকে চাপা দেওয়া ও অপরাধীদের রক্ষার জন্যে শশব্যস্ত ছিল৷ শুধু উত্তর প্রদেশেই নয়, সারা দেশজুড়েই এই মারাত্মক রোগ করোনা বাইরাসের মতই সংক্রমিত হয়ে চলেছে৷ করোনা বাইরাসের আতঙ্ক ধীরে ধীরে  কেটে  যাচ্ছে৷ কিন্তু এই যে মহিলাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন ও খুনের মারাত্মক সংক্রমণ এতো হ্রাস পাওয়ার বিন্দুমাত্র  আভাস পাওয়া যাচ্ছে না, বরং বছরের পর বছর এই ভয়ঙ্কর রোগ আরও বেশি করে ছড়িয়ে পড়ছে৷

এর কারণ কী? এর কি কোনো বিজ্ঞানসম্মত সমীক্ষা হয়েছে? না, মানুষের অপরাধ প্রবণতা হ্রাসের কোনরকম মনবিজ্ঞানসম্মত সমীক্ষা কি শাসক কি সুশীল সমাজ কারোপক্ষ থেকেই হয়নি৷ এদের আলোচনা,চর্চা শুধু পরস্পরের প্রতি দোষারোপ ও অপরাধীর কঠোর সাজার দাবীতেই সীমাবদ্ধ থাকে৷ বিক্ষিপ্তভাবে কেউ কেউ বিজ্ঞানসম্মত সমীক্ষার দাবী তুললেও, শাসক, বিরোধী, বিচার বিভাগ, সুশীল সমাজ কোনপক্ষই বিষয়ে সুস্পষ্ট কোন চিন্তা ভাবনা করছে না৷

তবে মনে রাখতে হবে সেই সঙ্গে কেবল রাজনৈতিক ভাবে একে অপরকে দোষারোপ করে মূল সমস্যাকে গুলিয়ে যেন না ফেলা হয়, তার ওপরও যেমন জোর দেওয়া হয়েছে, তেমনি অপরাধীদের যেন কোনও ভাবে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া না হয়, বিরোধীরা সে দাবীও করেছেন৷ কারণ উত্তরপ্রদেশে অপরাধীদের রাজনৈতিকভাবে আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারটা অতিমাত্রায় প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল৷

হ্যাঁ, অবশ্যই এই মারাত্মক সমস্যার বিজ্ঞানসম্মত সমীক্ষা দরকার৷ সমস্যা সমাধানের রাস্তা খুঁজে বের করতেই হবে৷

সমস্যাটি কিন্তু মূলতঃ মনস্তাত্ত্বিক৷ বিবর্তনবাদের দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা  দেখব, মানুষ  পশু থেকে এসেছে৷ তাই মানুষের  মধ্যে পশু প্রবৃত্তি রয়েছে৷ এই প্রবৃত্তিকে সংযত করতে হবে উপযুক্ত নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার দ্বারা৷ তার সঙ্গে সঙ্গে  নীতিবাদী শাসকের কঠোর  প্রশাসনিক চাপও অবশ্যই দরকার৷ প্রাউটের কথায়Internal urge  and external pressure---অভ্যন্তরীণ প্রেরণা ও বাহ্যিক চাপ দুটোই প্রয়োজন অপরাধকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে৷

মনের ভেতর থেকে যে ‘মানুষ হওয়ার’ সৎ হওয়ার, নীতিবাদী হওয়ার প্রেরণা--- এই নিরন্তর প্রেরণা চাই৷ নীতিশিক্ষা ও আধ্যাত্মিক  শিক্ষার মাধ্যমেই এটা সম্ভব৷

এ শিক্ষাদানের দায়িত্ব কার? প্রথমতঃ পিতামাতার , তারপরে  স্কুল-কলেজের, তারপর সাহিত্য, শিল্প, দূরদর্শন আদি সাংস্কৃতিক দুনিয়ার৷  খুব কম পিতা-মাতাই তাদের সন্তানদের উপযুক্তভাবে  নৈতিক শিক্ষা দিতে সমর্থ হন৷ তাই এ ব্যাপারে  স্কুল-কলেজের শিক্ষার ওপরই সমাজকে  নির্ভর করতে হয়৷ এই শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমানে পরিচালনা করেন রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার ও তাঁদের সহযোগিতা করেন বুদ্ধিজীবীরা৷

বর্তমানে শাসকগোষ্ঠী ও বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী উভয়ই কিন্তু এই নীতিশিক্ষা বিষয়ে মোটেই দায়িত্ববোধের পরিচয় দেয় না৷ স্কুলে কলেজে পর্যাপ্ত নীতি শিক্ষার প্রচণ্ড অভাবই পরিলক্ষিত হয়৷

বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার আবার নয়া শিক্ষাবিলে নীতিশিক্ষার ওপর গুরুত্বও আরও কমিয়ে দিয়ে গোড়া থেকে বৃত্তিমূলক শিক্ষার ওপর জোর দিচ্ছেন বেশি৷ তাঁরা কিন্তু একথাটা বুঝছেন না যে সৎ নীতিবাদী মানুষ তৈরী না হলে সৎনাগরিক তৈরী হবে না, ক্রমশ ‘রামরাজত্বের’র বদলে বেশি করে জঙ্গলের রাজত্ব কায়েম হবে৷ নীতিশিক্ষার ভিত্‌ শক্ত করতে আধ্যাত্মিক শিক্ষা জরুরী৷ আধ্যাত্মিক শিক্ষা মানে কিন্তু ‘হিন্দুত্ববাদী’ শিক্ষা নয় বা সাম্প্রদায়িক বা ডগ্‌মাভিত্তিক শিক্ষা নয়৷ এটা নীতিশিক্ষার সম্পূর্ণ বিরোধী৷ এই ডগমাভিত্তিক শিক্ষা মানুষের মধ্যে জাত-পাত-সম্প্রদায় বিদ্বেষ ও পারস্পরিক ঘৃণার শিক্ষা দেয়৷ আর প্রকৃত আধ্যাত্মিক শিক্ষা তার উল্টোটা শেখায়৷ প্রকৃত  আধ্যাত্মিকতা শেখায়৷ সমস্ত মানুষই এক বিশ্বস্রষ্টা ঈশ্বরের সন্তান, তাই প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা ও বিশ্বভ্রাতৃত্ব অবিচ্ছেদ্য৷ আধ্যাত্মিকতা শিক্ষা দেয় ‘মানুষে মানুষে নেইকো বিভেদ, নিখিল জগৎ ব্রহ্মময়’৷ প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা শেখায়, সমস্ত নারী জাতিকে মাতৃরূপে দেখতে৷ নারী পুরুষের জননী’ এই বোধই হল প্রকৃত আধ্যাত্মিক শিক্ষা৷ অন্যদিক থেকে বিশ্লেষণ করলে বর্তমান সমাজের নৈতিক অধঃপতনের একটা বড় কারণ সেক্স ও ভায়োলেন্স মার্র্ক চলচ্চিত্রের রমরমা৷ দূরদর্শনে ২৪ ঘন্টা বিভিন্ন সিরিয়্যালে এইসব ছবি দেখানো হয়৷ এইসব দৃশ্য যুবমানসকে সবসময় কলুষিত করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে৷ শিল্পী-সাহিত্যিক-কলাকুশলীদের সামনে রেখে পেছন থেকে সাংস্কৃতিক জগৎকে এইভাবে দূষিত করার কাজটি করে যাচ্ছে মুনাফাখোর পুঁজিপতিগোষ্ঠী৷  ‘‘নাচায় পুতুল যথা দক্ষ বাজিকরে’’৷ আর তার পরিণতি গোটা সমাজটাই ডুবে যাচ্ছে চরম দুর্নীতির পঙ্কে৷ আর এই পরিস্থিতিতে ঘটছে মনুষ্যত্বের চরম অবনয়ণ ও পাশবিকতার পৈশাচিক নৃত্য৷

বর্তমানের বৈশ্যপ্রধান (পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত) সমাজ ব্যবস্থায় খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে সমাজে বর্তমানে যেখানেই দুর্নীতি নীচতা-হীনতা সবকিছুর পেছনেই কাজ করছে পুঁজিবাদীদের কারসাজি৷ এই পুঁজিবাদী বৈশ্যপ্রধান সমাজব্যবস্থার  পরিবর্তন ছাড়া  কলুষমুক্ত সুন্দর পৃথিবী গড়া সম্ভব নয়৷ যাঁরা প্রকৃত নীতিবাদী শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ, প্রকৃত আধ্যাত্মিক পথের পথিক,তাঁদের উচিত সমাজের সমস্ত নীচতা-হীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা, সমস্ত প্রকারের পাপাচার অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম৷