নব আদর্শে---নব উদ্দীপনায় সবাই হোক উজ্জীবিত

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

পূর্ব প্রকাশিতের পর

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে এই লক্ষণগুলি বিষ প্রয়োগের ফল হিসেবেই চিহ্ণিত হয়৷ যাইহোক, পরমপুরুষ মহাসম্ভূতি তারকব্রহ্ম আনন্দমূর্ত্তিজী এই তীব্র কালকূট আত্মস্থ করে জীবিত রইলেন, যদিও বাহ্যিক উপসর্গগুলির কারণে তাঁকে দীর্ঘদিন যন্ত্রণায় কষ্ট পেতে হয়েছে ও স্থায়ীভাবে দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল৷ তিনি এই বিষ প্রয়োগের সুবিচার ও তদন্তের দাবী জানান৷ কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ বা কেন্দ্রীয় সরকার এই দাবীতে কর্ণপাত না করার ফলে ১৯৭৩ সালের ১লা এপ্রিল থেকে খাদ্যগ্রহণ বন্ধ করে দেন৷ শুধুমাত্র বলপূর্বক খাওয়ানোর হাত থেকে বাঁচার জন্যে তাঁকে দু’কাপ হরলিক্স প্রতিদিন গ্রহণ করতে হ’ত৷ এই অবস্থায় তিনি পাঁচ বৎসর চার মাস একদিন একনাগাড়ে অনশন চালিয়ে শেষ পর্যন্ত পটনা হাইকোর্টের রায়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে জয়ী হন ও ১৯৭৮ সালের ২রা আগষ্ট কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে নিজ বাসগৃহে অনশন ভঙ্গ করেন৷ তীব্র কালকূট কণ্ঠে ধারণ করে তিনি ‘নীলকণ্ঠ’ হলেন ও পৃথিবীর ইতিহাসে সুদীর্ঘতম অনশন করে মানবতার যন্ত্রণাকে স্বশরীরে বরণ করে নিয়ে পৃথিবীকে গরলমুক্ত রাখলেন শুধুমাত্র ঐশ্বরিক আধ্যাত্মিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে৷ এ ভিন্ন এই নজিরবিহীন ঘটনার আর কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না৷ এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে এই সংঘটনের ওপর বহুবিধ সন্ত্রাস ও অত্যাচার নেমে এসেছে৷ ১৯৮২ সালের ৩০শে এপ্রিল কলকাতার বুকে প্রকাশ্য রাজপথে তৎকালীন কমিউনিষ্ট বর্বরদের দ্বারা ১৭ জন সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীকে নৃশংসভাবে চোখ খুবলে, পিটিয়ে সংজ্ঞাহীন করে, পেট্রল ঢেলে জীবন্ত দগ্দ করে নির্মম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করা হয়৷

হিংসা ও সন্ত্রাসে জীর্ণ মানব সমাজ আজ ধর্ম-বর্ণ-জাত-সম্প্রদায়গত ভাবে ভয়ঙ্কর ভেদ-বিভেদের শিকার৷ মানবতা আজ ভূলুণ্ঠিত, নৈতিকতা দুর্বলতার নামান্তর, মানুষ সত্য-ন্যায়-ধর্ম বিবর্জিত৷ বর্তমানে মানব সভ্যতা এক চরম সংকটে এসে উপনীত৷ ‘সভ্যতার সংকট’ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন---‘‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব৷ আশা করব মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়ত আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে৷ আর একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে৷’’ ---সত্যই আজ মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস হারিয়ে যাচ্ছে, মানুষে-মানুষে বিভেদের প্রাচীর ক্রমশঃ দুর্লঙ্ঘ্য হয়ে চলেছে৷ এই অবস্থায় আনন্দমূর্ত্তিজী মানবতার সেবায় আধ্যাত্মিকতা ভিত্তিক নিঃস্বার্থ আপোষহীন সংগ্রামী সেবাব্রতীর দল গড়ে তুলেছেন ও ঘোষণা করেছেন---সব মানুষের ধর্ম এক আর তা হ’ল মানবধর্ম৷ তিনি শিখিয়েছেন---মানুষের সমাজ এক ও অবিভাজ্য৷ পৃথিবীর সমগ্র সম্পদে প্রতিটি মানুষ, জীব-জন্তু, উদ্ভিদ-জড় সকলেরই সমান অধিকার৷ সকলে মিলে এই সম্পদ ভোগ করবে, সর্বাধিক উপযোগ গ্রহণ করে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বজায় রাখবে কিন্তু কেউ এই সম্পদ কুক্ষিগত করে অন্যকে বঞ্চিত বা শোষণ করতে পারবে না৷ তাই একটি শোষণহীন সুন্দর সমাজ গড়ার লক্ষ্যে সকলকে তিনি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন---‘‘আজকের মানুষ মনীষাদৃপ্ত৷ প্রজ্ঞাসমৃদ্ধ মানুষ, আজ দ্রুত পদবিক্ষেপে সমস্ত ভাবজড়তার বাধা সরিয়ে এগিয়ে চলতে চাইছে৷ আজ আর সে কোন সুবিধাবাদের বিভ্রান্তির জালে ধরা পড়বে না৷ পূর্ব আকাশে নোতুন মানবতার অরুণালোক তার চোখের পাতায়, তার মর্মতন্ত্রীতে রঙ বুনতে শুরু করেছে৷ যারা একদিন ভাবজড়তায় আটকে রাখার স্বপ্ণ দেখছিল তাদের দিন শেষ হয়ে এসেছে---তাদের সুখ-স্বপ্ণ ভেঙ্গে যাচ্ছে৷ বুদ্ধিদীপ্ত সমস্ত মানুষকে আজ আহ্বান জানিয়ে বলি, তোমরা সাহসের সঙ্গে এগিয়ে চল৷ মানবতা তোমাদের অপেক্ষায় বসে আছে৷ তোমরা তাকে শীর্ষ মহিমায় প্রতিষ্ঠিত কর৷’’

শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিশ্বের সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে আনন্দমার্গের আধ্যাত্মিকতার আদর্শে অণুপ্রাণিত হয়ে জগৎ কল্যাণে এগিয়ে আসতে হবে ও প্রাউট দর্শনকে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সার্বিক শোষণমুক্ত সুন্দর মানব সমাজ গড়ে তুলতে হবে৷ এছাড়া মানুষের সামনে আর কোনও পথ নেই৷