শুভ নববর্ষ৷ সবাইকে আন্তর্জাতিক নববর্ষের প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাই৷ ২০২১ সাল পেরিয়ে ২০২২ সালে পা দিলুম৷ আমরা কোথায় আছি? পেছনের দিকে তাকিয়ে আমরা কী দেখছি? একদিকে এক শ্রেণীর ধনিক ও উচ্চবিত্ত শ্রেণীর বিপুল বিলাসিতা, পাশাপাশি জনসাধারণের বৃহদংশের চরম দারিদ্র্য ও বেকারত্ব৷ দুর্নীতিতে সারা দেশ ভরে গেছে৷ গরীব মানুষের টাকা লুঠে নিচ্ছে জনপ্রতিনিধির মুখোসধারী এক শ্রেণীর ভদ্র লুঠেরা৷ অথচ এঁরাই সমাজে নেতা বলে পরিচিত৷ মনে হয় মানুষ এখন তার মনুষ্যত্ব হারিয়ে বিবেক বিচারবুদ্ধিহীন পশুতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে৷
এই পরিস্থিতিতে আমাদের চিন্তা করতে হবে কী করে এই জঘন্য নারকীয় পরিস্থিতির যথার্থ পরিবর্তন ঘটিয়ে এক আদর্শ মানবিকতাপূর্ণ–ন্যায় ভিত্তিক সমাজ গড়তে পারি৷ এ ব্যাপারে সমাজের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা যে চিন্তাভাবনা করছেন না, তা নয়৷ কিন্তু তাঁরা যথার্থ পথ পাচ্ছেন না–এটাও সত্য কথা৷
ইতিহাসের পেক্ষাপটে আমরা দেখতে পাই, এক এক সময় আদর্শ শোষণমুক্ত সমাজ রচনার উদ্দেশ্যে চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবী মানুষেরা বিভিন্ন দর্শন দিয়েছেন৷ এইভাবে বিভিন্ন ধরণের মতবাদ এসেছিল৷ এই ভাবে এসেছিল ব্যষ্টিস্বাতন্ত্রবাদ–যা থেকেই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবাধ স্বাধীনতার শ্লোগান তুলে এসেছিল ধনতন্ত্র৷ কিন্তু কালক্রমে দেখা গেল এই ধনতন্ত্র চরম পুঁজিবাদী শোষণের জন্ম দিল৷ তারপর এল সমষ্টিতন্ত্র্যবাদ–যার পথ ধরে এল মার্কসবাদ৷ মার্কসবাদ মানুষকে শোষণমুক্ত সমাজ রচনার স্বপ্ণ দেখিয়েছিল৷ সে দর্শন ছিল জড়বাদ ভিত্তিক৷ মার্ক্সবাদকে কেন্দ্র করে রাশিয়া, চীন প্রভৃতি দেশে সমাজবিপ্লব হ’ল৷ লক্ষ লক্ষ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হ’ল৷ কিন্তু যে সাধারণ মানুষের শোষণমুক্তির জন্যে এত কাণ্ড, সেই সাধারণ মানুষ যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থেকে গেল৷ মুক্তির পথ খুঁজতে গিয়ে নূতন করে শোষণের জালে জড়িয়ে পড়লো চীন,রাশিয়া সহ ইয়ূরোপের বেশকিছু দেশ৷ সেই শোষণের নাগপাশ মুক্ত হতে সোভিয়েত ইয়ূনিয়ন সহ ইয়ূরোপের দেশগুলি কম্যুনিজমকে আস্তাকঁুড়ে নিক্ষেপ করলো, মানচিত্র থেকে মুছে গেল সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র৷
তাহলে ধনতন্ত্র ও মার্ক্সবাদ দুই ব্যর্থ হ’ল৷ একটু তলিয়ে বিশ্লেষণ করলে এদের ব্যর্থতার মূল কারণগুলোও আমরা স্পষ্ট দেখতে পাব৷ অর্থনৈতিক দিক থেকে দেখতে গেলে, দুই মতবাদই অর্থনৈতিক কেন্দ্রীকরণকে সমর্থন জানিয়েছে৷ ধনতন্ত্রে মুষ্টিমেয় ধনিক শ্রেণীর হাতে সমাজের অর্থ–সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়৷ আর কম্যুনিষ্ট শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রের অর্থাৎ বাস্তবে সরকারের হাতে সমস্ত সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়৷ সমাজের সাধারণ মানুষের এব্যাপারে কোন ক্ষমতা নেই, তারা কেবল শ্রমিক–মজুর মাত্র৷ তাই অর্থনৈতিক ক্ষমতা জনসাধারণের হাতে থাকছে না৷ তাই স্পষ্টতঃ এখানে অর্থনৈতিক কেন্দ্রীকরণ হচ্ছে৷
তাছাড়া, মার্ক্সবাদ জড়বাদী দর্শন এখানে জড়বস্তুই সবকিছু৷ তাই মানুষ এখানে হয়ে যায় উগ্র ভোগবাদী৷ ধনতন্ত্রেও অর্থটাই জীবনের ধ্যান–জ্ঞান৷ জড় ভোগ্য বস্তুই জীবনের একান্ত কাম্য হওয়ায় বাস্তবে এটাও জড়বাদী তত্ত্ব৷ এখানেও সমাজে দেখা যায় উগ্র ইন্দ্রিয়–পরিতৃপ্তির লালসা৷ এই কারণে মানুষ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে কেবল ইন্দ্রিয়ভোগের পানে উন্মত্তের মত ছুটে চলে৷ বিবেকের বাণী তখন নিতান্তই গৌণ হয়ে যায়৷ আজকের মানুষের মনুষ্যত্বহীন, বিবেকহীন আচরণের পেছনে রয়েছে এই ভোগবাদ–যার ভিত্তি হ’ল জড়বাদ তথা জড় ভোগবাদ, যা মানুষকে পশুত্বের পর্যায়ে নামিয়ে দেয়৷
এই কারণেই বর্তমান সমাজে মানুষ ধীরে ধীরে ন্যায়–নীতি–বিবেক সমস্ত কিছু খুইয়ে মনুষ্যত্বের দিক থেকে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে৷ এই চরম যুগ–সংকট থেকে সমাজকে বাঁচাতে পারে এমনই এক দর্শন যা আধ্যাত্মিকতার ওপর প্রতিষ্ঠিত ও সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ দেখায়৷ অর্থনৈতিক গণতন্ত্র মানে হ’ল জনসাধারণের হাতে অর্থনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ৷ এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হ’ল–(১) প্রতিটি মানুষের নূ্যনতম চাহিদা পূরণের গ্যারান্টী৷ (২) স্থানীয় মানুষের হাতে স্থানীয় অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের অধিকার৷ আর আধ্যাত্মিকতাকে জীবনবাদ হিসেবে গ্রহণ করলে, সর্বানুসূ্যত ঈশ্বরের ভাবনা ও পরহিতব্রত মানুষকে নীতিবাদ ও নব্যমানবতাবাদে প্রতিষ্ঠিত করবে৷ তখন আত্মসুখ তথা নিজের ইন্দ্রিয় পরিতৃপ্তিটাই জীবনের ধ্যান জ্ঞান হবে না, পরন্তু সমসমাজতত্ত্ব অর্থাৎ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে জীবনের পরম পূর্ণতার পথে এগিয়ে চলাই হবে জীবনের ব্রত৷ ন্যায়, নীতি, মানবতা, পবিত্র জীবনকে মানুষ তখন চলার পথে সর্বোচ্চ মূল্য দেবে৷ মহান দার্শনিক পরম শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার প্রবর্তিত সামাজিক–অর্থনৈতিক দর্শন –প্রাউট এমনই এক দর্শন–যা আধ্যাত্মিকতাবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত ও এই অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠারই কথাই বলে৷
তাই আসুন আজ নূতন বৎসরের যাত্রা শুরুতে নিপীড়িত মানবতার মুক্তির দর্শন–এই প্রাউটকে জানুন, প্রাউটের পথ ধরে আসুন আমরা সর্বাত্মক শোষণমুক্ত সর্বাঙ্গ সুন্দর নোতুন পৃথিবী গড়ার কাজে ব্রতী হই৷
- Log in to post comments