নব্য মানবতাবাদই এই মানব সমাজকে রক্ষা করবে

লেখক
প্রবীর সরকার

এই পৃথিবীর বয়স কয়েক কোটি বছর৷ আর এই পৃথিবীতে মানুষেরও আবির্র্ভব প্রায় দশ লক্ষ বছর আগে৷ পৃথিবী একটি গ্রহ, এই বিশ্বে এমন কত যে গ্রহ আছে তার হিসেব নেই৷  আমরা আমাদের নিকটতম নক্ষত্র সূর্যের জন্যে অস্তিত্ব রক্ষা করে চলেছি৷ এই সূর্যের জন্যে দিন ও রাত্রি হয়, ঋতু পরিবর্ত্তন হয়৷ এটাই করুণাময় শ্রষ্ঠার অসীম কৃপা৷

এই গ্রহের জীব-জন্তু, গাছপালা, পশু পাখি,কীট-পতঙ্গাদি সকলেই একই সূত্রে গাঁথা৷ এই পৃথিবীতে প্রত্যেককেরই গুরুত্ব আছে মানুষ সবশেষে এই গ্রহে এসেছে৷ মানুষ যে এলাকারই হোক না কেন তাদের স্বাভাবিক কারণেই নূ্যনতম পাঁচটি অত্যাবশ্যক জিনিসের প্রয়োজন৷ যথা- অন্ন, বস্ত্র-শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান বাঁচতে গেলে এগুলির অবশ্যই দরকার, এগুলির জন্যেই কিন্তু বুদ্ধিমান মানুষ আদিম সুপ্রাচীনকাল থেকেই প্রকৃতির বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে লড়াই করে আসছে৷ সে লড়াই ঘরে-বাইবে চলছে৷ শরীরের মধ্যে সর্বদাই লড়াই চলছে৷ নানা রোগের বিরুদ্ধে আর বাইরে চলছে নানান বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে৷ এই লড়াইয়ে জিততে হলে সংঘবদ্ধ হতে হবে৷ তাই সমাজ তৈরী একান্ত প্রয়োজন৷ সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে চলার নামই সমাজ৷

এই লড়াই সকলকে করতে হচ্ছে৷ সে জীবজন্তু গাছ পালা সকলকেই ৷ যারা পারছে না তারা সৃষ্টির বুকে অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলছে৷ তাই আজ কত যে মানুষের জনপদ কত যে জীব জন্তু গাছপালা হারিয়ে গেছে তার হিসেব  নেই৷

আজ আমরা অত্যাধুনিক যুগে বাস করছি৷ কিন্তু আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি,আধুনিকতার আলো কী সকল মানুষ পেয়েছে! আজ হতভাগ্য পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষকে একদল অতিলোভী স্বার্থপর রাজনৈতিক কুচক্রী লুটে-পুটে খাচ্ছে ও শোষণ করছে৷ তাদের শোষণের অস্ত্র হচ্ছে নানা ধরণের সেন্টিমেন্ট বা ভাবাবেগ যেমন আঞ্চলিকতা, কুসংস্কার , ধর্মমতের গোঁড়ামি, জাত-পাত, বিচ্ছিন্নতাবাদী ভাবনা৷ এমন অনেক কিছু যার যুক্তি-বিজ্ঞান সম্মত কোনও ভিত্তি নেই৷  মানুষের পরিচয় মানুষ৷ এই সাদামাটা সত্য কথাটা   অধিকাংশ শোষক গোষ্ঠী বুঝেও বোঝে না৷ 

মহান ভারতবর্ষে মুনীঋষিরা কয়েক হাজার বছর আগেও ঘোষণা করে গেছেন--- সকল মানুষ এই বিশ্বস্রষ্টা পরমপুরুষের সন্তান৷ মানুষ হল ‘অমৃতের পুত্র’৷ সেই মানুষের জাত তো একটাই---তারা মানুষ৷ এটাই আজকের পৃথিবীতে মানুষের একমাত্র পরিচয় হওয়া উচিত৷ কবি চন্ডী দাসের কথা বলতে হয় , ‘শোণ রে মানুষ ভাই! সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’৷  ঠিক এই কথাটি পৃথিবীতে  বহু মানবতাবাদী মহাপুরুষ বলে গেছেন৷ আজকাল মুখে এই কথাটি অনেকেই বলে থাকেন তোতা পাখীর মতো মুখে কিন্তু বাস্তবের মাটিতে মেনে নিতে কুন্ঠাবোধ করেন৷

জাত-পাত সম্প্রদায়ের ভেদাভেদকেই প্রাধান্য দিয়ে আজও পৃথিবার বুকে বহু যুদ্ধ,  হত্যা, অত্যাচার প্রচন্ডভাবে বেড়েই চলেছে৷ ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িকতা পৃথিবীকে রক্তাক্ত করে চলেছে৷ অত্যন্ত বেদনা ও             দুঃখের কথা, জাতপাতের ক্ষমতার লোভে শাসকবর্গ জাত-পাতের বিভেদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে  প্রশ্রয় দিয়ে মানুষের পবিত্র সমাজকে  ভেদাভেদের  বিষবাষ্পে ভরিয়ে তুলেছে ও সেই অবস্থায় নির্মমভাবে শোষণ করে চলেছে৷ তার বিরুদ্ধে যে মহাপুরুষেরা পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়ে শোষণ নিপীড়ণ ও অত্যাচারের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্যে পবিত্র উপদেশ দিয়ে গেছেন তাদের অনেককে সমাজের শোষকগোষ্ঠী মিথ্যা অপরাধে অভিযুক্ত করে হত্যা করার চেষ্টা করেছেন বা করেছেন৷ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো যীশুখ্রীষ্টকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা৷ সক্রেটিসকে বিষপান করিয়ে  হত্যা করা পরমাধ্য মার্গ শ্রীশ্রী আনন্দমূত্তিজীকেও বিষ প্রয়োগের চেষ্টা হয়েছে৷

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকালে অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীকে কুচক্রীরা কারারুদ্ধ করেছে, হত্যাও করেছে৷

মধ্যযুগের মতো অস্ত্রবলে সর্বত্র ইসলামীক রাষ্ট্র কায়েম করতে আজ সারা পৃথিবীজুড়ে ইসলামিক জঙ্গীরা সন্ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করছে৷ রাজনৈতিক সাম্রাজ্যবাদীরাও  অস্ত্রবলে সমগ্র পৃথিবীতে আপন আধিপত্য বিস্তার করার নেশায় মেতে উঠেছে৷

এই দুঃসময়ে সমগ্র বিশ্বকে রক্ষার জন্য শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী সারা বিশ্বকে নব্যমানবতাবাদের বাণী শুনিয়েছেন৷ তার সঙ্গে সঙ্গে নব্যমানবতাবাদের ভিত্তিতে  দিয়েছেন নতুন সামাজিক, অর্থনৈতিক দর্শন --- ‘প্রাউট’৷

এই ‘প্রাউট’-এর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে  প্রাউটের প্রবক্তা চেয়েছেন এমন একটি সমাজ  যেখানে মানুষ মানুষকে শোষণ করবে না--- সে সামাজিক দিকথেকেই হোক, ধর্মমতের দিক থেকেই হোক অর্থনৈতিক দিক থেকেই হোক---কোন দিক থেকেই মানুষের সমানাধিকারকে ক্ষুন্ন করা চলবে না৷ মানুষ সবাই পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে প্রগতির পথে এগিয়ে চলবে৷ পৃথিবীর সমস্ত পশু-পক্ষী, তরুলতাকেও  মানুষ ভালোবাসবে৷ এটাই নব্যমানবতাবাদের সারকথা৷ প্রাউট -প্রবক্তা এই মূল কথাটাই সঙ্গীতের ভাষায় প্রকাশ করে বলেছেন ---

‘‘মানুষ যেন  মানুষের তরে

          সব কিছু করে যায় ৷

একথাও যেন মনে রাখে

         পশু-পাখী তার পর নয়

         তরুও বাঁচিতে চায়৷’’