শিক্ষাবিভাগের বিশৃঙ্খলা সম্পর্কে নানা মুখরোচক গল্প প্রচলিত আছে৷ গল্পগুলি তৈরী হয়েছিল কেন? চরম ঔদাসীন্য ও বিশৃঙ্খলার জন্যেই তো, তার সঙ্গে নৈতিকতা ও প্রজ্ঞাক্ষোধের অভাব তো রয়েইছে৷ ফাঁকি দিয়ে কোনো মহৎ কাজ হয় না একথা যেমন সত্য ঠিক তেমনই ফাঁকি দিয়ে পরীক্ষায় পাশ করলে বা করালেও জ্ঞানভৌমিক উন্নতি হয় না–পর্বতপ্রমাণ অনুপপত্তি থেকেই যায়৷
আমাদের পাড়ায় থাকতেন হিন্দী শিক্ষক শ্রীযুক্ত বাবু পুলকিত রায় (পুলকিত ঃ তিনি ‘পুল্কিৎ’ উচ্চারণ করতেন)৷ ছোটবেলায় আমাদের বিহারে শিক্ষককে সম্বোধন করা হত ‘মাটার সাহাব’ বলে৷ কেউ কেউ গুরুজীও বলত৷ পুলকিত রায় মশায় ইংরেজী জানতেন না৷ হিন্দী কেমন জানতেন তা আমার জানা নেই৷ ক্লাসে যেতেন হাঁটুর ওপরে তোলা একটি আধ–ময়লা ধুতি পরে, গায়ে থাকত পানের ছোপ ধরা একটি ফতুয়া, কাঁধে একটি গামছা৷ ফতুয়ার এক পকেটে থাকত একটি দেশলাই, অপর পকেটে এক ক্ষাণ্ডিল ক্ষিড়ি৷ দেশলাইয়ের কাঠিগুলো ব্লেডে করে লম্বালম্বি ভাবে চিরে দু’টো করে রেখে দিতেন৷ আসলে যতগুলো কাঠি থাকে এতে তার ডবল সংখ্যক কাঠি পাওয়া যেত৷ স্কুলে পৌঁছেই মাটার সাহাব পাশের টিউব–ওয়েলে স্নান করতেন–তার পরে ছাতু* খেতেন (ছোলার ছাতুর সংস্কৃত ‘শত্তুণ’, যবের ছাতু আর মুড়ির ছাতুর সংস্কৃত ‘ধানাকা’ বা ধানাচূর্ণ)৷ তেল–নুন–লঙ্কা মেখে ছাতু খেতে তেমন কিছু সময় লাগত না (আমিও ওই ভাবেই ছাতু খেতুম কারণ তা যে শুধু মুখরোচক তা–ই নয়, বিজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে ওইভাবে খেলে ছাতুকে তিক্ত–কটু–লবণ–ক এই ছয় রসের সন্তুলিত সমাবেশে মনোজগতে ও জড়জগতে এক অপূর্ব খোলতাইয়ের সৃষ্টি হয়৷ আ–দুধ দিয়ে খেলেও ছাতু মুখরোচক ও শক্তিবর্দ্ধক)৷ রাত্তিরে নিজের বাড়ীতে ভাত খেতেন৷ একদিন দেখলুম শ্রীযুক্ত বাবু পুলকিত রায় ফুলসাইজের ধুতি আর পাঞ্জাবী (উত্তর ভারতে ‘পাঞ্জাবী’কে ‘বাংলা কুর্ত্তা’ বলা হয়) পরে ইস্কুলে যাচ্ছেন৷ মুখে পান নেই, পকেটে বিড়ি–দেশলাইও নেই৷ আমি জিজ্ঞেস করলুম–‘‘কী হোল ছে মাটার সাহাব?’’
পুলকিত রায় বললেন–‘‘আই নিস্পেক্টার সাহাব এ্যাইতেই’’ (আজ ইন্স্পেক্টর সাহেব আসবেন)৷
* * *
শিক্ষার মান সম্বন্ধে নানান ধরনের গপ্প প্রচলিত আছে৷ গপ্পগুলো সত্যি হোক বা না হোক, তার ভিত্তিটা বাস্তবধর্মী৷ একবার এক নিস্পেক্টর সাহেব বিদ্যালয় পরিদর্শনে আসবেন৷ শিক্ষক মশায়রা স্কুল বাড়ী পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন করে রাখছেন৷ ছাত্রদের বলে দিয়েছেন–চান করে মাথা আঁচড়ে আসবি পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন হয়ে আসবি কাচা জামা কাপড় পরে আসবি পায়ে জুতো পরেও আসবি৷
দু’একজন ছাত্র বললে–‘‘স্যার, আমার যে জুতো নেই৷’’
মাষ্টার মশায় বললেন–‘‘আর কারো কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে সেদিনকার মতো পরবি৷’’
আর একজন ছাত্র বললে–‘‘আমার মামাতো ভাইয়ের জুতো আছে কিন্তু তার জুতো তো আমার পায়ের মাপের চেয়ে বড়৷’’
মাষ্টার মশায় বললেন–‘‘বড় জুতো হলে ক্ষতি নেই, আস্তে আস্তে পা টেনে টেনে চলবি–ছোট জুতো না হলেই হল, তাহলে পায়ে গলবে না৷’’
হ্যাঁ, জুতো প্রসঙ্গে আমার ছোটবেলাকার একটি গল্প মনে পড়ে গেল৷ আমাদের বাড়ীতে কাজ করত জনৈক বুধুয়ার মা৷ তারবু জন্ম হয়েছিল কি না৷ বুধুয়া ইস্কুলে ভর্তি হয়েছিল৷ একদিন বুধুয়া এসে তার মাকে বললে–‘‘মা, কাল ইস্কুলে নিস্পেক্টর আসবেন৷ মাষ্টার মশায় বলেছেন জুতো পরে যেতে৷’’ তার মা সেইদিনই সন্ধেয় ক্ষর্দ্ধমানের রাণীগঞ্জ বাজার থেকে এক জোড়া জুতো কিনে এনে দিলে৷ পরের দিন বুধুয়া মাথায় অনেকখানি সরষের তেল ঢেলে চান করে টেরি কেটে নোতুন জুতো পরে ভাল করে সেজেগুজে ইস্কুলে গেল৷ কিন্তু তার ঠিকেয় ভুল হয়ে গেল৷ তাড়াতাড়িতে সেদিন সে প্যান্ট–শার্ট পরতে ভুলে গেছলো৷
শিক্ষক ছাত্রদের বলেছিলেন–‘‘ক্লাসে নিস্পেক্টর সাহেব যখন আসবেন আমি তাঁর পেছনে দাঁড়াব৷ তিনি যখনই কিছু জিজ্ঞেস করবেন আমি আভাসে ইঙ্গিতে তার উত্তরটা তোদের বলে দোব৷ তোরা সব সময় আমার দিকে তাকিয়ে থাকবি৷’’
ছেলেরা বললে–‘‘আচ্ছা স্যার, আমরা তা–ই করব৷’’
নিস্পেক্টর সাহেব প্রথমেই গেলেন সংস্কৃতের ক্লাসে৷ পণ্ডিত মশায় সেদিন আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন–কিছুতেই ক্লাসে ঘুমোব না৷ নিস্পেক্টর আসা মাত্রেই তিনি তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালেন৷ যথাবিধি নিস্পেক্টরের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন৷ নিস্পেক্টর একটি ছাত্রকে শুধোলেন–‘‘আচ্ছা বল তো, ‘গো’ শব্দের দ্বিতীয়ার বহুবচনে কী হবে?’’
ছেলেটি চালাক–তুখোড় হলেও উত্তরটা তার জানা ছিল না৷ সে জিজ্ঞাসু নেত্রে নিস্পেক্টরের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা পণ্ডিত মশায়ের দিকে চেয়ে রইল৷
‘গো’ শব্দের দ্বিতীয়ার বহুবচনে ‘গাঃ’৷ বাংলা ভাষায় শরীরকে ‘গা’ বলা হয় (গাত্র>গাত্ত>গাঅ>গা)৷ পণ্ডিত মশায় দু’হাতে করে নিজের মাথা থেকে পা পর্যন্ত ছঁুয়ে যেতে থাকলেন–ওপর থেকে নীচে, নীচে থেকে ওপরে৷ এইভাবে ছাত্রদের পণ্ডিত মশায় তাঁর নিজের গোটা গা–টাকেই দেখাতে লাগলেন৷
ছাত্রও মহা তুখোড় গুরু গুড় তো চেলা চীনী৷ সে ভাবলে–‘গা’ তো আমাদের ঘরোয়া বাংলা কথা৷ ওটা সংস্কৃতে চলবে না৷ ওর সংস্কৃত হচ্ছে ‘শরীর’৷ তাই সে নিস্পেক্টর সাহেবকে বললে–‘‘স্যার, ‘গো’ শব্দের দ্বিতীয়ার বহুবচন হচ্ছে ‘শরীরম্’৷’’