মানব সভ্যতা আজ এক চরম সংকট মুহূর্ত্তে এসে উপনীত হয়েছে৷ মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, সামাজিক অবিচার, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত অমনোবৈজ্ঞানিক শিক্ষা ব্যবস্থা, সংস্কৃতির নামে বেলেল্লাপনা, ধর্মীয় মৌলবাদ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, অসহ্য দারিদ্র্য, লাগাতার অনাহার,--- এককথায সার্বিক অবক্ষয় মানব সমাজের গতিকে রুদ্ধ করেছে ৷ অজগরের মতো সমগ্র মানব সমাজকে আষ্টে -পিষ্টে জড়িয়ে ফেলেছে৷ হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবী, সারা বিশ্বজুড়ে তাই যুদ্ধের এত রণহুঙ্কার, স্বার্থের এত সংঘাত, মানবরূপী দানবদের এত আস্ফালন ! একদিকে সীমাহীন ভোগের প্রাচুর্য্য, অন্যদিকে কোটি কোটি বুভুক্ষু মানুষের হাহাকার ও আর্ত্তনাদে মানবতা আজ ধূলি-লুন্ঠিত৷ কমিউনিজমের অকাল মৃত্যুর পর পুঁজিবাদী দানব আজ গ্রাস করে নিচ্ছে বিশ্বের অধিকাংশ সম্পদ৷ সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সমীক্ষক সংস্থা ‘অক্সফ্যাম’-এর রিপোর্টে প্রকাশ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় আটজন ধন কুবেরের কাছে যে সম্পদ আছে তা গোটা পৃথিবীর অর্ধেক জনসংখ্যার কাছে থাকা সম্পদের সমান৷ ভারতের ক্ষেত্রে এদেশের ৫৮ শতাংশ সম্পদ আছে মাত্র ১ শতাংশ মানুষের কাছে৷ মাত্র ৫৭ জন কোটিপতির কাছে যে সম্পদ আছে তা এদেশের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ মানুষের কাছে থাকা সম্পদের সমান৷ মুষ্টিমেয় মানুষের কাছে থাকা সম্পদের প্রাচুর্য্যই অধিকাংশ মানুষের অভাবের কারণ৷ তাই বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ আজ চরম দারিদ্র্যের শিকার, বিভিন্ন দেশে অনাহারে অপুষ্টিতে মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে৷ ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় কোটি কোটি মানুষ যখন ক্ষুধার জ্বালায় কাতর আর কমিউনিষ্ট দেশগুলোতে মানসিক ও কোথাও কোথাও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অভাবে লক্ষ কোটি মানুষের কান্নার ফোঁপানি ও বুকচাপা দীর্ঘশ্বাসে যখন পৃথিবীর আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল, হতাশাগ্রস্ত ও দিশাহারা মানুষ যখন সমাজের এই অন্ধকার থেকে উত্তরনের পথ খুঁজছিল, এমতাবস্থায় সভ্যতার সেই যুগ সন্ধিক্ষণে যুগ পুরুষ ও মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকার মানব সমাজকে উপহার দিলেন তাঁর অভিনব সামাজিক-অর্থনৈতিক দর্শন, নিপীড়িত মানবতার মুক্তিরমন্ত্র ‘প্রাউট’৷ মানবমুক্তির নোতুন পথ ‘প্রাউট’ (প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব)৷ শোষিত, বঞ্চিত ও দিশাহারা মানব সমাজকে তিনি শোণালেন নব্যমানবতার পাঞ্চজন্য৷
* প্রাউটের লক্ষ্য
আধ্যাত্মিকতার ওপর আধারিত ‘প্রাউটে’র লক্ষ্য সর্বপ্রকার শোষন ও দুর্নীতিমুক্ত এক নোতুন পৃথিবী তথা এক অবিভাজ্য মানব সমাজ গড়ে তোলা৷ প্রাউট প্রবক্তার ভাষায় ‘‘প্রাউট ছাড়া এই ক্লেশ দূর করে মানবতাকে রক্ষা করার অন্য কোন উপায় নেই৷ অন্নহীনকে পরমার্থের কথা শুনিয়ে লাভ নেই৷ বাস্তব জগতে বাঁচতে হলে অর্থের দরকার৷ অস্তিত্ব রক্ষার মাধ্যম হলো অর্থ, সেই সঙ্গে দরকার ‘পরমার্থ’৷ অন্ন চাই , বস্ত্র চাই, বাঁচার মতো বাঁচতে চাই, চিকিৎসা চাই, নিবাস চাই, আর এই প্রয়োজন মেটাবার জন্যেই একদিন আমি অবস্থার চাপে পড়ে ‘প্রাউট’ দর্শন তৈরী করতে বাধ্য হয়েছি’’৷ প্রাউটের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল সমাজের প্রতিটি মানুষের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার নিশ্চিততা (গ্যারান্টি) প্রদান করা৷ আর তা করতে গেলে আজকের সমাজের ভয়াবহ দারিদ্র্য ও বেকার সম্যসার সমাধান করতে হবে৷ এজন্যে প্রাউটের ‘অর্থনৈতিক গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠাই অর্থনৈতিক সম্যসার একমাত্র সমাধান৷ এ প্রসঙ্গে প্রাউট প্রবক্তা শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন ‘‘স্থানীয় জনসাধারণের হাতেই সমস্ত অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকবে’’৷ l অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকে উপর থেকে চাপিয়ে না দিয়ে ব্লক স্তর থেকে শুরু করে ক্রমশঃ উপরে নিয়ে যেতে হবে৷ l অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বয়ম্ভর হয়ে উঠতে পারে এমন একটা স্বয়ং সম্পূর্ণ সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চল ঠিক করে নিয়ে অঞ্চলটিকে শোষণমুক্ত করতে হবে৷l স্থানীয় অর্থনীতিতে বহিরাগতদের নাক গলাতে দেওয়া চলবে না৷l স্থানীয় অর্থনীতিতে যাতে বহিরাগতরা নাক গলাতে না পারে সে উদ্দেশ্যে সমস্ত কর্মসংস্থানেই স্থানীয় মানুষকে অগ্রাধিকার দিতে হবে৷ সেজন্যে সরকারী ও বেসরকারী সংস্থা ও অফিসগুলিতে স্থানীয় ভাষাকে যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করতে হবে৷l স্থানীয় জনসাধারণের ১০০ ভাগ কর্ম সংস্থান সুনিশ্চিত করতে প্রযুক্তি-নির্ভর শিল্পকে প্রাথমিক অবস্থায় উৎসাহ না দিয়ে শ্রমনিবিড় (অর্র্থৎ যে শিল্পে বেশী লোক নিয়োজিত হতে পারবে) শিল্প স্থাপন করতে হবে৷l শুধু ভারী শিল্পের (যেমন গাড়ী শিল্পের) উপর জোর না দিয়ে প্রতিটি ব্লকে কাঁচামাল ভিত্তিক কৃসি-নির্ভর শিল্প ও প্রতিটি জেলায় কৃষি-সহায়ক শিল্প গড়ে তুলতে হবে৷l কৃষিকে শিল্পের মর্র্যদা দিতে হবে৷l জনগণ যাতে বিদেশী পণ্য না কিনে স্থানীয় শিল্পে উৎপাদিত পণ্য ক্রয় করে, তা সুনিশ্চিত করতে স্থানীয় বাজারে বহির্পণ্যের প্রবেশ রুখে দিতে হবে৷l কৃষি-শিল্প-বাণিজ্য সমস্ত ক্ষেত্র থেকে ধীরে ধীরে ব্যষ্টিগত মালিকানার অবলুপ্তি ঘটিয়ে সমবায়ের মাধ্যমে সমস্ত কিছুর পরিচালনা করতে হবে৷ ‘প্রাউট’ সেই পথই দেখিয়েছে, যা দেখাতে আজকের সমাজের প্রচলিত ধনতন্ত্র ও মার্কসবাদ দুইই শোচনীয় ভাবে ব্যর্থ৷ প্রাউট প্রবক্তা ব্যষ্টি স্বাধীনতা ও সমষ্টি স্বার্থের মধ্যে এক অপূর্ব সমম্বয় সাধন করেছেন৷
* শোষণের ছলাকলা ও ভোগসর্বস্ব জীবনচর্যা
পুঁজিবাদের প্রভাবে ও বিশ্বায়নের করালগ্রাসে বর্ত্তমানে পাশ্চাত্ত্যের ভোগসর্বস্ব জীবনচর্যা ও অবাধ যৌনতার লাভাস্রোতে ভেসে যাচ্ছে ভারতের সুপ্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, মানবিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ৷ আজকের সমাজে পণপ্রথা, নারী পাচার, নারী নির্যাতন, বধূ হত্যা, শ্লীলতাহানী, যৌনলাঞ্ছনা, লোমহর্ষক ও পাশবিক অত্যাচার, ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা বর্তমান সভ্যতার তথাকথিত অগ্রগতিকে ধিক্কার জানাচ্ছে, ব্যঙ্গ করছে৷
পুঁজিপতিদের অন্যতম প্রধান স্ট্র্যাটেজী হ’ল, যুব ও ছাত্র সমাজের নৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া যাতে তারা কোনদিনই তাদের শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা আন্দোলন করতে না পারে৷ সেই লক্ষ্যে তারা সুস্থ সংস্কৃতির অঙ্গনে বেনো জল বিশ্বায়নের জন্যে এখন সর্বত্রই খোলা দরজা৷ ইন্টারনেটের দৌলতে এখন সব কিছুই ঘরের মধ্যে উপলব্ধ৷ সমাজের সর্বস্তরে অসংস্কৃতির বেনো জল প্লাবনরূপী হাঙরের মতো শহর ছাড়িয়ে গ্রামে গঞ্জের ঘরে ঘরে ঢুকে কিশোর কিশোরীদের কচিমাথা থেকে যুবক যুবতীদের মাথা পর্যন্ত চিবিয়ে খেতে লাগল৷ এইভাবে সমাজের অনেকেই বিকৃত রুচির অধীন পাশ্চাত্ত্যের অন্ধ অনুকরণে আধুনিকতার নামে সিনেমা, টিভি ও বিজ্ঞাপনের প্রচারের জৌলুসে বিভ্রান্ত হয়ে কিশোরী থেকে যুবতীদের অনেকেই উত্তেজক ও অশালীন পোশাক পরে নিজেদের শরীরকে ভোগ্যপণ্যে পরিণত করছে৷ পুরুষের ভোগ বাসনায় ইন্ধন যোগাচ্ছে৷ ফলস্বরূপ ভোগ–সর্বস্ব জীবনচর্যায় সৃষ্ট সমাজে কিশোর থেকে বৃদ্ধ–এক শ্রেণীর বিকৃতকাম নরপশুর লালসার শিকার হচ্ছে৷ পুঁজিপতিদের দালালি করা কিছু মিডিয়া গণতান্ত্রিক অধিকার, আধুনিকতা, নারী স্বাধীনতা প্রভৃতির দোহাই দিয়ে আজকের এই অসুস্থ ‘লুম্পেন সংস্কৃতি’র হয়ে কলম ধরছে ও যুব সমাজকে বিপথে পরিচালিত করছে–যাতে ছাত্র–যুব সমাজ এই শোষণ, বঞ্চনা, দুর্নীতি ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে আর কোনভাবেই বিক্ষোভ আন্দোলন প্রভৃতি গড়ে তুলতে না পারে৷
হিংসা, স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতা ও নগ্ণ নারীদেহের অবাধ প্রদর্শনের মাধ্যমে মানুষের নৈতিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে গেলে সে আর কোনদিনই অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না, প্রতিবাদ করতে পারবে না৷ এইভাবে বৈশ্যরা ভোগবাদী জীবনচর্যাকে কৌশলে সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিয়ে তাদের শোষণের সাম্রাজ্যকে দীর্ঘস্থায়ী করে৷
সমাজের সার্বিক অবক্ষয়ের ফলে মানুষের বিবেক বোধ, ভালমন্দ বিচার করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে৷ যার ফলে সমাজে নারী–পাচার, বধূ নির্যাতন, ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা প্রতিদিন বেড়েই চলেছে৷ পুঁজিপতি সৃষ্ট অ–সংস্কৃতির জোয়ারে ভোগী মন অবাধে ভেসে যাচ্ছে৷ সমাজ অ–সংস্কৃতির কালব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে গেছে৷
* নোতুন দিনের নোতুন সূর্য প্রাউট
বৈশ্যদের ষড়যন্ত্রে ও রাজনীতির চোরাবালিতে তলিয়ে যেতে বসা দিশাহীন ও সমাজকে নোতুন আশার আলোর দিশা দেখাচ্ছে ‘প্রাউট’৷ ঘুণে ধরা সমাজের কাঠামোটা টান মেরে উপড়ে ফেলে দিয়ে সমাজ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গড়ে তুলতে হবে নোতুন সমাজ৷ এজন্যে দরকার যুবশক্তির নবজাগরণ৷ বফড়ক স্থবিরতাকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়ে জীবনের জয়গান গাইতে হবে৷
ইতিহাসে দেখা গেছে সমাজে যখনই সংকটের কালো মেঘ ঘনীভূত হয়েছে, সমাজ গতি হারিয়ে স্থবির হয়ে গেছে, সমাজ জীবন যখন পঙ্কিলতায় আবদ্ধ হয়ে গেছে, সেই সময় জীবন–মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে একদল তরুণ–তরুণী দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলে বিপ্লবের বিজয় পতাকা উড়িয়ে দিয়ে সমাজের সমস্ত অচলায়তন ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে৷ সমাজ জীবনে এনে দিয়েছে মুক্তির এক ঝলক টাটকা বাতাস৷ তারা পুরাতনের জীর্ণ–জঞ্জালকে সরিয়ে দিয়ে নোতুন জীবনের রক্তিম ঊষাকে বরণ করে নিয়েছে৷ পরবর্ত্তীকালে সমাজ যাদের বরণ করে নিয়েছে বিপ্লবের অগ্রদূত ও নোতুনের বার্তাবহ বলে৷
‘উষার দুয়ারে হানি আঘাত আমরা আনিব রাঙা প্রভাত’
প্রাউট হ’ল পূর্ব দিগন্তের সেই নোতুন রক্তিম ঊষা৷
মানবজাতির ভাগ্যাকাশ সুদীর্ঘকাল ধরে ড্রাগনরূপী মার্কসবাদ ও দানবরূপী পুঁজিবাদের দ্বারা তমসাবৃত৷ ‘উষার উদয়লগ্ণ সমাগত দেখে তামসী বিভাবরী সরে যেতে বাধ্য’৷ অমানিশার অন্তে পূর্ব দিগন্তে নোতুন দিনের নোতুন সূর্য আজ বিশ্ববাসীকে জানাচ্ছে উদাত্ত আহ্বান৷ তাদের শোণাচ্ছে চরৈবেতির মন্ত্র, এই মন্ত্র হ’ল প্রগতিশীল সমাজতন্ত্রের মন্ত্র, তা হ’ল নিপীড়িত মানবতার মুক্তির মন্ত্র---‘প্রাউট’৷
- Log in to post comments