এন আর সি-র কালো ধোঁয়া, নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের অন্ধগলি, রাষ্ট্রহীনতার আশঙ্কা, রাজনৈতিক তঞ্চকতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক সাম্প্রদয়িক বিভেদ, সাংস্কৃতিক অবক্ষয়, শিক্ষার পবিত্র অঙ্গণে উচ্ছৃঙ্খলতা, সাহিত্যের নামে অশ্লীলতা, ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ধর্মান্ধদের উন্মত্ততা, ব্রিটিশ পরবর্তী হিন্দী সাম্রাজ্যবাদীর অনুপ্রবেশ, আদর্শহীন ভোট সর্বস্ব রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় পররাজ্যবাসীদের তোষণ---বাঙালীর জীবনে সূর্যোদয়ের সকালটাও কালো অন্ধকারে ঢেকে দেয়৷
দেশবন্ধু সুভাষচন্দ্রের আদর্শ, ক্ষুদিরাম প্রফুল্ল চাকী সূর্যসেন, বাঘাযতীন.....সহস্র বাঙালীর আত্মত্যাগ বৃথা! সব ব্যর্থ৷ বাঙালীর আত্মত্যাগে রক্তদানে যে স্বাধীনতা (!) অর্জিত হ’ল সেই স্বাধীনতাই আজ বাঙালীকে বিদেশী বানাবার হুমকী দিচ্ছে৷ নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন---এতো শুধু বাঙালীর জন্যই হয়েছে৷ দেশভাগের বলি বাঙালীকে আজ দেশ থেকে তাড়াবার চক্রান্ত শুরু হয়েছে৷ বাঙালী ভ্রাতৃঘাতী রাজনীতির ঝাণ্ডা নিয়ে অন্ধ গলিতে ঘুরে মরছে৷ কবে বাঙালীর জীবন থেকে এই কাল রাত্রির অবসান হবে?
স্বাধীনতা সংগ্রামে যাঁর আত্মত্যাগ, অবদান অনস্বীকার্য স্বাধীন দেশ থেকে তাকেই রাষ্ট্রহীন করর এই প্রয়াস কেন? পরাধীন ভারতে যে বাঙলা শিল্পে, সাহিত্যে, বিজ্ঞানে, শিক্ষায়, রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে, কৃষিতে সবার আগে ছিল সে কেন স্বাধীন দেশে এত পিছে, এত নীচে, এত অবজ্ঞার!
গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত নাগরিক সংশোধন আইন৷ ধর্মীয় মতবাদের সুড়সুড়ি দিয়ে বিভাজনের রাজনীতি বাঙলায় অনেকটাই জলো হয়ে গেছে৷ তাই এবার নতুন পথে শরণার্থী অনুপ্রবেশকারী-নাগরিকত্ব প্রদানের টোপে বিভাজনের বিষ৷
কী অপরাধ বাঙালীর! বাঙালীর সবচেয়ে বড় অপরাধ সে শুধু ক্ষমতার মধু পান করার জন্য স্বাধীনতা চায়নি, বাঙালীর স্বাধীনতার স্বপ্ণ ছিল পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী শোষণের অবসান, অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা৷ ১৯৩৮ সালে প্রথমবার কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হয়ে সুভাষচন্দ্র দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন --- ‘‘দেশীয় পুঁজিপতিদের সাহায্যে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য শক্তি অর্জন করছে৷ এদের বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে৷ শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়, মানুষকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও দিতে হবে৷’’
কংগ্রেসে শুরু হ’ল সুভাষ উচ্ছেদ ষড়যন্ত্র৷ সাম্রজ্যবাদী ব্রিটিশ ও তার দেশীয় পুঁজিপতি বন্ধুরা কংগ্রেসকে এই কাজে মদত দিয়েছিল৷ আর এই কাজে কমিউনিষ্ট ও আর এস. এসও সুভাষ বিরোধী শক্তিকেই সমর্থন করেছে৷ সেদিন সুভাষ বিরোধিতায় ডান, বাম, রাম ঐক্যবদ্ধ ছিল কারণ দেশীয় পুঁজিপতিদের সাহায্য শুধু ব্রিটিশ সাম্রাজ্য নয়, স্বদেশপ্রেমী রাজনৈতিক দলগুলোও পেত৷ বাঙালীর দুর্ভাগ্য ডান-বাম-রামের এই কাজে সহযোগিতা করার নেতার অভাব বাঙলায় হয়নি৷ আজও যেমন বাঙালী উচ্ছেদের কালাকানুন নাগরিত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে কাদা ছোঁড়াছুঁড়িতে শক্তি ও সময় বেশী ব্যয় করছে৷ হায়! বাঙালী নিজের ভালোটা কবে বুঝবে?
বিশ্বকবি লিখেছেন---‘‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্দ জননী রেখেছো বাঙালী করে, মানুষতো করনি’’৷ কিশোর সুভাষ এক পত্রে তাঁর মাকে লিখেছিলেন---‘‘মা, বাঙালী কি কখনো মানুষ হইতে পারিবে?’’
কোটি টাকার প্রশ্ণ ৷ বাঙালী যদি সেদিন সত্যিই মানুষ হ’ত, পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মদতপুষ্ট ডান, বাম, রাম ছেড়ে ঐক্যবদ্ধ হ’ত তাহলে সুভাষচন্দ্র নিরুদ্দেশ হতেন না, দেশে সাম্প্রদয়িক দাঙ্গা হতো না, দেশভাগ হত না, বাঙালীকে আজ এই দুর্ভোগ সহ্য করতে হ’ত না৷ এত আঘাতে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত তবু কপট রাজনীতির মোহ ত্যাগ করে বাঙালী ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে কই? বরং পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদীর হাতের পুতুল হয়ে দিশাহীন আদর্শহীন ভ্রাতৃঘাতী রাজনীতিতে মত্ত৷ ব্যর্থ তাঁর আত্মত্যাগ, ব্যর্থ তাঁর দেশপ্রেম, নিস্ফল তাঁর আদর্শ বোধ৷ যদি বাঙালী মানুষ হ’ত তাহলে বাঙালীর আজ এই দুর্দশা হোত না৷ স্বভূমিতেই তাকে পররাজ্যবাসীর হাতে মার খেতে হ’ত না, বিতাড়নের হুমকী শুণতে হ’ত না৷
সত্যই কী তাই? না, তা নয়৷ বাঙালীর এই পরিচয় সব নয়, পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী শোষণের শিকার হয়ে কিছু বাঙালী ভ্রান্ত পথে চলছে৷ স্বার্থলোভ ক্ষমতার মোহ তাদের গ্রাস করেছে৷ তবু বাঙলায় মানুষ আছে৷ এই তঞ্চকতার রাজনীতি, ভাতৃঘাতী রাজনীতি ছেড়ে আবার জেগে উঠবে৷
যার নিজের পায়ের নীচের মাটি নড়বড় করছে, প্রতিনিয়ত যাকে রাষ্ট্রহীন হওয়ার আতঙ্ক তাড়া করছে, স্বভূমিতে যার গায়ে বিদেশীর তকমা তার তো অস্তিই বিপন্ন৷ তার ভারত প্রেম বিশ্বপ্রেম সবই ভড়ং৷ বাঙালী এই ভণ্ডামী ছেড়ে রুখে দাঁড়াবেই অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে, দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে, শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে৷ আবার জেগে উঠবে ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, বিনয়-বাদল-দীনেশ, সূর্যসেন, বাঘাযতীন.....বাঙলার দামাল ছেলেরা৷ বিশ্বকবির ভবিষ্যৎবাণী সত্য হবে--- ‘‘বাঙালী অদৃষ্ট কর্ত্তৃক অপমানিত হয়ে মরবে না৷... প্রচণ্ড মার খেয়েও বাঙালী মারের ওপর মাথা তুলে দাঁড়াবে৷’’