পিতামাতা ও সন্তানের সম্পর্কেও অবক্ষয়!

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন --- ‘‘মানুস  পিতামাতার মধ্য থেকে যে অমৃতের  ধারা লাভ করেছে সেইটিকে অনুসরণ করতে গিয়ে দেখেছে কোথাও  তার সীমা নেই৷’’ পিতামাতার সঙ্গে সন্তানের যে অবিচ্ছেদ্য স্নেহের সম্পর্ক তা অন্তহীন, তা চিরন্তন৷ তাই  পিতা মাতা যেমন তাঁদের অন্তরের সমস্ত স্নেহ ভালবাসা, সম্পদ দিয়ে সন্তানের প্রতি  দায়িত্ব পালন করেন, সন্তানকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলেন, উপযুক্ত সন্তানও তেমনি পিতামাতার বয়সকালে তার দায়িত্ব পালন করে, পিতামাতার সব ভার সন্তানের ওপর বর্র্তয়৷ আমাদের সমাজে এটাই ছিল সংসারের স্বাভাবিক ধর্ম৷ এ নিয়ে কোন গোল ছিল না৷ কিন্তু  আজ জড়বিজ্ঞানের নিত্যনূতন আবিষ্কার যেমন মানুষকে অঞ্জলি ভরে  দিয়েছে, তেমনি হৃদয় নিঙরে নিঃস্ব করে নিয়েও  নিয়েছে৷ তাই সমাজ সংসারে  সন্তান ও পিতামাতার যে অন্তহীন স্নেহ-শ্রদ্ধার সম্পর্ক, কোথায় যেন ছেদ পড়েছে৷ আজ সেই সম্পর্ক এমন জায়গায় পৌঁচেছে যে সন্তান যাতে বাবা মাকে দেখে,তাদের দায়িত্ব নেয় তারজন্যে কঠোর আইন আনার কথা ভাবতে হচ্ছে৷ কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী কলাকুশলীদের এবার ভাবার সময় এসেছে৷ সমাজ সংসারে এই যে অবক্ষয়, এই যে অধঃপতন এর দায়  কার!

বিবেকানন্দ জাহাজে যেতে যেতে একটি বিদেশী গল্প পড়েছিলেন৷ গল্পের মূল বিষয়বস্তু ছিল একটি ছেলে চাকরি করে প্রথম মাসের বেতন তার বাবা মায়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন৷ বাবা-মার প্রতি সন্তানের কর্তব্য শেখাতেই ওই গল্পের অবতারণা৷ ভারতবর্ষে বিশেষ করে  বাঙলায় এ গল্পের সেদিন প্রয়োজন ছিল না৷

আজকের অবক্ষয়িত  শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ ক্যারিয়ারিষ্ট তৈরী হচ্ছে৷ অধিকাংশ রোবট ম্যানের মতো যাদের মানবতার পাঠ জানা নেই৷ তাই তারা মানুষও হচ্ছে না৷  সেক্স আর ভায়োলেন্স মার্র্ক চলচ্চিত্র, সাহিত্য ছাত্র-যুব সমাজকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছে যে বাবা-মাকে দেখার জন্য রাষ্ট্রকে কঠোর আইন প্রয়োগ করার কথা ভাবতে হচ্ছে৷ যা ছিল সন্তানের সহজ সরল স্বাভাবিক কর্তব্যবোধ, তাকে আইন করে বাধ্য করাতে হচ্ছে৷ সন্তানের  কাছে, এমনকি পিতামাতার কাছেও এ মোটেই গৌরবের নয়৷ সমাজের কাছেও এ লজ্জা ঢাকার জায়গা নেই৷

সমাজের এই অধঃপতনের জন্য দায়ী কে? শুধু কি সন্তানরা! শুধু কি রাষ্ট্র ব্যবস্থা! ফরাসি বিপ্লব থেকে রুশ বিপ্লব--- ইতিহাস  বলছে কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীদের অবদানের কথা৷ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল ‘আনন্দমঠ, ‘নীলদর্পণ’, পথের দাবী৷ তাহলে আজকের যুব সমাজের এই বিপথগামী হওয়ার পেছনেও শিল্পী সাহিত্যিক কলাকুশলীদের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই৷ কতকগুলি বাংলা চ্যানেল সারাদিন যে সব সিরিয়ালগুলো দেখায়, তাতে শুধু পারিবারিক কলহ, বিবাদ,ষড়যন্ত্র, কুমন্ত্রণা, কুচক্রী যতরকম হীন মানসিকতা  প্রকট৷ এর প্রভাব সমাজে পড়ছে৷  আর আজকের যুব সমাজ অশ্লীল বলিউড,টলিউড চলচ্চিত্র ,সিরিয়ালে বুঁদ হয়ে আছে সে৷  প্রতিদিন কত শত কৃষক, দলিত সাধারণ মানুষ আত্মহত্যা করছে, খুন হচ্ছে রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার বলি হয়ে--- এসব নিয়ে তাদের  কোন মাথা ব্যাথা নেই৷

তবে আজকের তরুণ তরুণী ও পারিবারিক জীবনে এই যে অধঃপতন এই যে হীনতা-নীচতা---এর সব দায় শুধু রাষ্ট্রব্যবস্থার ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে চলবে না৷ কবি সাহিত্যিক শিল্পী অভিনয় জগতের কুশীলবরাও দায়ী, বরং একটু বেশি দায়ী৷ রাষ্ট্রের যেমন দায়বদ্ধতা আছে আইন-শৃঙ্খলা সামাজিক শান্তি ইত্যাদি বজায় রাখার, তেমনি কবি-সাহিত্যিক শিল্পী ও কলাকুশলীদের দায়িত্ব আছে ছাত্রযুব সমাজকে সঠিক পথ নির্দেশনা দেয়ার৷ শিল্পকলার মাধ্যমে কিন্তু তারা বিপরীত কাজটাই করছে৷ এই ধরণের কবি সাহিত্যিক শিল্পীরা বলে থাকেন---‘‘শিল্পের খাতিরে শিল্প৷’’ যুগান্তকারী প্রাউট দর্শনের প্রবক্তা শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন---‘‘সাহিত্য সেবা ও কল্যাণের জন্য’’৷ সাহিত্য শব্দটির মধ্যেই হিত শব্দটি জড়িয়ে আছে৷ কিন্তু আজকের কবি সাহিত্যিক শিল্পীরা শুধু অর্থের জন্য শিল্প সৃষ্টি করে৷ অর্থ,খ্যাতি, ক্ষমতার মোহে হিতের কথাটা ভুলেই গেছেন৷

আসলে কবি সাহিত্যিক,শিল্পী, রাজনীতিবিদ,অর্থনীতিবিদ, সমাজতাত্ত্বিক সকলেই আজ পুঁজিবাদী অর্থনীতির দাস হয়ে গেছে৷  ব্যতিক্রম কিছু আছে, কিন্তু তারা আজকের সমাজে অপাংক্তেয়৷ তবু লজ্জাকর আইনের হাত থেকে মুক্তির পথ এখনো আছে৷ লজ্জাকর দাসত্বই লজ্জাকর আইনের পথ করে দিয়েছে৷ তাই লজ্জাকর আইনের হাত থেকে মুক্ত হতে গেলে পুঁজিবাদী দাসত্বের শৃঙ্খল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে হবে আগে৷ পারবেন কি? যদি পারেন সেই শুভ দিনের আশায়, নতুবা আইন এই মানসিকতার পরিবর্তন আনতে পারবে না৷ আইনে তো আছে খুন নারীনির্যাতনে কঠোর সাজা! তাতে কি সমাজে খুন নারীনির্যাতন বন্ধ হয়েছে! যদি সত্যই পিতামাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য পালনের জন্যে আইন আনতে হয় তবে এ সমাজে লজ্জা রাখার জায়গা থাকবে না৷