পত্রপত্রিকায় চোখ দিলেই দেখা যায় কন্যা সন্তান হয়ে জন্মানোর দুর্বিষহ যন্ত্রণার ছবি৷ একবিংশ শতাব্দীর দুদশক পার করেও আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নারী অভিশাপমুক্ত হলো না৷ অবশ্য তথাকথিত অভিজাত বা হাই সোসাইটির আধুনিক কন্যার কথা আলাদা৷ সাধারণ মধ্যবিত্ত সমাজে কন্যা সন্তান জন্ম দিলে নারীকে আজও নানা অত্যাচার ও নির্যাতন ভোগ করতে হয়৷
সমাজের নারীর প্রতি এই বৈষম্য মূলক আচরণের অন্যতম কারণ হলো পণপ্রথা৷ আজও সমাজে অনেক ছেলেই শ্বশুর বাড়ির টাকায় বড়লোক হওয়ার স্বপ্ণ দেখে, তাই কন্যা বিবাহ যোগ্যা হলেই দুশ্চিন্তায় পিতা মাতার ঘুম ছুটে যায়৷
সত্যি পণপ্রথা বা যৌতুক প্রথা একটি জটিল সমস্যায় পরিণত হয়েছে৷ বিয়ের সময় ছেলে বা মেয়ে পক্ষ থেকে অর্থের দাবীই পণপ্রথা৷ পণপ্রথার শিকার শুধু নারীরাই নয়, পুরুষ মানুষেরাও হয়৷ তবে নারীদের তুলনায় অনেক কম৷ যেমন বার্র্মতে বিবাহের সময় পুরুষকেই পণ দিতে হয়৷ প্রাউট প্রবক্তা মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার-এর মতে---পণপ্রথার কারণ প্রধানত দুটি ১) নারী ও পুরুষের একের উপর অন্যের অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা৷ ২) নারী ও পুরুষের সংখ্যাগত তারতম্য৷ বেশীরভাগ ক্ষেত্রে নারীদের উপযুক্তভাবে শিক্ষিত না করার ফলে তারা নিজেদের পোষণের জন্য পুরুষদের উপর নির্ভর করে থাকে৷ এই কারণে বিয়ের সময় একটা নারীর তুলনা হয় পয়সার সাথে৷ বর্তমানে ধনী পরিবারের কাছে তো মেয়ের বিয়েতে পণ দেওয়া একটা ফর্মালিটিতে পরিণত হয়েছে, যতটুকু না চাওয়া হয় তারচেয়ে বেশী দেওয়া হয়, কিন্তু ধনীদের এই ফর্মালিটি গরীবদের কাছে গলায় দড়ি হয়ে দাঁড়ায়৷ আবার কেউ কেউ প্রকাশ্যে না চাইলেও ভেতরে ভেতরে আরও বেশী চায়, সেটা মেয়ের মা বাবা বুঝতে পারে, আর তাই অনেক বেশী বেশী দেয়৷ এই ভেবে যে তাদের মেয়েকে পরের বাড়িতে গিয়ে কথা শুনতে হবে৷ বর্তমানে পণপ্রথার কারণেই হয়তো কন্যা ভ্রুন হত্যা ক্রমশঃ বেড়ে চলেছে৷ ফলে নারীদের সংখ্যা পুরুষদের থেকে অনেক কমে যাচ্ছে৷ আর এই কারণে পুরুষদের পণ দিয়ে বিয়ে করতে দেখা যায়, কিন্তু খুব কম৷ ভারতের অনেক রাজ্যে মেয়ের সংখ্যা খুবই কম, তাই ওই রাজ্যের ছেলেরা অন্যরাজ্য থেকে গরীব মেয়েদের কিনে নিয়ে যায় বিয়ে করার জন্য৷ দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন এর ভাষায় ‘‘আমাদের ছেলে মেয়েরা কি গরু ছাগল ভেড়া নাকি, যে তাদের নিয়ে দরকষাকষি চলবে৷’’ পণপ্রথা বর্তমান সামাজিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ত্রুটির একটি দিক, তেমনি আর একটি ভয়ংকর দিক হল পতিতাবৃত্তি৷ তাই অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বাধীনতা না আসা পর্যন্ত এই দুটি দিক বন্ধ হবার নয়৷ এই পণপ্রথার কারণেই কন্যা ভ্রুণ হত্যা তো চলেই, তার সাথে চলে কন্যা জন্ম দেওয়ার জন্য মায়ের উপর অকথ্য অত্যাচার৷ অথচ কন্যা বা পুত্র সন্তান জন্মের জন্য শুধুমাত্র পিতাই দায়ী মাতা নন৷ এইকথা বিজ্ঞান বলে৷ আবার কিছু কিছু ছেলেদের এমন মতামত যে, মেয়েটাকে বিয়ে করে আনলে সারা জীবন বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে হবে তাই পণ নিতে হয়৷ এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা, অথবা স্বার্থলোভ কে আড়াল করতে এমন অবান্তর যুক্তির অবতারণা করে৷ কোন মেয়েই শ্বশুর বাড়িতে বসে বসে খায় না৷ বরং প্রাণপাত পরিশ্রম করে শ্বশুরবাড়ির সুখের জন্যে৷ আসলে বিয়ের পর এটাই মেয়েদের সংসার হয়ে যায়৷ তার কাছে এটা আলাদা শ্বশুরবাড়ি মনে হয় না৷ ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে আর তা নারী পুরুষ উভয়েরই ক্ষেত্রে৷ আসলে সংসার শুধু স্বামীরও নয় স্ত্রীরও নয় ৷ উভয়ের সমান অধিকার, সমান দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধই একটি সুখী সংসার গড়ে তোলে৷ কিন্তু অনেক পুরুষই এটা বুঝতে চায় না৷ সব নারীও যে বোঝে তাও নয়৷ কিন্তু সমাজটা পুরুষতান্ত্রিক, তাই নারীকেই অত্যাচারটা বেশি সহ্য করতে হয়৷ সাবেককালে ছেলে বিয়ে করতে যাওয়ার সময় মাকে বলে যেত---তোমার জন্য দাসী আনতে যাচ্ছি৷ এই কুপ্রথা সমাজ থেকে আজও সম্পূর্ণ অবলুপ্ত হয়নি৷
আসলে নারীরা পুরুষদের কাছে কি চায়? দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার এর ভাষায় ‘‘নারীদের শারীরিক শক্তি পুরুষদের তুলনায় কম তাই নারীরা পুরুষদের কাছে নিজের সুরক্ষার দাবি করে, মাতৃ জাতি হিসাবে এতটুকু দাবি তো তারা করতেই পারে’’ কিন্তু হায় আজ নারীরা কার উপর সুরক্ষার দাবি করবে! নিজেরাই ঠিক করতে পারে না৷ যে পুরুষের কাছে নারী সুরক্ষার আবদার করবে সেই পুরুষই ভক্ষক হয়ে দাঁড়ায়৷
মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তার রচিত সমাজশাস্ত্র আনন্দমার্গে চর্র্যচর্য গ্রন্থে নারী পুরুষকে যেমন সমান অধিকার দিয়েছে, তেমনি সমান দায়িত্ব ও কর্তব্য বোধের কথাও বলেছেন৷ ‘‘নারী ও পুরুষ--- উভয়েই পরমপিতার সন্তান উভয়েই যেহেতু পরমপিতার সন্তান জীবনের অভিব্যক্তি ও স্বাধিকারের ক্ষেত্রে উভয়েরই সমান অধিকার৷
মানব ইতিহাসে আমরা দেখেছি নারীরা কেবল নারীত্বকে গৌরবান্বিত করেন নি, সমস্ত মানবজাতিকে গৌরবান্বিত করেছে৷ দর্শনে, আধ্যাত্মিকতায়, সমাজ সংস্কারে, শিক্ষার ক্ষেত্রে, বিজ্ঞানে প্রযুক্তিতে--- কোথাও নারীরা পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে নেই.......আমরা বিশেষ করে নারীদের মধ্যে সৃষ্টি করতে চাই এক বলিষ্ঠ, গতিশীল ও বৈপ্লবিক সমাজচেতনা৷ নারীরা নবপ্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে সর্বপ্রকার দাসত্বের প্রতীক ও ভাবজড়তাগুলোকে নিশ্চিহ্ণ করতে উঠে পড়ে লেগে যাক৷ আমরা চাই, নারীরা সম-মৈত্রীভিত্তিক সহযোগিতার নূতন যুগের সূচনা করুক৷ আজকের নারী-জাতি হোক নূতন বিপ্লবের অগ্রদূত৷ গৌরবজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্যে এই অভ্যুত্থান অত্যাবশ্যক৷’
তাই নারীকে শুধু পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ওপর সব দায় চাপিয়ে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না৷ শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের প্রবর্তিত পথেই নারীকেও তার কর্তব্য করতে হবে৷ আর এই কাজে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন পুরুষকেও এগিয়ে আসতে হবে৷ নারী ও পুরুষ সমাজ নামক পাখীর দুটো ডানা৷ দুটোকেই সমান সচল হতে হবে৷ তখন শুধু পণপ্রথা নয় সমাজের সকল ব্যধি দূর হয়ে যাবে৷ গড়ে উঠবে আদর্শ মানব সমাজ৷
- Log in to post comments