ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্রের অবসানের পর আজ বড় বড় রাষ্ট্র, দেশ, মহাদেশের সৃষ্টি হয়েছে৷ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগোত্রের অবসানের পর আজ বড় বড় রিলিজিয়নের সৃষ্টি হয়েছে৷ কিন্তু এখনও পর্যন্ত ‘এক পৃথিবী’ ‘এক মানবধর্ম’ ‘এক মানবসমাজ’ -এর ধারণা গড়ে উঠেনি৷ ফলে পৃথিবী নামক গ্রহে মানব প্রজাতি তার কাঙ্ক্ষিত সুখ শান্তির মধ্য দিয়ে পরমানন্দ লাভ করতে পারেনি৷ এখনও পর্যন্ত মানবসমাজ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী-গোত্রের লড়াই থেকে বেরিয়ে আসতে পারে নি৷ আজকের এই একুশ শতকের পৃথিবীতে আর্থ-সামাজিক যতগুলি সমস্যা আছে তার মূলে আছে এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রচিন্তা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী-গোত্র বিভাজন৷
কিন্তু একুশ শতকের পৃথিবী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের জন্য নয়! নয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী-গোত্রের জন্যও উপযুক্ত৷ একুশ শতকের পৃথিবী ‘এক বিশ্বরাষ্ট্র’ ‘এক মানবসমাজের’ ‘এক মানবধর্ম’-র জন্য ৷ এটাই একুশ শতকের কনসেপ্ঢ৷ আর এই নোতুন পৃথিবী ও ‘এক মাানব সমাজে’র এক মানবধর্মে-র নব ধর্মগুরুর নাম, নব দার্শনিকের নাম শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি তথা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার! আগামী বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি তাঁর জন্মতিথি৷ এটি তাই হল আনন্দপূর্ণিমা৷
এযাবৎ কাল পৃথিবীতে যত দার্শনিক মহাপুরুষ এসেছেন সকলে দেশ, কাল বা পাত্রের গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ দর্শন দিয়েছেন৷ নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠী-গোত্রের মানুষকে স্রষ্টার আশীর্বাদপুষ্ট বলে অন্যদেরকে অভিশাপ ভাজন বলেছেন৷ নির্দিষ্ট একটি ভাষাকে স্রষ্টার মুখনিঃসৃত ভাষা বলে অন্যভাষাকে অবহেলার মুখে ঠেলে দিয়েছেন৷ নির্দিষ্ট কোনো একটি সম্প্রদায়ের (যেমন, শ্রমিক শ্রেণী, কিংবা পঁুজিপতি গোষ্ঠীর) মানুষের আর্থ-সামাজিক মুক্তির কথা বলে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষকে শত্রু ভাবতে শিখিয়েছেন৷ সমগ্র মানব সমাজের জন্য যে সর্র্বনুস্যুত দর্শনের দরকার ছিল, তেমন দর্শন দেবার মতো ইতঃপূর্বে কোনো দার্শনিকের জন্ম হয়নি৷ বলতে দ্বিধা নেই শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারই প্রথম সেই দার্শনিক ! এ শুধু কথার কথা নয়, এক মানব সমাজ রচনার জন্য, এক বিশ্বরাষ্ট রচনার জন্যে মানুষের প্রয়োজনীয় সকল বিষয়ের ওপর তিনি আলোকপাত করে গেছেন৷ দর্শন দিয়েছেন৷ তাঁর সেই দর্শনের নাম প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব Progressive utilisation Theory)৷ সংক্ষেপে প্রাউট PROUT) ৷
তিনি বলেছেন, পৃথিবীর সকল সম্পদের সঠিক উপযোগ গ্রহণ ও তার যুক্তিসঙ্গত বন্টনের মধ্য দিয়েই মানুষের অভাবের পূর্তি ঘটবে আর বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে৷
আনন্দপূর্ণিমা সেই বিরাট পুরুষের জন্মতিথি৷ কিন্তু সেই বিরাট পুরুষটি এসেছিলেন নীরবে৷ চলেও গেছেন নীরবে৷ তিনি তাঁর রচিত ও সুরারোপিত ৫০১৮ টি গানের একটিতে আমাদের মনের কথা লিখে দিয়ে গেছেন, ‘‘তুমি এসেছিলে কাউকে না বলে , না জানিয়ে গেলে চলে’’, যে কথা আমরা বলতে পারতাম না৷
তাঁর এই নীরব আসা বা নীরব চলে যাওয়াটা বড় কথা নয় বড় কথা তিনি কী দিয়ে গেলেন এই একুশ শতকের নোতুন পৃথিবীর জন্য৷ কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, অর্থনীতি রাষ্ট্রনীতি, ধর্মনীতি, শিক্ষা, শিল্প, সংগীত, আধ্যাত্মিক অনুশীলন সকল বিষয়ের ওপর যুগোপযোগী দর্শন তিনি দিয়ে গেছেন৷ যদি আমরা, এই পৃথিবীর মানুষ, একুশ শতকের মানুষের মতো বাঁচতে চাই, যদি ‘এক মানবসমাজ’ রচনা করতে চাই, তা হলে প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্বের বিকল্প কিছু নেই৷
আজ বিশ্বের অনেক দেশ, দ্বীপ তাদের সমাজ ব্যবস্থায়, শিক্ষা ব্যবস্থায়, ভাষানীতিতে প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্বের প্রায়োগিক দিকটির কথা ভাবতে শুরু করেছে৷ অনেকে স্বীকার করছেন, অনেকে চুপি চুপি গ্রহণ করছেন৷ ‘‘আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির পথ ধরে বিশ্বৈকতাবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল রচনা’’-তাঁরই দর্শন৷ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার শব্দের যথাযথ প্রয়োগ, মাতৃভাষার ব্যবহার তাঁরই ভাষানীতির সুফল৷ বাংলা ভাষায় আজ বিভিন্ন সংবাদপত্র সংশোধিত বানানবিধির প্রয়োগ করছে তা তাঁরই ভাষা বিজ্ঞানের সূত্রে৷ যেমন কিছুদিন আগে পর্যন্তও দেখতাম বাংলা ভাষার আনন্দবাজার পত্রিকা লিখত, ‘পাঞ্জাব, ইদানিং ‘পঞ্জাব’ লিখছে৷ এত দিন লিখতো ‘পাকিস্থান’ এখন লিখছে ‘পাকিস্তান’, এতদিন লিখতো ‘আসাম’, এখন লিখছে ‘অসম’৷ এসবই প্রাউট প্রবক্তার ভাষাবিজ্ঞান অনুসারে৷ যদি এ কথার মধ্যে ভুল থাকে তবে তাঁরা বলুন দেখি এই পরিবর্তিত ভাষা বিধি তাঁরা কোথায় পেলেন? আর কেনই বা এতদিন লিখেননি? আজ ব্যাপকভাবে শ্রী প্রভাতরঞ্জনের ভাষা বিজ্ঞান সংক্রান্ত বইগুলি বাজারে আসার পর কেন ভাষার পরিবর্তন হলো? জানি, উত্তর নেই৷ হয় স্বীকার করতে হবে, নইলে লুকিয়ে-চুরিয়ে নিতে হবে৷ আসলে এসব থেকে এটা স্পষ্ট, শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের নতুন তত্ত্ব ছাড়া গত্যন্তর নেই৷
প্রাউট সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘‘একটা মানুষ অন্যের মুখের গ্রাস কেড়ে নেবে--- এটা তো উচিত নয়৷ সুতরাং মানুষ যাতে বিধিসম্মতভাবে তার সমস্ত সম্পদ নিজেদের মধ্যে মিলেমিশে ভাগ করে কাজে লাগাতে পারে তার একটা ব্যবস্থা দরকার ছিল--- যা এর আগে কোন মহান পুরুষ তা করেননি অথবা হয়তো তারকব্রহ্মও এর আগে করেননি ৷ এই না করার জন্য সমাজজীবনে যে অনুপপত্তি থেকে গিয়েছিল, সেই জন্যেই প্রাউট দর্শনের সৃষ্টি হয়েছে৷ প্রাউট দর্শন সৃষ্টি করা ছাড়া অন্য কোন পথ ছিল না৷’’
তিনি আরও বলেছেন, মানুষ নিজেদের প্রয়োজন বুঝে যত তাড়াতাড়ি প্রাউট দর্শনকে সমাজের কল্যাণের কাজে লাগাবে তত তাড়াতাড়ি সমাজের মঙ্গল হবে৷ যত দেরি করবে কল্যাণ তত দেরিতে আসবে৷
সেই বিরাট মনীষী শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী জন্মতিথি আনন্দপূর্ণিমার শুভলগ্ণে তাঁর শ্রীচরণে প্রণতি জানাই
- Log in to post comments