পূর্ব প্রকাশিতের পর
পরিবেশনায় আনন্দ থাকলে তা রসস্বাদ্য হয়৷ দরদী লেখকের সৃষ্টি পাঠকের মর্মে আবেদন সৃষ্টি করে৷ মানবিকভাব থাকলে সুষ্ঠু পরিবেশনা সম্ভব হয়৷ সাহিত্যে মানুষের সুখ দুঃখ, অন্তর্বেদনা ঘাত–প্রতিঘাত প্রভৃতি মার্মিক অভিব্যক্তি থাকলে তা পাঠক সমাজে আদৃত হবে৷ পতিতা, দস্যু প্রভৃতির জীবন চিত্র আঁকতে তাদের প্রতি যেন ঘৃণা বা রোষ প্রদর্শিত না হয়, তাদের প্রতি ব্যথা মিশ্রিত সহানুভূতি জাগানো বাঞ্ছনীয়৷ সংস্কার মুক্ত মন নিয়ে, অপক্ষপাত দৃষ্টি নিয়ে এই সব মানুষের কথা বলতে হবে৷ প্রাদেশিকতা, সাম্প্রদায়িকতা জাতীয়তাবাদের আবেগ যেন সৃষ্টিকে ঢেকে না ফেলে৷ শ্লীলতা বা অশ্লীলতার বিতর্কে লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে৷ স্পৃর্শ্যাস্পৃশ্যবোধ থাকলে অগ্রগতি ব্যহত হতে বাধ্য৷ দক্ষিণপন্থী নীচু তলার কথা বলে না, বামপন্থী কেবল সমাজের নোঙরা দিক খুঁজে বেডায়৷ শুচিবায়ূগ্রস্ত হলে অপক্ষপাত ভাবনা থেকে বিচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে৷ আর নোঙ রা জীবনচর্চা খুঁজে বেডালে শিল্পের মূল আর্দশ থেকে ভ্রষ্ট হতে হয়৷ শিল্প ও সাহিত্য সাধনায় দরদী মনের ছাপ থাকা বাঞ্ছনীয়৷ অপাংক্তেয়দের সামনের সারিতে টেনে আনতে হয়৷ শুধু প্রেমের প্যান প্যানানী ছাডা কি অন্য বিষয় নেই অন্য বিষয় নেই? শিল্পী ও সাহিত্যিক বস্তুজগত থেকে ইন্দ্রিয়াতীত এক অতিন্দ্রীয় জগতে আমাদের পৌঁছে দেন৷ তবে তিনি বাস্তবকে অস্বীকার করে সাহিত্য চর্চার ব্যর্থ প্রয়াসকে সমর্থন করেননি৷ রবীন্দ্র সাহিত্যের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বাস্তব জীবনছবি আঁকার অনুকূলে মত দিয়েছেন–
যদি হেথায় বকুল তরুর ছায়ে
মিলন ঘটে তরুণ তরুণীতে
দুটি আঁখির পরে দুটি আঁখি,
মিলিতে চায় দুরন্ত সঙ্গীতে৷
কে তাহাদের মনের কথা লয়ে’
বীণার তারে তুলবে প্রতিধবনি,
আমি যদি ভবের কূলে বসে’
পরকালের ভালো মচ্ঞই গণি৷
সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা সম্পর্কে আনন্দমূর্তিজীর সম্যক ধারনা শুধু নয়, আছে ঋদ্ধ জ্ঞান৷ এই সব সাহিত্যের আলোচনায় তাঁর বিশ্লেষণী মনন, সূক্ষ্ম দৃষ্টি ভঙ্গি ও রসস্বাদী চেতনার পরিচয় মেলে৷ মঞ্চ সার্থক ও রস সমৃদ্ধ নাটক দুটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন৷ যুগের সমস্যা, নাচ গান হৈহজ্ঝা হাসি তামাসা, কুশীলবের ব্যথা বেদনা ফোটালে তা মঞ্চ সার্থক নাটক হবে বলে তিনি অভিমত পোষণ করেন৷ যুগ সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা থাকলে তবে যুগকে নাটকে ফোটানো সম্ভব৷ জনসাধারণের চাহিদার সঙ্গে লেখকের মুন্সিয়ানা সংযুক্তি ঘটলে তা মঞ্চ সফল হতে পারে৷ তাঁর মতে রবীন্দ্র নাটক /যুগের দাবীকে উপেক্ষা না করেও যুগের পরিধির মধ্যে থাকতে চেয়েছে আর এই জন্যেই তাঁর নাটক মঞ্চে জনপ্রিয় হতে পারেনি, কিন্তু শিল্পরসিক বা কলারসিকের কাছে তা অকুণ্ঠ সমাদর পেয়েছে৷ এমত রবীন্দ্রনাথের সব নাটক সম্বন্ধে প্রয়োজ্য নয়৷ ‘বিসর্জন’, ‘রাজা ও রাণী’ জনপ্রিয়তার সঙ্গে অভিনীত হয়েছে৷ একদা ‘ডাকঘর’ বহুবার সাফল্যের সঙ্গে অভিনীত হয়৷ এ যুগের শম্ভুমিত্রের পরিচালনায় ‘রক্তকরবী’র সার্থক অভিনয় সাফল্য ঈর্ষণীয় বিষয় বলে চিহ্ণিত৷ আসলে রবীন্দ্র নাটকের রূপক সাংকেতিকতার আবরণ উন্ন্দোচন ও তার রসোদ্ধারের লোক খুব কম৷ সেই বোদ্ধা কুশীলব ও শ্রোতা ও দর্শকের জন্য অপেক্ষা করতে হবে৷
নাটকে গানের একটা ভুমিকা আছে৷ গানে বিলাপ গাথা প্রকাশ সহজ সাধ্য হয়৷ গান ব্যবহারে সংযম থাকা উচিত৷ বহুল ব্যবহারে নাটকের পরিবেশ শিথিল হয়৷ ক্ষুদ্র পরিসরের একাঙ্ক বা ছোটো নাটকে চারিত্রিক সংঘাত ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয় না৷ আনন্দমূর্তির মতে ‘‘ক্রাইম ড্রামার সার্থকতা সাসপেন্স সৃষ্টির ওপরে অনেকখানি নির্ভর করে৷* জীবন্ত চরিত্রের আত্মপ্রকাশ নাটকে থাকতেই হবে৷
ছোটো গল্প সম্পর্কে আনন্দমূর্তিজীর অভিমত–‘গুছিয়ে গল্প বলাটা বড কথা নয়, তার সঙ্গে সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ তথা চরিত্র সংঘাতগুলিও যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলতে হয়৷ তিনি নভেল বা উপন্যাসকে কথান্যাস’ নামে চিহ্ণিত করেছেন৷
‘মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতী সমা
যৎক্রৌঞ্চক্রৌঞ্চী মিথুনাদেবমবধী কামমোহিতম৷’
বঙ্গানুবাদ ঃ হে ব্যাধ৷ তুমি কোনোদিনই প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারবে না, যেহেতু এক ক্রৌঞ্চ ক্রৌঞ্চীকে মৈথুন সুখ থেকে বিচ্যুত করেছ৷
ক্রৌঞ্চ–ক্রৌঞ্চীর মিথুনকালে ব্যাধের শরাঘাতে ক্রৌঞ্চের মৃত্যু ঘটে৷ এই অভাবিত মৃত্যু, ক্রৌঞ্চীর প্রিয় বিরহ ও বুক ফাটা আর্তনাদ অবলোকন করে দস্যু রত্নাকরের ঙ্মবাল্ন্দীকিক্ষ মুখ থেকে এই শোকরূপ শ্লোক স্বর্তস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে আসে, কবিতার জন্ন্দ হয়৷ বাঙালির হৃদয়তন্ত্রী কাব্য ও গানের সুরে বাঁধা৷ ‘চর্যাচর্য বিন্ছিয়’ তার প্রকৃষ্ট নির্দশন৷ যুগ পরম্পরায় কাব্য কবিতা বাঙালির হাতে আরো পূর্ণতার পথে এগিয়ে চলেছে৷ গীতাঞ্জলি কাব্যে নোবেল পুরষ্কার তা প্রমাণিত করে৷ আনন্দমূর্তিজী মর্মশ্রয়ী কবিতার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন৷ তাঁর মতে ‘কাব্য সাহিত্যে মূল সুরটি হে২৬ মর্মাশ্রয়ী৷’ কবিতার গতি প্রকৃতি, তার বিষয় ও ঢং কেমন হবে তিনি তার প্রতি দিশা নির্দেশ করেছেন–কবিতায় তাকে মর্মের রঙে রাঙিয়ে ফুটিয়ে তুলতে হয়, অজানা র ইঙ্গিত দিতে হয়–/দূরাগতের সঙ্গে অনাগতের গতি–ধম্ সম্পর্কটুকু হৃদয়বেত্তার সাহায্যে বুঝে নিতে বলা হয়৷ কাব্য তাই কাণে শুণে বোঝা যায় না, কবির মর্মে মর্মে ছুইয়ে বুঝতে হয়৷*
কবিতাকার বা কবিদের সৃষ্ট কাব্যের ভবিষ্যত সম্পর্কে কবি আশার বাণী শোনাতে পারেননি৷ কবিতা সাহিত্যও ধবংস প্রায়৷ কবিতার বই কেউ পয়সা খরচ করে কিনে পডে না৷ এই প্রসঙ্গে আনন্দমূর্তিজী গানের কথায় এসেছেন ও মন্তব্য করেছেন–/গীতিকারদের দৈন্য এখন আর ততটা নয় কারণ সিনেমা, রেডিও, গ্রামোফোন ও রঙ্গালয়ের দওলতে গানের বাজার এখনও আছে ও আশা করা যায় থাকবে*৷ ভবিষ্যৎ দ্রষ্টার কলমে এক বেদনার সুর ধবনিত হয় ‘ভার সম্পদের দিক থেকে আধুনিক গান ক্রমশঃ যেন দেউলে হয়ে চলেছে৷’ কথাটা সর্বৈব সত্য বলে মনে করি৷ বাংলা গানের ঐতিহ্য আমরা হারাতে বসেছি৷ হিন্দী গানের অনুকরণে আমরা নিজস্ব ভাব ও ভাষা ও সুর ঝংকার ভুলতে বসেছি৷ প্রবন্ধ, রসরচনা রম্যরচনা প্রভৃতির সাহিত্য তাঁর আলোচনায় সমৃদ্ধির হদিশ পায়৷ বলাই বাহুল্য তাঁর আলোচনা গঠন মূলক সমালোচনা৷ শিশু সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর ঋদ্ধ মন্তব্য শাখাটিকে উন্নীত করার দিশা দেয়–/অজানাকে জানবার যে ঐকান্তিক আগ্রহ শিশুমনে থাকেহ্ল, তার চরমপূর্তি ঘটিয়ে দিতে হবে রঙ–বেরঙের রূপকথার মায়ালোকের ছবি এঁকে৷ বাস্তব এখানে বড কথা নয়, বড কথা হ’ল শিশুমনকে আনন্দস্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া, আর তারই মাঝে মাঝে খুব সহজভাবে দুনিয়াটাকে চিনিয়ে দেওয়া৷*
- Log in to post comments