প্রাউট প্রসঙ্গে প্রবচন (১)

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

জ্ঞান দুই ধরনের –– ৰুদ্ধি সঞ্জাত জ্ঞান ও ঐশ্বরীয় অনুভূতি সঞ্জাত জ্ঞান৷ ক্ষৌদ্ধিক জ্ঞান যেহেতু অভিজ্ঞতা সঞ্জাত সেহেতু তা আপেক্ষিকতার দোষে দুষ্ট৷ সেইজন্যেই ক্ষৌদ্ধিক জ্ঞানকে চরম জ্ঞানের দাবীদার বলা চলে না৷ ঐশ্বরীয় অনুভূতি সঞ্জাত জ্ঞানই চেতনাসম্পৃক্ত৷ এই জ্ঞানই সমস্ত কিছুকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে সমর্থ –– তাই ঐশ্বরীয় অনুভূতি সঞ্জাত জ্ঞানই চরমজ্ঞান৷

বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে’ বিষয়ীর দিকে লক্ষ্য রেখে এগিয়ে যাওয়াই প্রাউটের পথ৷ এই পথই ক্ষৌদ্ধিক জ্ঞান ও ঐশ্বরীয় অনুভূতি সঞ্জাত জ্ঞানের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের পথ৷ এই দুই জ্ঞানের স্পর্শ বিন্দু বা মিলন স্থলই ক্ষোধিজ্ঞান৷ ক্ষোধিজ্ঞানের সাহায্যে ঐশ্বরীয় অনুভূতি সঞ্জাত জ্ঞানকে আমরা জাগতিক সমস্যার সমাধানে ব্যবহার করতে পারি৷ তাই প্রাউটও ক্ষোধিজ্ঞান৷

যুক্তি হচ্ছে এক ধরনের মানসিক জরিপ৷ এই জরিপ নিখঁুত হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে৷ সেজন্যে অন্ধভাবে যুক্তিকে মেনে চলা উচিত নয়৷ তোমার মানসিক জরিপই তোমার বিচার বিবেচনা৷ যেহেতু এই মানসিক জরিপ আপেক্ষিকতার দোষে দুষ্ট সেহেতু তাতে খঁুত থাকতেও পারে৷ ঐশ্বরীয় অনুভূতি সঞ্জাত জ্ঞানই সর্বোত্তম যুক্তি৷ তাই ঐশ্বরীয় অনুভূতি সঞ্জাত জ্ঞানই আদর্শ দিশারী হওয়ার অধিকারী৷ উদাহরণস্বরূপ, সবকিছুই পরম পিতা থেকে এসেছে আর শেষ পর্যন্ত সবকিছুই পরম পিতাতেই লীন হয়ে যাবে –– এটা স্বতঃসিদ্ধ সত্য৷ কিন্তু এই সত্য ক্ষৌদ্ধিক যুক্তির ধরা ছোঁয়ার বাইরে৷

পুঁজিবাদ

পঁুজিবাদ কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল? ভোগ্যপণ্যের অন্তর্নিহিত সুপ্ত শক্তিই পুঁজি৷ ৰুদ্ধিমান লোকেরা ভোগ্যপণ্যরূপে অন্যদের থেকে বেশী পুঁজি সংগ্রহ করে৷ কিন্তু যেহেতু ভোগ্যপণ্য বেশী দিন ধরে’ জমিয়ে রাখা যায় না, সেইজন্যে তারা পুঁজি হিসেবে জমাতে থাকে অর্থ৷ এদেরই বলে পুঁজিবাদী৷ যেহেতু এই পুঁজিবাদীরা ‘ভূমা–উত্তরাধিকার’ তত্ত্বের বিরোধী তাই এরা পরমপিতার অধম সন্তান৷ তাদের এই রোগ সারাবার ব্যবস্থা করতে হবে৷ পুঁজিবাদের বিরোধিতা করা তাই প্রাউটের অন্যতম লক্ষ্য৷ অনন্ত অভিব্যক্তির ক্ষীজ ধর্মের মধ্যেই নিহিত, কিন্তু সেজন্যে তোমাকে সচেষ্ট হতে হবে৷ পুঁজিবাদীরা মানুষকে পরম চৈতন্যের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করে’ তাদের মহান হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়৷ সেজন্যে পুঁজিবাদ ধর্মবিরোধী আর সেজন্যে পুঁজিবাদীদের কার্যকলাপও ধর্মবিরোধী৷ পুঁজিবাদীদের এই আচরণ সংশোধনের উপায় কী? নীতিবাদের অধিক্ষেত্রে দু’টি শক্তি পাশাপাশি কাজ করে –– অভ্যন্তরীণ আকুতি ও বাহ্যিক চাপ৷ বিশ্বের প্রত্যেকটি বস্তুরই নিজস্ব শক্তি রয়েছে৷ সেই শক্তি অনন্ত অভিস্ফূরণের পথ খোঁজে৷ আত্মা তথা সাক্ষীসত্তা অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্যে প্রয়োজনীয় শক্তির যোগান দেয়৷ আর অভ্যন্তরীণ আকুতির বিরুদ্ধে অশুভ শক্তির কার্যকলাপকে নিষ্ক্রিয় করতে প্রচণ্ড বাহ্যিক চাপ প্রয়োগ করতে হয়৷ বাহ্যিক চাপের নানা পদ্ধতির মধ্যে পড়ে অভিভাবন, উপদেশ, শাস্তি ও সংঘর্ষ৷ পুঁজিবাদীরা দুর্নীতিগ্রস্ত ও ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে লিপ্ত৷ যেহেতু তাদের অভ্যন্তরীণ আকুতি খুবই নগন্য ও নিষ্ক্রিয়, সেহেতু তাদের স্বভাব সংশোধনের উদ্দেশ্যে তাদের বিরুদ্ধে শক্তি সম্প্রয়োগ করতেই হবে৷ সুন্দর সুন্দর বাক্য বিন্যাস সমম্বিত উপদেশ কার্যকরী হবে না৷

মানুষের অভিব্যক্তি ত্রিস্তরীয়৷ মানুষ অনন্ত পরিমাণে জাগতিক সুখ ভোগ করতে চায়৷ কিন্তু তার সেই অনন্ত আকাঙক্ষা অতৃপ্তই থেকে যায়৷ জাগতিক সুখ ভোগের এই অনন্ত আকাঙক্ষাই পুঁজিবাদের জন্ম দিয়েছে৷ পুজিবাদীরা দিনরাত অর্থচিন্তায় নিমগ্ণ থাকে৷ জাগতিক সুখ ভোগের অনন্ত আকাঙক্ষা স্বাভাবিক মনে হলেও, যেহেতু জাগতিক সম্পদ অনন্ত নয় সেহেতু সীমিত জাগতিক সম্পদের মধ্যে অনন্ত আকাঙক্ষা পূরণের ইচ্ছা এক ধরনের মানসিক রোগ৷ মানুষের অনন্ত মানসিক ভোগের আকাঙক্ষাও অতৃপ্ত থেকে যায়৷ অতিরিক্ত মানসিক ভোগের আকাঙক্ষা এক ধরনের মনোবিকৃতি নিয়ে আসে –– মানুষ অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে৷ জড় জগতের সঙ্গে সম্পর্কিত মানসিক আকাঙক্ষার বিষয়সমূহ সীমিত৷ কিন্তু বিশুদ্ধ মানসিক বিষয় অসীম৷ তোমাদের মানস দেহ আর জড় জাগতিক চাহিদা সমূহ সর্বদাই পৃথক৷ আর এখান থেকেই দোলাচলটা শুরু হয়৷ কিন্তু আধ্যাত্মিক লক্ষ্যে পৌঁছতে পারলেই আত্মা ও ভোগ্য বস্তুর মধ্যেকার দূরত্ব দূরীভূত হয়৷ আর এই অবস্থাতেই অনুভূত হয় প্রকৃত শান্তি৷ একটু আগে যে মানসিক রোগের কথা বলেছি সেই রোগের কারণেই অন্যের সঙ্গে সংঘাত হয়, ও তা বহু সময়ে মানুষকে নিঃস্ব করে’ দেয়৷ ভ্রাতৃঘাতী এই সংঘাত থেকে দূরে থাকার উদ্দেশ্যে, ও মানবাধিকারকে সুরক্ষিত করতে আমাদের জাগতিক ভোগের আকাঙক্ষাকে মানসিক ও আধ্যাত্মিক ভোগের আকাঙক্ষায় রূপান্তরিত করতে হবে৷

পুরাকালে প্রতাপশালী রাজা ও মহারাজারা নিজেদের বীরত্ব জাহির করার উদ্দেশ্যে যজ্ঞ করতো বা পশুবলি দিত৷ আসলে এও ছিল এক ধরনের শোষণ৷ তারা যে বহু মন্দির নির্মাণ করতো তা আসলে তাদের ভক্তি প্রসূত ছিল না –– উদ্দেশ্য ছিল তাদের দুষ্ক্র্মকে আড়াল করা৷ জাগতিক জগতের শোষকদের সঙ্গে মানসিক জগতের শোষকদের মধ্যে একটা অপবিত্র বোঝাপড়া ছিল৷ ৰুদ্ধিজীবীরা সর্বকালেই এই রাজা–মহারাজাদের স্তূতি করে’ এসেছে৷ পুঁজিবাদের আর একটা রূপ হচ্ছে পুরোহিত প্রথা৷ পুঁজিবাদীরা কখনওই পুরোহিত প্রথার বিরোধিতা করবে না, পুরোহিতরাও কখনও পুঁজিবাদীদের বিরোধিতা করবে না৷ জনসাধারণের মনে হীনম্মন্যতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ক্ষ্রাহ্মণরা বহু গল্প ও পুরাণ তৈরী করেছে৷ শোষণের উদ্দেশ্যে সাধারণ মানুষের ভাবপ্রবণতাকে উস্কে দিতে এই সমস্ত অযৌক্তিক ও সাজানো গল্প ফাঁদা হয়েছে৷ সুবিধাবাদী শয়তানদের সৃষ্ট এ ধরনের জাজ্বল্যমান উদাহরণ হচ্ছে –

‘‘ক্ষ্রাহ্মণস্য মুখমাসীত বাহুরাজন্যোভবৎ

মধ্যতদস্য যদ্বৈশ্যঃ পদ্ভ্যাম্ শূদ্রজায়ত৷৷

ব্রাহ্মণরা মুখ থেকে সৃষ্ট হয়েছে৷ ক্ষত্রিয়গণ সৃষ্ট হয়েছে বাহু থেকে৷ বৈশ্যরা সৃষ্ট হয়েছে দেহ থেকে, আর পদযুগল থেকে শূদ্ররা সৃষ্ট হয়েছে৷

পুঁজিবাদী কাঠামোয় মুনাফার মনোভাবের দ্বারা শিল্প তথা উৎপাদন পরিচালিত হয়৷ কিন্তু প্রাউট ব্যবস্থায় উপযুক্ত সদব্যবহারের উদ্দেশ্যেই উৎপাদন হবে৷