প্রাউট প্রসঙ্গে প্রবচন (৫)

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

বিশ্বরাষ্ট্র

বিশ্বৈকতাবাদের ধারণাকে বাস্তবে রূপ দিতে বিশ্বরাষ্ট্র গড়তেই হবে৷ বিশ্বের সমস্ত যুক্তরাষ্ট্রের সমাহারে এই বিশ্বরাষ্ট্র গড়তে হবে৷ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক সামঞ্জস্যের দিকে লক্ষ্য রেখে স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক–র্থনৈতিক অঞ্চলের ব্ভুন্ব্ধগ্গ সমাহারে গড়ে’ তুলতে হবে যুক্তরাষ্ট্র সমূহ৷ অর্থনীতিতে অবনত অঞ্চলকে শোষণ করা অর্থনীতিতে উন্নত অঞ্চলের স্বাভাবিক প্রবণতা৷ এই জন্যে বিভিন্ন স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক–র্থনৈতিক অঞ্চলের ব্ভুন্ব্ধ–এর) সমাহারে যুক্তরাষ্ট্র তৈরী করতে হবে৷ উদাহরণস্বরূপ ভারতের অন্তর্গত বিদর্ভ অঞ্চলের মানুষ মারাঠীভাষী হলেও মহারাষ্ট্রের মধ্যে না থেকে একটা নিজস্ব রাজ্যের দাবী করে৷ আর একটা গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হচ্ছে পারস্যের (ইরানের) আজারবাইজান অঞ্চল (তৎকালীন) সোভিয়েতের আজারবাইজান অঞ্চলের সঙ্গে মিলিত হয়ে তাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে সুনিশ্চিত করতে চায়৷ এইভাবে যে সমস্ত অঞ্চল ব্ভুন্ব্ধগ্গ তৈরী হবে শাসন কার্যের সুবিধার্থে তাদের নাম বা সংজ্ঞার পরিবর্ত্তন হতে পারে৷ এই সমস্ত অঞ্চল ব্ভুন্ব্ধগ্গ গুলির মধ্যে কিছু সাধারণ মিল থাকে, আর সেই মিলের ভিত্তিতেই যুক্তরাষ্ট্র তৈরী করতে হবে৷

বিশ্বরাষ্ট্র প্রথমদিকে হবে কেবল একটি আইন প্রণয়নকারী সংস্থা৷ বিশ্বরাষ্ট্র প্রণীত সেই আইন সমূহকে কার্যকরী করবে বিভিন্ন যুক্তরাষ্ট্র৷ যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা থাকবে সেই আইন সমূহ কার্যকরী করা বা না করার, তবে কখনই সেই আইনের বিরুদ্ধাচরণ করবে না৷ আন্তর্যুক্তরাষ্ট্রীয় শান্তি বজায় রাখা ও আন্তর্গ্রহবিবাদের নিষ্পত্তির জন্যে সীমিত অথচ বিশেষভাবে নির্ধারিত ক্ষমতা বিশ্বরাষ্ট্রের থাকবে৷ অর্থাৎ বিশ্বরাষ্ট্রের অধীনেই বিশ্ব সেনা থাকবে৷ অভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক–র্থনৈতিক অঞ্চলসমূহ পুলিশের ব্যবস্থা রাখবে৷

স্বয়ংসম্পূর্ণ অঞ্চলগুলিতে সদবিপ্র বোর্ড থাকবে৷ এই বোর্ডগুলি মিলিতভাবে আবার একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় বোর্ড গড়ে নেবে৷ যুক্তরাষ্ট্রীয় বোর্ডই যুক্তরাষ্ট্রের শাসন পরিচালনা করবে৷ এই বোর্ডগুলির সমাহারেই বিশ্বরাষ্ট্রীয় বোর্ড গড়ে উঠবে৷ এই সংস্থাই সার্বিক ভাবে বিশ্বরাষ্ট্রের পরিচালনা করবে কিন্তু কখনই কোন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করবে না৷

ভাষা

মানব সমাজে ভাষা সমস্যা এক পুরাতন ব্যাধির আকার ধারণ করেছে৷ ভাষা সম্পর্কিত অজ্ঞতা সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে৷ ভাষা ভাবপ্রকাশের মাধ্যম৷ ছ’টি ধাপে ভাব প্রকাশিত হয়৷ ভাব যেখানে ক্ষীজাকারে থাকে তাকে বলে পরাশক্তি৷ এই পরাশক্তির অবস্থান মূলাধার চক্রে৷ স্বাধিষ্ঠান চক্রে এসে সেই ভাব মানসিক ভাবে বোধগম্য হয়৷ এই যে ক্ষীজ থেকে অঙ্কুরিত ভাবটি মনে মনে দেখা –– একে বলে পশ্যন্তি শক্তি৷ মণিপুর চক্রে এসে সেই মানসিক ৰোধগম্যতা মানস–ধ্বনিতে রূপান্তরিত হয় –– একে বলে মধ্যমা শক্তি৷ এবার মানুষ সেই মানস–ধবনিকে ভাষায় রূপ দেবার জন্যে সচেষ্ট হয়৷ মানসিক অনুভূতিকে অভিপ্রকাশিত করার এই প্রচেষ্টার নাম দ্যোতমানা শক্তি৷ নাভি ও কণ্ঠের মধ্যে এই শক্তি ক্রিয়াশীলা৷ কণ্ঠে এসে ভাব ভাষায় রূপান্তরিত হয় –– একে বলে বৈখরী শক্তি৷ বৈখরীর পরে তা বাস্তবের কথ্য ভাষার রূপ পায়, আর তাকে বলে শ্রুতিগোচরা৷ অর্থাৎ বিভিন্ন ভাষার মধ্যে যে পার্থক্য আমরা লক্ষ্য করি তা কেবল অভিপ্রকাশের ষষ্ঠ স্তরে সৃষ্টি হয়৷ প্রথম পাঁচটি স্তরে অভিপ্রকাশের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই৷ ভাষাতাত্ত্বিকদের ও ভাষা সমস্যা সৃষ্টিকারী শয়তানদের যদি এই প্রকৃত সত্য জানা থাকতো তাহলে ভাষা নিয়ে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যেকার কোন্দলের অনেকটাই সমাধান করা যেত৷ এককথায়, এ সম্পর্কিত অজ্ঞতার কারণেই মানব সমাজ গুমরে মরছে৷

বিভিন্ন ভাষা সৃষ্টি করে’ প্রকৃতি যেন মহাপাপ করে’ ফেলেছে৷ কিন্তু প্রকৃতিকেও দোষ দেওয়া যায় না, কারণ তার অমোঘ নিয়মেই সে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে’ চলে৷ সভ্যতার আদিম অবস্থায় অবনত মানুষ অঙ্গভঙ্গি করে’ তাদের মনের ভাব ৰোঝাতো৷ আর এমন সময় আসবে যখন কোন ভাষা থাকবে না৷ বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ আবার নোতুন ধরনের অঙ্গভঙ্গি শিখে নেবে৷ আর মৌন থেকে যে শক্তি সঞ্চয় করবে সেই সঞ্চিত শক্তিকে তারা উন্নততর উদ্দেশ্যে লাগাবার চিন্তা করবে৷

ক্ষুদ্ধিমান মানুষ সকলের ব্যবহারের উপযুক্ত একটা বিশ্বভাষা তৈরী করে’ নেবে৷ এ ব্যাপারে তারা হীন ও ভ্রান্ত ভাবধারার বশবর্ত্তী হবে না৷ সমস্ত জাগতিক সম্পদের মত ভাষাসমূহও পরমপুরুষ থেকে প্রাপ্ত আমাদের সকলকার পৈত্রিক সম্পত্তি৷ কোন ভাষাকে ঘৃণা করার অধিকার আমাদের নেই, সমস্ত ভাষাকেই ভালোবাসতে হবে, ও এই ভাষাগুলির মধ্যেই একটিকে বিশ্বভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে৷ যেহেতু সমস্ত ভাষাই আমাদের সকলের মিলিত সম্পত্তি সেহেতু কোন ভাষারই অস্তিত্বের বিরোধিতা আমাদের করা উচিত নয়৷ কোন ভাষাকেই বিজাতীয় বা জাতীয় হিসেবে চিহ্ণিত করাও উচিত নয়৷

বর্তমানে ইংরাজী ভাষাকেই বিশ্বভাষা করা উচিত, কারণ ভাষাটি বিজ্ঞানসম্মত ও ব্যাপক অঞ্চলে ব্যবহূত৷ যে কোন সরকারেরই একে অস্বীকার করা অন্যায় হবে৷ সময়ের পরিবর্তনে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অন্য কোন ভাষাকেও বিশ্বভাষা করতে পারে৷ এইভাবে আমরা একটা সাধারণ যোগাযোগ রক্ষাকারী ভাষা ব্যবহার করে’ বিভিন্ন ভাষাভাষীর মধ্যে ভাবের আদানপ্রদান করতে পারি৷ সেজন্যেই আগামী কিছুকালের জন্যে ইংরাজী ভাষাকেই আমরা যোগাযোগ রক্ষাকারী বিশ্বভাষার স্বীকৃতি দিতে পারি৷ সেই সঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বিশ্বের সমস্ত ভাষাই আমাার ভাষা৷ কোন ভাষাকেই দেশীয়, বিদেশীয় বা জাতীয় ভাষা হিসেবে দেখা চলবে না৷ সেই সঙ্গে বিশ্বভাষাকেও বিদেশী ভাষা ভাবা উচিত হবে না, বা তার প্রচার–প্রসারকে নিরুৎসাহিত করা চলবে না৷

লিপি

বর্তমান বিশ্বে চার ধরনের লিপি রয়েছে –– আর্যভারতীয়, সমিতীয়, পাশ্চাত্য ও চীন–মঙ্গোলীয় লিপি৷ চীন–মঙ্গোলীয় লিপিগুলি ছবির মত দেখতে৷ সমস্ত অক্ষরগুলিই যেন এক–একটি ছবি৷ এরকম ১০৫৫টি অক্ষর রয়েছে৷ পাশ্চাত্য লিপিতে অক্ষরের সংক্ষা ২০ থেকে ৩৫টি৷ আর্য–ভারতীয় লিপির অক্ষর সংখ্যা ৫০টির মত৷ আর সমিতীয় লিপিতে অক্ষরের সংখ্যা ২০ থেকে ৩০টির মত৷

চীন ও জাপান যে চীন–মঙ্গোলীয় লিপিকে রোমক লিপিতে লেখবার চেষ্টা করছে তা বিজ্ঞানসম্মত নয়৷ আরবী, ফার্সী, ঊর্দু, সিন্ধী, কাশ্মীরী প্রভৃতি সমিতীয়  ঙ্মসেমিটিকক্ষ লিপি, আর এগুলো লেখা হয় ডান থেকে বাঁ দিকে৷ এই লিপি লেখা বেশ কষ্টকর, আর ছাপতে অনেক সময় লাগে৷ এই অসুবিধা থেকে রেহাই পেতে মালয় আর আরবি ভাষীরা রোমান লিপি গ্রহণ করেছে৷

তিব্বত ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার লিপিসমূহ আর্য–ভারতীয় লিপির অন্তর্গত৷ এই লিপিগুলি বেশ ভাল, তবে যুক্তাক্ষরের ক্ষেত্রে কিছুটা অসুবিধে দেখা দেয়৷  বৈবহারিক দিক দিয়ে লক্ষ্য করা গেছে রোমান লিপি সর্বাপেক্ষা ভাল৷ এই লিপি খুবই বিজ্ঞানসম্মত৷ স্থানীয় ভাবাবেগের বশবর্ত্তী হয়েই কেউ কেউ এই লিপির বিরোধিতা করে৷ প্রাউটিষ্টরা কোন ধরনের লিপিরই বিরোধিতা করবে না, পাশাপাশি কোন একটি বিজ্ঞানসম্মত লিপিকে বিশ্বলিপি হিসেবে মেনে নেওয়ার জন্যে বিশ্বজনমতকে উৎসাহিত করবে৷ বর্তমানে রোমান লিপিই সর্বাপেক্ষা বিজ্ঞানসম্মত লিপি৷ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এর থেকেও বেশী বিজ্ঞানসম্মত লিপি আবিষ্কার করলে সেটাই হবে বিশ্বলিপি৷