প্রাউটের বাস্তব রূপায়নে প্রয়োজন সকলের সদিচ্ছা, সহযোগিতা ও সদ্‌বিপ্রের নেতৃত্ব

লেখক
প্রফুল্ল মাহাত

আজ বিশ্বের দিকে দিকে শোণা যায় উদাত্ত কন্ঠের স্লোগান--- ‘‘প্রাউট, প্রাউট, প্রাউট চাই, প্রাউট নিয়ে বাঁচতে চাই৷’’ হ্যাঁ, সত্যিই তো মানুষের বাঁচার জন্য  মহান দার্শনিক ও সমাজগুরু  শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার প্রবর্ত্তিত প্রাউটের   বাস্তব রূপায়ণ ছাড়া  মানব জাতির  বাঁচার অন্যকোন বিকল্প পথ নেই৷ তাই প্রাউটই হচ্ছে মানব জাতির স্বমহিমায় বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়৷ তাই তো প্রাউট সম্বন্ধে বহু পর্যালোচনা সমীক্ষা ও গবেষণা হয়ে চলেছে৷ আর সকলে দ্বিধাহীনভাবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, বর্তমান বিশ্বে প্রাউটই  হচ্ছে মানবজাতির  একমাত্র জিওন কাঠি৷ প্রাউট প্রবক্তা শ্রীসরকার তো সুষ্পষ্টভাবে প্রাউট দর্শনের নীতি আদর্শ ও নির্দেশনা বিশদভাবে আলোচনা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন ও এগুলির বাস্তব রূপায়ণের জন্য সুবিস্তৃত ব্যাখা দিয়েছেন বিভিন্নগ্রন্থে ও বিভিন্ন প্রবচনের মাধ্যমে আলোকপাত করেছেন৷

 প্রাউট দর্শনের বাস্তব রূপায়ণের একান্ত প্রয়োজনীয়তার কথা না হয় অবিসংবাদিতভাবে স্বীকৃত বুঝলাম, উপলদ্ধি করলাম৷ কিন্তু  এখন প্রশ্ণ হচ্ছে কে বা কারা এই প্রাউট নামক সামাজিক, অর্থনৈতিক অভ্রান্ত দর্শনের রূপকার হবেন? কে বা কারা বাস্তবের অমসৃণ মাটিতে এর বাস্তব রূপদান করে আদর্শ, উন্নত মানব সমাজ ও সভ্যতার পত্তন করবে? এ প্রশ্ণের সুষ্পষ্ট উত্তর হলো, সকলের আন্তরিক সদিচ্ছা, সক্রিয় সহযোগিতা ও দুর্নিবার নিরলস কর্মী সদ্‌বিপ্র গোষ্ঠীর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রাউটের বাস্তব রূপায়ণ ক’রে এই দারিদ্র পীড়িত, সমস্যা জর্জরিত মানবসমাজের দুঃখ দুর্দ্দশা দূর করবে৷  এই ধরার ধূলিময় ভূমিকে স্বর্গীয় সুষমায় ও ঋদ্ধি, সিদ্ধি, সমৃদ্ধি, সুখ-শান্তি আনন্দে ভরিয়ে দিয়ে তাই একথা অনস্বীকার্য যে, সদ্‌বিপ্র সমাজই এই মহান কাজে নেতৃত্ব দিয়ে মানবজাতির অশেষ কল্যাণ সাধন করবে, যেমনভাবে মধ্যযুগে নাইট গোষ্ঠী নেতৃত্ব দিয়ে মানবজাতিকে নবজাগরণে উদ্বুদ্ধ করেছিল৷ এখন স্বভাবতই প্রশ্ণ জাগে কে বা কারা হবেন সদ্‌বিপ্র? তাঁদের কী কী গুণ ও বৈশিষ্ট থাকবে? কিভাবেই বা তাঁরা এই মহান ব্রতকে ও কাজকে সাফল্যমণ্ডিত করবেন৷ যাঁরা সদ্‌বিপ্র তাঁরাই প্রকৃত প্রাউটিষ্ট, তাঁরাই নূতন যুগের বার্র্ত্তবহ৷

এইসব প্রশ্ণের উত্তর প্রাউট প্রবক্তা শ্রীসরকার দিয়ে রেখেছেন৷ শুধু উত্তর দিয়েই ক্ষান্ত হন নি তিনি৷ তিনি সেবাব্রতী সদ্‌বিপ্র সমাজ ঘটনও করে দিয়েছেন৷ তাই তো  দেখি, হাজার হাজার সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনী তাঁর উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশ ও দশের কল্যাণে, মানব জাতির  সঙ্কটমোচনে ও মানবসভ্যতার উত্তরণে আত্মীয় স্বজন, পরিবার পরিজন ছেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন বিশ্বমানবতার কল্যাণ সাধনে৷ 

 এখন দেখা যাক্‌, প্রাউট প্রবক্তা শ্রী সরকার সদ্‌বিপ্রের জন্য কী কী মহৎ গুনাবলী  কী কী বিশেষ বৈশিষ্ট্য সন্নিবেশিত করেছেন ও করতে চেয়েছেন৷ এ প্রসঙ্গে তিনি অনেকগুলি গুণ ও বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন৷ তিনি বলেছেন, সদ্‌বিপ্রের মধ্যে অন্যকে কাজে উদ্বুদ্ধ করার, অনুপ্রাণিত করার গুণ থাকতে হবে৷ তাঁর কথা শুনে যেন সাধারণ মানুষ অভিষ্ট কাজে অনুপ্রাণিত হয়৷ তাছাড়া সদ্‌বিপ্রের ব্যবহার  সব সময়  মধুর, সহাস্য ও প্রাণোচ্ছল৷  তাঁর মধ্যে সাধুতা, ন্যায়পরায়ণতা, উদারতা পরহিতৈষণা থাকতে হবে৷ তাঁর মধ্যে সরলতা, ঋজুতা, কর্ত্তব্য নিষ্ঠা, দায়িত্বশীলতা প্রভৃতি মহৎগুণগুলিও থাকতে হবে৷ সদ্‌বিপ্রদের মধ্যে জ্ঞান-গরীমা, বাস্তব বুদ্ধিমত্তা, বোধি, প্রজ্ঞা থাকা আবশ্যিক৷ সদ্‌বিপ্রদের মধ্যে আধ্যাত্মিক দীপ্তি ও তেজস্বিতা থাকবে৷ তাঁর মধ্যে কর্ত্তব্যনিষ্ঠা, কর্মে দৃঢ়তা ও কর্মতৎপরতা থাকতে হবে৷ সর্র্বেপরি সদ্‌বিপ্রের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা গুণ থাকতে হবে৷ সকলে যেন তাঁর কথায় ও কাজে বিশ্বাস করতে পারে৷ তাঁর মধ্যে সাহসিকতা, নেতৃত্বদানের  ক্ষমতা সংগ্রামী মানসিকতা থাকবে৷ সকল প্রকার ভাব জড়তা, অন্ধবিশ্বাস, অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার ও সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা থাকবে হবে৷ সদ্‌বিপ্রদের মনোবিজ্ঞান সম্বন্ধে, জ্ঞান থাকা বাঞ্ছনীয়৷ তাঁর মধ্যে গতিশীলতার বৈশিষ্ট্য থাকবে৷ ‘‘চরৈবেতি’’ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে প্রগতিশীলতার দৃষ্টিভঙ্গি তার মধ্যে থাকবে৷ সুষ্পষ্ট ও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের গুন ও তাঁর থাকতে হবে৷ সর্র্বেপরি তাঁর মধ্যে সেবা ও ত্যাগের মহৎগুন অবশ্যই থাকতে হবে৷  আজকের দুর্দশাগ্রস্থ বিশ্বের পদদলিত মানবতা পূর্ব আকাশের দিকে অধির আগ্রহে এহেন সদ্‌বিপ্রদের আগমনের জন্য অপেক্ষা করছে৷

প্রাউট প্রবক্তা পি.আর.সরকার যিনি সমগ্র বিশ্বে ধর্মগুরু শ্রীশ্রী  আনন্দমূর্ত্তিজী নামে সমধিক পরিচিত, তিনি বলেছেন ‘‘কয়েক লক্ষ  বছর পূর্বে মানবজাতির আবির্র্ভব হলেও, অদ্যাবধি একটি সুসংবদ্ধ বিশ্ব মানব সমাজ গড়ে তুলতে পারে নি৷

এখন তোমরা, যারা এর প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করেছো, এই মুহূর্ত থেকে এই মহান কাজে আত্মনিয়োগ কর৷ উদ্দেশ্য যেখানে মহৎ সাফল্য সেখানে অবশ্যম্ভাবী৷’’ এই উদ্দেশ্যে  তিনি  সমস্ত প্রাউট প্রবচনে, প্রাউট কমিটির মিটিং এ প্রাউট বিপ্লবের কথা বলেছেন৷ আর কী পরিকল্পনা নিতে হবে, কীভাবে নিতে হবে, কীভাবে শুরু করতে হবে, প্রতি অঞ্চলে কে বা কারা নেতৃত্ব দিবে, সবই তিনি বুঝিয়ে বলেছেন৷  এই বিপ্লবে তিনি সকল জৈব ও অজৈব সত্ত্বারই উপযুক্ত মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আপোষহীন সংগ্রামের কথা বলেছেন তাদের বিরুদ্ধে, যাঁরা ধর্মকে কলুসিত করেছে, যারা জাতি, বর্ণ, গোষ্ঠী ও জাতিয়তাবাদের নামে মানব পরিবারের মধ্যে গৃহ বিবাদ ও গৃহযুদ্ধের অবতারণা করছে, যারা নির্বিচারে পৃথিবীর সম্পদ লুন্ঠন করে চলেছে৷ তাই প্রাউটিষ্ট হিসাবে শ্রী সরকারের ডাকে  মানবতা  মুক্তির জন্য আমাদের সকলের প্রাউট  বিপ্লবের  মন্ত্রে দীক্ষিত হতে হবে৷

কিন্তু এখন প্রশ্ণ হচ্ছে--- এই প্রাউট বিপ্লবের মাধ্যমে প্রাউট প্রতিষ্ঠা কীভাবে হবে? কোন বিপ্লবই শুধু গালভরা মুখের কথায় হয়নি, হবে না? প্রসঙ্গত স্মরণীয় বিপ্লব বলতে শুধু রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র বিপ্লবেই বুঝায় না৷ বি---প্লব+ অন্‌ প্রত্যয় যোগে বিপ্লব কথার উৎপত্তি,যার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে বিশেষরূপে পরিবর্ত্তন (যা পূর্ববর্ত্তী কলুসিত অবস্থাকে প্লাবিত করে নূতন যুগের সৃষ্টি করে৷) যেমন সবুজ বিপ্লব, শিল্প বিপ্লব আবার ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব ইত্যাদি অর্থাৎ স্বল্প সময়ের মধ্যে একটি যুগের সামুহিক পরিবর্ত সাধিত হয় প্রচণ্ড শক্তি সম্প্রয়োগের মাধ্যমে৷ শুধু নৈতিক বা আধ্যাত্মিক চেতনার পরিবর্ত্তনের মাধ্যমে তা সহজলভ্য হয় না৷  আবার শুধু  বাকসর্বস্ব বিপ্লবী বা মেকী বিপ্লবী (স্যুডো রিভল্যুশনিষ্ট) যারা, তাদের পক্ষে ও কোন বিপ্লব সম্ভব নয়৷ 

বিপ্লবের প্রথম স্তরে বৃহত্তর  মানবকল্যাণের স্বার্থে মানসিক, মানবিক আবেদন করতে হবে, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উপদেশ দিতে হবে৷ তাতেও কাজ না হলে শক্তি প্রয়োগের পথে বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করতে হবে৷ যারা এ ব্যাপারে পিছু পা হবে, তারা মানবিক দায়িত্ববোধকে এড়িয়ে চলবে৷ এ কথা প্রাউট প্রবক্তা ও ধর্মগুরু শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন৷ তিনি বলেছেন, এহেন বিপ্লব অনভিপ্রেত হলেও তা অনিবার্য, অপ্রতিরোধ্য, অবশ্যম্ভাবী৷

সর্বজীবের কল্যাণের স্বার্থে, মানুসের শারীরিক -মানসিক- আধ্যাত্মিক বিকাশ ঘটিয়ে সর্বপ্রকার জাগতিক দুঃখ-ক্লেশ দূর করে এক আদর্শ মানব সমাজ ঘটন করতে সদ্‌বিপ্র প্রাউটিষ্ট নেতাদের উদ্দেশ্যে তিনি উদাত্ত কন্ঠে প্রভাত সঙ্গীতের  মাধ্যমে আহ্বান করে বলেছেন---

‘‘ডাক দিয়ে যাই যাই যাই,

আমি ডাক দিয়ে যাই যাই যাই৷

আলোকের পথ ধরে যারা যেতে চায়,

তাহাদের চিনে নিতে চাই৷

মানুষ পেয়েছে নানা ব্যাধি ক্লেশ তাপ

মানুষ পেয়েছে নানা শোক সন্তাপ৷

তাদের অশ্রু যারা মুছাইতে চায়, 

তাহাদের জেনে নিতে চাই৷

মানুষ সয়েছে বহু ক্ষুধার জ্বালা,

সহিয়াছে অপমান অবহেলা৷

যারা তাদের ক্ষতেতে প্রলেপ দিতে চায়,

তাহাদের মেনে নিতে চাই৷’’

প্রভাত সঙ্গীতে তিনি আবারো বলেছেন,

‘‘মানুষ যেন মানুষের তরে সবকিছু করে যায়

একথাও যেন মনে রাখে,

পশুপাখী তার পর নয়,

তরুও বাঁচিতে চায়৷’’