প্রাউটের শিল্পনীতি

লেখক
 সত্যসন্ধ দেব

প্রাউটের পঞ্চমূলনীতিতে বলা হয়েছে, বিশ্বে যে সম্পদ আছে তা মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের হাতে কুক্ষিগত হতে দেওয়া যাবে না৷ তাই প্রয়োজনাতিরিক্ত অবাধ সঞ্চয় প্রাউটে নিষিদ্ধ৷ তার ফলে সমাজ পুঁজিপতিদের দ্বারা তৈরী কৃত্রিম অভাবের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে৷ এবার, প্রকৃতির দেওয়া সম্পদের উৎকর্ষ সাধন করতে হবে৷ তাই আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে এ কাজে নিয়োজিত করবার সর্বাধিক প্রয়াস চাই৷ এইভাবে প্রাকৃতিক সম্পদকে মানুষের অভাব পূরণের উপযোগী করতে  হবে ও তার এমনভাবে সুষ্ঠু বন্টনের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে সমাজের প্রতিটি মানুষের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ হয় ও তাদের জীবনের মান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়৷ সমবণ্ঢন সম্ভব নয়৷ কিন্তু বন্টন যেন যুক্তিসঙ্গত ও মানবিকতাপূর্ণ হয়৷ সঙ্গে সঙ্গে প্রাউট এও বলছে, মানুষের ত্রিমুখী চাহিদা মেটানোর জন্যে সমাজকে যত্নশীল হতে হবে অর্থাৎ দৈহিক, মানসিক ও আত্মিক–এই তিন স্তরেই মানুষের বিকাশ চাই, তার ব্যবস্থা করতে হবে৷ প্রাউটের এই মূলনীতির ওপর আধারিত প্রাউটের বিশল্পনীতি, কৃষিনীতি প্রভৃতি৷

ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যষ্টিগত মালিকানায় সমস্ত শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়৷ এতে এক শ্রেণীর মানুষ অতি ধনী হয়ে পড়ে৷ এই পুঁজিপতিরা মুনাফার দিকে তাকিয়ে শিল্প গড়ে, দেশের উন্নতির দিকে তাকিয়ে নয়৷ তাই এরা লাভের দিকে তাকিয়ে শিল্পকে কেন্দ্রীভূত করে৷ ফলে সারা দেশে শিল্প গড়ে ওঠে না, বিশেষ বিশেষ শিল্পাঞ্চল গড়ে ওঠে৷ এতে একদিকে যেমন নাগরিক জীবনের কদর্যতা বাড়ে, অন্যদিকে গ্রাম অবহেলিত হয়৷ দ্বিতীয়তঃ পুঁজিবাদী শিল্পনীতির ফলে দেশে বেকার সংখ্যা দ্রূত বাড়তে থাকে৷ কারণ আধুনিক বৃহৎ শিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় গ্রামীণ ক্ষুদ্র শিল্প ধ্বংস হয়ে যায়৷ বৃহৎ শিল্পে যারা কাজ পায়, তার চেয়ে অনেক বেশী মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে৷ তৃতীয়তঃ পুঁজিপতিরা একচেটিয়া কারবার করে’ ইচ্ছামত মূল্যবৃদ্ধি ঘটায়৷ চতুর্থতঃ দেশের মূলধন সকল সময় অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্যের উৎপাদন বাড়ানোর কাজে লাগে না, বরং বিলাসদ্রব্য উৎপাদনের কাজে ব্যবহূত হয়৷ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের পর্যাপ্ত উৎপাদন করে’ দেশের মানুষের কল্যাণসাধন করা উচিত৷ কিন্তু পুঁজিপতিরা এই নীতিবোধে উদ্বুদ্ধ না হয়ে মুনাফা অর্জনের প্রেরণায় শিল্প গড়ে তাই লাভজনক বিবেচনায় ধনিকশ্রেণীর প্রয়োজনে অতিবিলাসের সামগ্রীই প্রস্তুত করে৷ পঞ্চমতঃ সমাজের অধিকাংশ মুষ্টিমেয় সম্পদ মানুষের কুক্ষীগত হবার জন্যে ফলে চারিদিকে অভাবের মাত্রা চরম হওয়ার সুযোগ নিয়ে পুঁজিপতিরা টাকার জোরে দেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য, এমনকি তথাকথিত আনুষ্ঠানিক ধর্মগুলিকেও নিজ স্বার্থে নিয়ন্ত্রিত করে৷ ফলে এই সমস্ত কিছুর অবনতিতে দেশের সভ্যতা–সংস্কৃতি অধোগতি প্রাপ্ত হয়৷

মিশ্র অর্থনীতিতে ধনতান্ত্রিক কাঠামোকে ধ্বংস তো করাই হয় না, ধনতান্ত্রিক সমাজের সমস্ত বদ্গুণগুলি থেকে যায়৷ কম্যুনিজ্ম দেশের সমস্ত শিল্প–বাণিজ্যকে রাষ্ট্রীয়করণ করার কথা বলে৷ তাতে ব্যষ্টি বা শ্রেণীগত ধনতন্ত্রের পরিবর্ত্তে রাষ্ট্রীয় ধনতন্ত্রের উদ্ভব হয়, আর শিল্প উৎপাদনে ইন্সেন্টিভ না থাকার ফলে অর্থনীতির বিকাশের গতিও হ্রাসপ্রাপ্ত হয়৷

তাই প্রাউট দেশের শিল্পব্যবস্থাকে ৩ ভাগে ভাগ করেছে৷ (১) দেশের মূল বৃহৎ শিল্পগুলি •Key Industries— থাকবে স্থানীয় সরকারের হাতে৷ মূল শিল্প বলতে বোঝানো হচ্ছে সেই সমস্ত শিল্পগুলিকে যেগুলি জনসাধারণের ভোগ্যপণ্য প্রত্যক্ষভাবে উৎপাদন করে না, অন্যান্য শিল্পের কাঁচামাল উৎপাদন করে৷ অর্থাৎ যাদের ওপর অন্যান্য শিল্প নির্ভর করে৷ যেমন, লোহা ও ইস্পাত শিল্প, এগুলি না–লাভ না–ক্ষতির ভিত্তিতে চলবে৷ (২) অন্যান্য সমস্ত বৃহৎ ও মাঝারি শিল্প চলবে সববায় নীতিতে৷ (৩) ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুটির শিল্পগুলি কেবল মাত্র ব্যষ্টির উপর ছেড়ে দেওয়া হবে৷ ব্যবসা– বাণিজ্যও যতদূর সম্ভব সমবায়ের মাধ্যমে পরিচালিত হবে৷ প্রাউট ব্লকভিত্তিক পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্লকে ব্লকে ব্যাপকভাবে কৃষিভিত্তিক (Agro-Industry)ও কৃষি সহায়ক শিল্প (Agrico Industry) গড়ে তুলে বেকার সমস্যার সমাধান করতে চায়৷ এগুলি চলবে সমবায়ের মাধ্যমে৷ প্রাউটের নীতি হ’ল এর মাধ্যমে ৪০ শতাংশ মানুষের কর্ম সংস্থান৷ ২০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান করা হবে বৃহৎ অকৃষি শিল্প থেকে৷ তা চালাবে স্থানীয় সরকার৷